দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এখন কাশ্মীরের মতো উচ্চারিত হচ্ছে পাকিস্তানের প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গা নিয়ে অবস্থিত বেলুচিস্তান প্রদেশের নাম। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা অনেকটা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের মতো। একই কায়দায় শাসন ও শোষণ করে যাচ্ছে পাকিস্তান সরকার। কালাত, খারন, মারখান ও লাসবেলা এই চার অঞ্চল নিয়ে গঠিত বেলুচিস্তান মূলত ‘কালাত চুক্তি’র মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। চুক্তিতে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অর্থনীতি বিষয়ে ইসলামাবাদের কর্তৃত্ব থাকার কথা থাকলেও ’৪৮ সালে জিন্নাহর সঙ্গে বেলুচ রাজাদের চুক্তির কোনো কিছুই মানেনি বিভিন্ন সময়ের পাকিস্তানী সরকার। সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দখল করে বেলুচিস্তান প্রদেশ তৈরি করেছে তারা। তখন থেকে গুম-হত্যা-নির্যাতনের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয় প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বেলুচিস্তান। নিজেদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বেলুচবাসীরা, প্রতিবাদ আর স্বাধীনতার দাবিতে আটচল্লিশ সালের পর থেকেই তারা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৭৩ সালের দিকে তা জোরদার হয়, কিন্তু পাকিস্তানী সেনাদের নানা দমন পীড়নে তারা বার বার পথ হারিয়েছে। ২০০৩ সালে বেলুচদের জাতীয় নেতা নবাব আকবর বুগতিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করলে আন্দোলন আবার জোরদার হয়। কৃষি, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ওই প্রদেশ থেকে সবধরণের সম্পদ আহরণ করে তা পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডে কাজে লাগায়। কিন্তু তার বিপরীতে খাদ্য-পানি-কর্মসংস্থানের মতো বিষয়ে বেলুচবাসীদের সঙ্গে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে পাকিস্তান সরকার, যা ’৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশের ছায়াস্বরূপ। ২০১৬ সালের প্রায় পুরোটা জুড়ে ভারত-পাকিস্তান অলিখিত যুদ্ধের কারণে কাশ্মীরের সাথে সাথে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অনাচারের চিত্র ফুটে ওঠে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসকে জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসর্গ করার পাল্টা জবাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদী ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বেলুচিস্তানসহ পাকিস্তানের অধীনে থাকা কাশ্মীরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দমননীতির সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য প্রায় সরাসরি অবস্থান নেয় ভারত। এরপর থেকেই বিষয়টি প্রায় নিয়মিত বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সর্ম্পক ভাল হচ্ছে, খারাপ হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আগের সর্ম্পকের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি পাকিস্তান। সীমান্তবর্তী আরেক দেশ ইরানও বেলুচিস্তানের বিষয়ে ইতিবাচক। এমন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫তম বার্ষিকীর দুইদিন আগে রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের সেমিনারে বেলুচিস্তানে চালানো গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন বেলুচিস্তানের কালাত প্রদেশের রাজা সুলাইমান দাউদ। তুলে ধরেন পাকিস্তানি শাসকদের নানা অত্যাচার ও অনাচারের চিত্র। সেমিনারে দেয়া বক্তব্যে কালাত প্রদেশের রাজা বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের সমর্থন প্রার্থনা করেন। বিষয়টি দেশের গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত-প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমিক পরিবেশে আয়োজিত ওই সেমিনারে বেলুচ নেতার আহ্বান বাংলাদেশ সরকারের নজরে নিশ্চয় এসেছে, হয়তো এসেছে বেলুচবাসীদের নির্যাতনের খবরও। বেলুচিস্তান ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চেয়ে এর আগে পাকিস্তানও জানতে চেয়েছিল, কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি বাংলাদেশ। একটি দেশের সরকারের পক্ষে অন্য একটি দেশের একটি অংশের স্বাধীনতাকামীদের সরাসরি সমর্থন জানানো হয়তো সম্ভব হয় না। তবে, এটা ঠিক পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করা বাংলাদেশের মানুষ বেলুচিস্তানসহ স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে আছে। এ নৈতিক সমর্থন হয়তো বাংলাদেশ সরকারকে সময় ও সুযোগমতো অবস্থান স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।