আসন্ন ২২ আগস্ট পবিত্র ঈদ উল আযহাকে সামনে রেখে শহর থেকে গ্রামের দিকে ঘরমুখী মানুষের পদচারণা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। পরিবারের মানুষ, প্রিয়জন, সহপাঠী, সহকর্মীদের সাথে ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করার মানসিকতা থেকেই নাড়ির টানে বাড়ির পানে ছুটে চলে শহরে কর্মের সন্ধানে থাকা মানুষগুলো। কেবলমাত্র উৎসবের সময়গুলোতে পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়ে থাকে এমন পরিবারও আমাদের সমাজে দেখা যায়। তাই ঈদ কেবল আনন্দের, ঈদের আনন্দকে উৎসবমুখর ও প্রাণান্তকর করার প্রত্যয়ে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের প্রচেষ্টাও থাকে দেখার মতো।
প্রত্যেকেই যার যার জায়গা থেকে আনন্দের অনুষঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সর্বদা উদ্বেলিত থাকে। কারণ, বছরে মাত্র ২ বার ঈদ আসে আমাদের জীবনে। তবে ঈদের আনন্দ বিমর্ষপূর্ণ হয়ে উঠে যখন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে থাকে পরিবারের কোন সদস্য। তাই ঈদের যাত্রা সকলের নির্বিঘ্ন হোক সে প্রত্যাশাই করি সর্বদা। তাছাড়া, ঈদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করার জন্য আমাদের সকলেরও যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
ঈদের জন্য মানুষের পদচারণার সাথে সাথে রাস্তাঘাটে যানবাহন ও অন্যান্য অনুষঙ্গের চাহিদা বৃদ্ধি কল্পে নানাবিধ সংকট ও সমস্যার মুখোমুখি হয় ঘরমুখী মানুষ। তথাপি ঈদকে সামনে রেখে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির আগাম প্রস্তুতি ও পরিবহন ব্যবস্থার আগাম প্রস্তুতি সত্ত্বেও দুর্ঘটনাও হরহামেশাই ঘটে থাকে। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের জন্য সারাজীবনের কান্না হয়ে থাকে। নীতিকথা গুলো সম্বন্ধে আমরা সকলেই অবগত কিন্তু কেউই নীতিকথা গুলো মেনে চলতে সেভাবে সতর্ক হই না।
রাস্তাঘাটে পুরাতন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি নামানো হলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে এ কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু মালিক পক্ষ ও পরিবহন শ্রমিকেরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় ঈদ সহ অন্যান্য উৎসবকে সামনে রেখে পুরাতন ও জরাজীর্ণ গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে মুনাফা লাভের পায়তারা করে থাকে।
পাশাপাশি উৎসবের পূর্বে রেডিও টেলিভিশন ও অন্যান্য মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে কেউ পরিবহনে ভ্রমণ করবেন না। কিন্তু আমরাই নিজেরা অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে উৎসবে বাড়ির পথে রওয়ানা হই। বাস, লঞ্চ এবং ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী সংবলিত ছবি পত্রিকার পাতায় ফলাও হতে প্রচার হতে দেখেও আমরা সচেতন হই না। ফলশ্রুতিতে দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে থাকি আমরা সহ আমাদের পরিচিতজনরা। কাজেই নিজেরা সচেতন ও রাস্তাঘাটে চলাচলে সতর্ক না হলে কোনভাবেই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়।
সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র/ছাত্রীদের দেশব্যাপী আন্দোলনের কারণে মানুষের মাঝে নিরাপদ সড়কের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আন্দোলনের ফলস্বরূপ দেখা যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে পূর্বের ন্যায় দুর্ঘটনা ঘটছে না, কমে আসছে হতাহতের সংখ্যা। তবে একবারে যে দুর্ঘটনা কমে গেছে সে কথাও আমরা বলতে পারছি না। পাশাপাশি রাস্তাঘাটে যোগাযোগ সংক্রান্ত অন্যান্য এজেন্সিগুলোও নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। তৎসাপেক্ষে এখনো পর্যন্ত ঈদ যাত্রায় বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনার সংবাদ শোনা যায় নি এবং লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি রাস্তাঘাটেও তেমন চোখে পড়ছে না। আশা রাখবো ঈদ উৎসব চলাকালীন সময়েও দুর্ঘটনার কোন সংবাদের মুখোমুখি হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবো না আমরা।
তবে সতর্কতা অবলম্বনের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ ভাবে দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের পরেও বিভাগীয় শহরগুলোতে ওভারব্রিজ, ফুট ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও সময় বাঁচানোর জন্যে কিছু সংখ্যক লোকের ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পারাপারের দৃশ্য বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। এ রকম অসতর্ক অবস্থায় চলাচলের কারণে যে কোন সময় দুর্ঘটনার স্বীকার হতে পারে রাস্তা পার হওয়া লোকজন। আমরা সকলেই জানি, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু মেনে চলতেই আমাদের যত সমস্যা, তবে মেনে না চললে সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হবে।