শুক্রবার সকালে মাকে গ্রামের বাসে উঠিয়ে দিচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রিফাত। করোনাভাইরাসের মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য দুই সিটে একজন যাত্রীর বসার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র দেখে আক্কেল গুড়ুম অবস্থা রিফাতের। দুই সিটে একজনকে বসানো তো দূরের কথা, বাসে গাদাগাদি করে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী। পরে মাকে ফোন দিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন ভাড়া নেওয়া হয়েছে দ্বিগুণ। প্রতিবাদ করায় মাঝ রাস্তায় বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে তার মাকে!
স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত ১ জুন থেকে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লা রুটে বাস বা মিনিবাস চলার অনুমতি দেয় সরকার। করোনাকালীন সময়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠার জন্য বিআরটিএ প্রস্তাবিত বাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এবং এর আশপাশের এলাকাসহ আন্তঃজেলা এবং দূরপাল্লার বাস, মিনিবাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ার কথা থাকলেও ক্রমে দেশের সব বাস, মিনিবাস পরিসেবায় ভাড়া ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩ মে প্রজ্ঞাপন মূলে উল্লিখিত বিদ্যমান ভাড়ার (যাত্রী প্রতি কিলোমিটার সর্বোচ্চ ১.৪২ টাকা) ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। একই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই বাস ভাড়া কেবলমাত্র করোনা মহামারীর সময়ে প্রযোজ্য হবে এবং মহামারী শেষ হয়ে গেলে বাসের ভাড়া আগের হার অনুসারে নেয়া হবে।
প্রজ্ঞাপনের শর্তাবলীতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলাচল করানো হবে। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া যাবে না, ভাড়ার চার্ট দেখিয়ে ভাড়া নিতে হবে। যাত্রীদের মাঝে একটি করে সিট খালি রাখতে হবে ইত্যাদি।
ঈদুল আজহার আগে মোটামুটি স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও ঈদের পরপরই উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। ঈদ শেষে রাজধানী ও যার যার কর্মস্থলে ফেরার পথে পদে পদে হয়রানীর অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা। স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, এক সিটের জায়গায় দুই সিটেই যাত্রী তোলা হচ্ছে এবং সরকারের নির্ধারিত ৬০ শতাংশের জায়গায় দ্বিগুণ এবং কোথাও কোথাও চারগুণ ভাড়া বেশি রাখারও অভিযোগ এসেছে বেশ কিছু যাত্রীদের কাছ থেকে।
ঈদের ছুটি শেষে দেশ ট্রাভেলস বাসে করে রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) চিকিৎসক ডা. মো. আখতারুজ্জামান সৈকত। ৩৬ সিটের বিপরীতে ১৮ জন যাত্রীর পরিবর্তে ৩০ জন যাত্রী বাসে তোলার অভিযোগ ও ৬০ শতাংশ ভাড়ার বেশি রাখার প্রতিবাদ জানালে তার দিকে সেই বাসেরকর্মীরা চড়াও হোন বলে অভিযোগ করেছেন এই চিকিৎসক।
একই অভিযোগ উঠেছে শ্যামলী পরিবহনের বিরুদ্ধেও। রংপুর থেকে কক্সবাজারের নন-এসি বাসের ভাড়া করোনা মহামারীর আগে ছিলো ৮০০ টাকা। সরকারের প্রজ্ঞাপনের পর ৬০ শতাংশ হারে বেড়ে ১৩০০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও ঈদের পর সেই ভাড়া বেড়ে হয়েছে ১৮০০টাকা! পাশাপাশি প্রতি সিটে যাত্রী বসিয়ে আনারও অভিযোগ উঠেছে পরিবহন সংস্থাটির নামে।
অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির নামও। ময়মনসিংহ থেকে এসি বাসের ভাড়া সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৮০০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও পরিবহনটিতে প্রতি সিটের ভাড়া রাখা হয়েছে ১০০০ টাকা। দুই সিটে এক যাত্রী বসানোর কথা উঠতেই ১৬০০ টাকা চাওয়া হয়েছে। আর কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ৮০ টাকার বিআরটিসি বাসে ভাড়া রাখা হয়েছে ২০০ টাকা এবং এখানেও যথারীতি কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চ্যানেল আই অনলাইন থেকে শ্যামলী পরিবহন ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও অপরপ্রান্তে কেউই ফোন ধরেননি। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ভোক্তা বাতায়ন হটলাইন ১৬১২১ নম্বরে ফোন দেওয়ার পর জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে যেকোনো অভিযোগ লিখিত আকারে অধিদফতরের নিকট জমা দেওয়ার জন্য। ঢাকার বাইরে উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে। এদিকে গণপরিবহনে যেকোনো অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ করার জন্য বিআরটিএ প্রদত্ত একটি বিশেষ নম্বরে দেওয়ার পর তা বন্ধ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক যাত্রী।
