বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘দারিদ্র্য’কবিতাটির শুরুতেই লিখেছেন—হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান! তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
দারিদ্র্য কবিকেও মহান করেছে। দরিদ্রের ক্ষুধাতুরের যন্ত্রণাকাতরতা উপলব্ধি করে নজরুল বিদ্রোহী হয়েছেন। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের জলকন্যা মাহফুজা খাতুন শিলা দারিদ্র্য নিয়েই ভারতের এস এ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক আর ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে (সাঁতারের ইভেন্টের নাম) জোড়া স্বর্ণ জিতে উড়িয়েছেন লাল সবুজের পতাকা।
‘অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছে শিলা, দ্রারিদ্র্য ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তারপরেও থেমে থাকেনি শিলা।’এভাবেই বন্ধুর সাফল্যে আবেগে আপ্লুত হয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে কথাগুলো বলছিলেন শিলার বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছের বন্ধু ও সহপাঠী দিশা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন শিলা।
তার বন্ধু দিশা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পরিবারে তিন বোনের মধ্যে মেজো শিলা, তার আয়ের টাকা দিয়েই বেশীরভাগ সময় সংসার চলতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে অ্যাথলেট ছিলেন। পায়ের ইনজুরির জন্য বেছে নেন সাঁতার। ২০০৩ সালে শিলা ভর্তি হন বিকেএসপিতে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দিশা আরো বলেন, শিলার মতো বন্ধু পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। সে খুব বাস্তববাদী মেয়ে। শিলা কখনোই আবেগের মধ্যে বাস করেন না, বাস্তবটাকে সব সময় মেনে নেন। বন্ধুদের যেকোনো বিপদ আপদেও শিলা সর্বপ্রথমে ছুটে যান। শিলা খুব ঘুরতেও পছন্দ করেন।
শিলার পছন্দের খাবার ডালের বড়া। এমনও দিন গেছে রাতে ওর ডালের বড়া খেতে ইচ্ছে হয়েছে, নিজেই তখন তৈরি করে খেয়েছেন।
দিশা বলেন, অনার্সে পড়ার সময় ক্লাশ করতে শিলার অনেক সমস্যা হতো, তারপরও পরীক্ষার আগে চার পাঁচদিন লেখাপড়া করেও অনেক ভালো রেজাল্ট করতেন শিলা।
দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে দেশের জন্য এমন সাফল্য আনতে পেরে আনন্দে আত্মহারা শিলার মা মোছাম্মত করিমুন্নেছা। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আামি কি বলবো! আমার কোনো ভাষা নেই। এতো কষ্টের মাঝেও আমার মেয়ে দেশের জন্য দু’টি স্বর্ণ অর্জন করেছে তাতে আমার গর্বের শেষ নেই। আমি গর্বিত এমন সন্তানের মা হতে পেরে, এমন সন্তানকে জন্ম দিতে পেরে।
করিমুন্নেছা বলেন, আমি চাই আমার সন্তানের মতো অন্যরাও যেনো দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারে। আমার সন্তানের জন্য সকলের কাছে দোয়া চাই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ শিলার জন্য বিশেষ সংবর্ধনার কথা ভাবছে বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান আলী আর রাজি।
তিনি বলেন, শিলার এমন সাফল্যে বিভাগসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় গর্বিত। সাংবাদিকতার মতো বিষয়ে পড়ালেখা করে, অনেক চাপ নিয়ে এমন সাফল্য সত্যিই কৃতিত্ব দেওয়ার মতো। মাস্টার্সে শিলাকে প্রতিটি ক্লাস করতে হয়েছে, ক্লাশ পরীক্ষা এগুলোর মধ্য দিয়েই ঢাকা-চট্রগ্রাম যাতায়াত করতে হয়েছে।
আলী আর রাজি বলেন, ও সত্যিই সোনার মেয়ে। অনেক অভিনন্দন ও শুকরিয়া শিলার জন্যে।
যশোর জেলার অভয় নগরের নোয়াপাড়ার মেয়ে মাহফুজা শিলা সোমবার পুলে নামার আগেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। মিডিয়ার সামনেই বলেন, ‘আজও কিছু একটা করে দেখাবো।’ সত্যি কিছু একটা করেই দেখালেন । স্বর্ণ জয়ের পর উচ্ছ্বসিত শিলা তার অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে কিছুটা ক্ষোভই প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের প্রতি।
শিলা বলেন, ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং জাতীয় দলের কোরিয়ান কোচ তেগুন পার্কের উৎসাহেই আমি এবারের এসএ গেমসে দেশকে দু’টি স্বর্ণপদক উপহার দিতে পেরেছি। আমার এই সাফল্যে ফেডারেশনের কোনোই অবদান নেই।
‘ফেডারেশন কর্মকর্তারা বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে অবহেলা করে আসছিলেন। তাদের এই অবহেলা এক সময় আমাকে হতাশ করেছে। ভেবেছিলাম সাঁতার ছেড়ে দেবো। কিন্তু কোচ পার্ক ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের উৎসাহ আমাকে সাঁতারে রেখে দিলো। আগ্রহ জন্মালো ভালো কিছু করে দেখানোর। জিদ চেপে গেলো এসএ গেমসে স্বর্ণ জিতবোই। আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন বলে আমি সফলতা পেয়েছি।’
ভারতের গুয়াহাটিতে দ্বাদশ এস এ গেমসে মেয়েদের ১০০ মিটার ও ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে সেরা হয়ে বাংলাদেশের জন্যে দু’টি স্বর্ণ উপহার দিয়েছেন শিলা। ২৫ বছর বয়সী শিলার আগে বাংলাদেশের কোন মহিলা সাঁতারু আন্তর্জাতিক কোনো গেমসে দু’টি স্বর্ণপদক জিততে পারেননি।