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ছাত্র/ছাত্রীদের দ্বারা পরীক্ষিত লাইসেন্সের প্রভাবে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা তেমন ঘটছে না বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। কারণ, লাইসেন্স ছাড়া মূলত ড্রাইভারের সহযোগীরা রাস্তায় গাড়ি পরিচালনা করে থাকে। যার ভিত্তিতে হরহামেশাই ঘটে থাকে দুর্ঘটনা। তবে এবারের ঈদে রাস্তাঘাটে লাইসেন্স এর সঠিকতা ব্যতিরেকে কেউই রাস্তায় গাড়ি নামানোর সাহস পাচ্ছে না। বিষয়টা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং পরিবহন ব্যবস্থার সঠিকতা যাচাইয়ের অন্যতম নিয়ামক। কাজেই যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে সেটি চলমান রাখতে হবে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার স্বার্থে। বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাফিক সপ্তাহ পালন নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার যে বার্তা সকলের কাছে প্রচার করেছে সেটি নিঃসন্দেহে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা হ্রাস করার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ফলপ্রসূ হিসেবে কাজ করবে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, একটি বিশেষ মহল ঈদ যাত্রাকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে ট্রেনে আসার পথে দুজন মহিলার স্বর্ণের চেইন খোয়া যাবার ঘটনা ঘটেছে ট্রেনটিতে। যাত্রাপথে স্টেশনগুলোতে ছিনতাইকারীরা ওঁৎ পেতে থাকে শিকারের প্রত্যাশায়। একটু অসচেতন হলেই এবং অসতর্ক অবস্থায় যাতায়াত করলে যে কোন সময়ে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে যায় গ্রামে পরিবার পরিজনদের নিকট গমনরত যাত্রীরা। পাশাপাশি ঈদ উৎসবকে সামনে রেখে পরিবহন ব্যবস্থায় শুরু হয় অস্থিরতা ও নৈরাজ্য। বাসের টিকেট চলে যায় কালোবাজারীদের হাতে, ট্রেনের টিকেট চলে যায় ব্ল্যাকম্যানদের হাতে। যাত্রীদের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া পরিশোধ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। তথাপি রাস্তার মাঝপথেও ঝক্কি ঝামেলা কম পোহাতে হয় না যাত্রীদের!
পবিত্র ঈদ উল আযহার বিশেষত্ব হল কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে মুসলিম উম্মাহর জীবনে শান্তি ও ঐক্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয় কুরবানির মাধ্যমে। সকলের মাঝে ঈদের আনন্দ ও পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ঈদানন্দের অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য ও পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হয় মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। সকলের প্রচেষ্টা থাকে নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে থেকে সুস্থ, সবল ও মোটাতাজা পশু কুরবানি দেওয়া।
কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানদের মনের পবিত্রতা রক্ষিত হয়, ঝরে পড়ে মনের মধ্যে থাকা কলুষতা, রক্ষিত হয় ধর্মীয় আনুগত্যের বন্ধন। কুরবানির গোশত সমাজের গরিব/দরিদ্র শ্রেণী, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বিতরণ করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের সৃষ্টি হয়। সমাজের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় আত্মিক বন্ধন, স্পষ্টত হয় দৃঢ়তার বন্ধন। পাশাপাশি কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকায় গরিব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিতরণ করার মাধ্যমে সমাজের মধ্যে কিছুটা হলেও দূরত্ব কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় সকলের মধ্যে। ঈদের নামাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে নামাজ পড়ার দৃশ্যও মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টিতে কাজ করে থাকে।
এছাড়াও, ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ী শ্রেণীর সারা বছরের প্রস্তুতি মহাসমারোহে রূপ নেয় পবিত্র ঈদ উল আযহায়। ঈদ উল ফিতরের ন্যায় নতুন কাপড় চোপড়ের বিক্রি কম থাকলেও খাবার সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির বিক্রি থাকে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে কুরবানির গোশত রান্না সংক্রান্তে বিপুল পরিমাণের মসলা, সেমাই, চিনি, পিঠা, তেল, সাবান, নারকেল সহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিক্রি হয়ে থাকে অধিক পরিমাণে।
তবে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী এ সকল নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে সাধারণ জনগণের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। পণ্য মজুদ রেখে দাম বৃদ্ধির সংস্কৃতি বহুকাল থেকেই দেখে আসছি বাংলাদেশে। অনেক সময় আমরা এমনও দেখেছি, সরকারও এরূপ ব্যবসায়ীর নিকট অসহায় সমর্পণ করেছে। ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকদের চরিত্র একই রকমের দেখা যায়। কারণ, দু পক্ষই সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকে। বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত সমস্যায় পর্যবসিত হয়েছে।
নানাবিধ সমস্যা ও সংকটের মধ্যেও পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ কাটানোর উদ্দেশ্যে গ্রামীণ আবহে আনন্দ ও উৎসবরে আমেজ তৈরিতে সকলের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা উৎসবের আনন্দকে বৃদ্ধি করবে নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের নিমিত্তে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ততক্ষণ আলোর মুখ দেখবে না যতক্ষণ না জনগণ সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। কাজেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার বাস্তবায়নে ঈদানন্দ অব্যাহত থাকুক। অযাচিত দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদে থাকুক বাংলার জনগণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)