দুর্ঘটনা হ্রাসসহ সড়কখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে কার্যকর হয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। এ সংক্রান্ত বিলটি গত বছর জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির সম্মতি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আইনে রূপ নেয় এবং গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর ফলে অকার্যকর হয়ে যায় পুরানো আইন ‘মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩’। যদিও নতুন আইনের যথাযথ প্রয়োগ গত দু’দিনে অন্তত রাজধানীতে খুব একটা চোখে পড়েনি। এছাড়া গেজেট প্রকাশের দীর্ঘ ১৪ মাস পর তা বাস্তবায়নের ঘটনাও নেতিবাচক অর্থে নজিরবিহীন। তবুও নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সরকার আইনটি কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে; যা অত্যন্ত ইতিবাচক বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান জাতিকে আশান্বিত করেছে।
নিকট অতীতে বহুবার আমরা দেখেছি, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষ করে দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) যখন ঘোষণা দিয়ে অভিযানে নামে, তখন সড়কে যাত্রীবাহী গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহন কমে যায়। কারণ সারা দেশে পাঁচ লাখ গাড়ির বৈধ কাগজপত্র এবং ১৮ লাখ চালকের লাইসেন্স নেই। সূত্র: বিআরটিএ। ফলে পুলিশের তোপের মুখে পড়া কিংবা বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের জেল-জরিমানার ভয়ে অবৈধ গাড়ি ও অবৈধ চালকের সংখ্যা হঠাৎ কমে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ যাত্রীরা।
এছাড়া পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এবং বিআরটিএ একটু কঠোর হলেই পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘট ডেকে বসে। বুদ্ধিমান (!) মালিক-শ্রমিক নেতারা কখনও কখনও এ ধরনের বেআইনি ধর্মঘটের নাম দিয়ে থাকেন ‘শ্রমিকদের কর্মবিরতি’! গোটা জাতিকে জিম্মি করে কর্মবিরতির নামে তাদের সঙ্গে মালিক শ্রমিক নেতাদের কি নির্মম তামাশা!
চালকের খামখেয়ালিপনা কিংবা স্বেচ্ছাচারিতায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটলে অথবা দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি ফিটনেসবিহীন ও এর চালক লাইসেন্সবিহীন হওয়ার কারণে মামলা এবং চালক ও সহকারিকে পুলিশ-র্যাব গ্রেপ্তার করলে, আদালত তাদের সাজা দিলে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দেশবাসীকে জিম্মি করার মতো জঘন্য ঘটনার অনেক নজিরও রয়েছে। কিন্তু জনস্বার্থবিরোধী এ হেন কাজের জন্য মালিক ও শ্রমিক নেতাদের কখনও আইনের আওতায় আনা হয়নি।
ওপরে এতো কথা বলার উদ্দেশ্য হলো- আমরা আমজনতা পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছে কার্যত জিম্মি এবং সরকারও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর নয়, তা সকলকে অবহিত করা। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা বেসরকারি খাতের ওপর অধিক নির্ভরশীল। এই একচেটিয়া নির্ভরশীলতার সুযোগ নিচ্ছেন মালিক ও শ্রমিক নেতারা; যা অত্যন্ত দুঃখজনক, নিন্দনীয়।
তবে সড়কখাতে জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য একটি সরকারি সংস্থাও আছে, যার নাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি)। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ বাণিজ্যিক সংস্থার বহরে যাত্রী ও পণ্যবাহী- দু’ধরনের যানবাহনই রয়েছে। যাত্রীসেবার মান ও পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে বিআরটিসির জন্য বিভিন্ন সময়ে ভারত, থাইল্যান্ড ও চায়না থেকে বিপুলসংখ্যক বিলাসবহুল একতলা ও দ্বিতল বাস কিনেছে সরকার। ক্রয় করা হয়েছে নন-এসি সাধারণ বাসও। সংস্থার বহরে যুক্ত করার জন্য বাস-ট্রাক কেনার প্রক্রিয়াটি এর জন্মলগ্ন থেকেই চলমান রয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিআরটিসির প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাস টার্মিনাল, পর্যাপ্ত সংখ্যক ডিপো, মেরামত কারখানা, চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকায় প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় জনবলসমৃদ্ধ আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই সংস্থার মালিকানাধীন যাত্রীবাহী গাড়ির সংখ্যাও প্রচুর। যদিও এর এক-তৃতীয়াংশ গাড়ি সারা বছরই কারখানায় অচল থাকে, ডিপোগুলোতে অলস পড়ে থাকে। বিদেশ থেকে আমদানির (ক্রয়) পর যেসব গাড়ি কোনো কারণে একবার বিকল হয়ে যায়, সেগুলোর অর্ধসংখ্যকও মেরামত করে যাত্রীসেবায় নিয়োজিত করা হয় না। বিষয়টি রহস্যজনক হলেও এর নেপথ্যের কারণ অনেকেরই জানা আছে।