রাজধানীতেও স্বাস্থ্যবিধিকে বুড়ো আঙুল
গত জুনে সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আবারও পরিবহন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর শুরুতে মোটামুটি স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে নিয়মও। শুরুর দিকে বাসচালক, হেল্পারের মুখে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেখা গেলেও এখন চালক-হেল্পারের মুখে মাস্ক ও বসার সিট স্যানিটাইজ করতে দেখা যায়নি। সরেজমিনে একাধিক পরিবহন কর্মীকে স্যানিটাইজার কোথায় জিজ্ঞেস করার পর মালিকদের পক্ষ থেকে স্যানিটাইজার কেনার টাকা তাদের দেয়া হয় না বলে জানিয়েছেন তারা।
ভাড়া নিয়েও আছে অনিয়ম। ঢাকা মহানগরীতে সর্বনিম্ন ভাড়া ৭টাকা রাখা যাবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হলেও বাস্তবে হাতেগোণা দুই-একটি পরিবহন ব্যতীত প্রায় সবক্ষেত্রেই সর্বনিন্ম ভাড়া রাখা হচ্ছে ১৫টাকা। মহামারীর আগে যেসব বাসের ভাড়া ছিলো ১০ টাকা এখন সেসব বাসগুলোতে এখন ভাড়া রাখা হচ্ছে ২০ টাকা!
ভাড়া বেশি রাখার অনিয়মের সঙ্গে সিট ব্যবস্থা নিয়েও অভিযোগ বিস্তর। নিয়ম অনুযায়ী এক সিট ফাঁকা রেখে অনেক পরিবহনে দাঁড়িয়েও যাত্রী নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন প্রতিবেদক। প্রজ্ঞাপনে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া যাবে না, ভাড়ার চার্ট দেখিয়ে ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন কর্মীদের বচসা নিয়মিত বিষয়। মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলীগামী হিউম্যান হলারগুলোতে এক সিট ব্যবধান রেখে যাত্রী বসানোর কথা থাকলেও গাদাগাদি করেই যাতায়াত করছেন যাত্রীরা এবং ভাড়াও গুণতে হচ্ছে ৬০ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ।
বৃথাই যত তর্জন-গর্জন
মহামারী শেষ হয়ে গেলে বাসের ভাড়া আগের হার অনুসারে নেয়া হবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হলেও ভাড়া আর কখনোই কমবে না বলে মনে করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। অতীতে সিটিং পদ্ধতিতে বাস ভাড়া বাড়ানো হলে পরে লোকাল ব্যবস্থায় ফিরে গেলেও যেমন বাস ভাড়া কমানো যায়নি এবারও তাই হবে বলে মনে করে তিনি।
করোনা মহামারীতে যে কেবল মাত্র পরিবহন খাত নয়, প্রায় সমস্ত খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে ভাড়া বাড়ানোর প্রজ্ঞাপনের সময় বিষয়টি সরকারের ভাবনার প্রয়োজন ছিলো বলে মনে করেন মোজ্জাম্মেল। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠলে এই দ্বিগুণ ভাড়া পরিশোধ করাটাই একটা সময় সাধারণ মানুষের জন্য ভীষণ বোঝা হয়ে উঠবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
আবার পরিবহন নিয়ে যেকোনো আন্দোলনে সাধারণ যাত্রীদের পাশে পাওয়া যায় না বলেও দাবী যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের, ‘যাদের জন্য কথা বলতে চাই তারাই পাশে থাকেন না। যত অভিযোগ, এই সাধারণ মানুষরাই যদি সামনে এসে না বলেন তাহলে আমাদের একার পক্ষে কী করা সম্ভব?’
আবার যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা নিয়েও অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন মোজ্জামেল। ভ্রাম্যমাণ আদালত বাস ও চালকদের কাগজপত্র ঠিক না থাকলে জরিমানা করলেও করোনার সময় যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা, বাসের ভাড়া নিয়ম মেনে নেওয়া হচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে কখনোই অভিযান পরিচালনা করেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। সাধারণ মানুষের চেয়ে পরিবহনখাত সবসময় সরকারের কাছ থেকে ‘জামাইআদর’ পায় বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)