এমনকি ক্রয়কালে বিদেশী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে গাড়িগুলোর যে ‘ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের’ উল্লেখ থাকে সে সময়ের মধ্যে বিকল হলেও তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় না। বিআরটিসির নিজস্ব তথা সরকারি খরচেই সেগুলো মেরামত করা হয়ে থাকে। যদিও বিকল গাড়ির অর্ধেকই মেরামত করে সচল করা হয় না। বরং ডিপো ও কারখানার অচল গাড়িগুলো মেরামত করার চেয়ে বিদেশ থেকে নতুন গাড়ি ক্রয়ের দিকেই সংস্থাটির আগ্রহ অনেক বেশি। এতে একদিকে সরকারি তথা জনগণের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে ক্রমাগত ভারি হচ্ছে লোকসানের বোঝা।
বিআরটিসির আরেকটি নেতিবাচক কাজ হচ্ছে- বিদেশ থেকে গাড়ি কিনে সেগুলোকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া। ইজারাগ্রহিতারা বিভিন্ন রুটে এসব বাস পরিচালনা করে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে তাদের জিম্মায় (ইজারা) থাকা বাসগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় অর্থনৈতিক আয়ুষ্কালের আগেই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে এবং একসময়ে বিআরটিসিকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশে শতকরা ৫৫ শতাংশ যাত্রী সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। (সূত্র: নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি)। এই ৫৫ শতাংশ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র তথা সরকারের অবশ্যই দায়বদ্ধতা রয়েছে; যা সংবিধান স্বীকৃত। অথচ সড়কে যাতায়াতকারী মানুষের ৪৫ শতাংশই বেসরকারি পরিবহন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। আর এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন পরিবহন মালিকেরা, সুযোগের অসদ্ব্যবহার করছেন শ্রমিকনেতা নামধারী এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ; যাদের অধিকাংশই পরিবহন মালিক। এখানে রাজনীতিবিদদের কথা এ কারণে বললাম যে, আমাদের সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর শীর্ষনেতাদের প্রায় সকলেই ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁদের অনেকেই সাংসদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, নিকট অতীতে কেউ কেউ মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। পরিবহন ব্যবস্থার ওপর গত দেড় দশকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনায় আমি বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়েছি।
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে আমি এটাও নিশ্চিত হয়েছি যে, শুধু আইন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। এজন্য সড়কখাতে বিরাজমান নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দূর করে জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। কিন্তু বেসরকারি খাতের ওপর একক নির্ভরশীলতা বজায় থাকলে তা কখনও সম্ভব হবে না; এটা বাস্তবমুখীও নয়। সে ক্ষেত্রে বিআরটিসিকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা আবশ্যক; যা এখন সময়ের দাবি।
এ প্রসঙ্গে আমার কয়েকটি প্রস্তাবনা নিচে তুলে ধরছি:
১. বিআরটিসির বহরে পর্যাপ্তসংখ্যক বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান যুক্ত করতে হবে।
২. দক্ষ চালক ও সহকারিসহ বিআরটিসিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
৩. আইন করে বিআরটিসির বাস ইজারা দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
৪. রাজধানীর সকল রুটসহ ঢাকা থেকে দূরপাল্লার সকল রুট ও দেশের সকল আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালু করতে হবে।
৫. বিআরটিসির বাসগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেগুলো মেরামত করতে হবে।
৬. ডিপোতে পড়ে থাকা মেরামতযোগ্য বাসগুলো দ্রুত সচল ও বহরে যুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
৭. অব্যাহত লোকসান কমিয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিকে লাভজনক করতে বিআরটিসির কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।
৮. বিআরটিসির গত ২০ বছরের অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
আমি আশাবাদী মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিলে জনস্বার্থে বিআরটিসিকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে খুব বেশিদিন লাগবে বলে মনে করি না।
অন্যদিকে, নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি যথাযথভাবে কার্যকর হওয়া উচিত। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সংক্রান্ত বিধিমালা তৈরি ও সেগুলো কার্যকর করা দরকার। তা না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। আমার দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি, নতুন আইন ও এর অধীনে যেসব বিধিবিধান প্রণীত হবে সেগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সড়কখাতের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)