বন্ধুদের আড্ডায় স্বর্ণলতার আলাপ উঠতেই সেখান থেকে বের হয়ে আসে মানস। কারণ এই একটা শব্দ সে পছন্দই করতে পারে না। স্বর্ণলতা যদি পরনির্ভরশীল হয়, তাতে দোষের কি। কি সুন্দর লাগে যখন স্বর্ণলতাকে কোন গাছের উপরে দেখে সে। সেই গাছটাই বা তাকে কেন বেড়ে উঠার সুযোগ দিলো। আর কেনই বা স্বর্ণলতার নিজের খাবার তৈরির সুযোগ নেই। এটা তো তার দোষ না! তাহলে কথায় কথায় লোকে পরনির্ভরশীল বলে কেন স্বর্ণলতাকে-তার কোন কারণ খুজে পায় না মানস। মাঝে অনেকের সঙ্গে তর্কে জড়াতো, এখন আর জড়ায় না। সরে আসে। কিন্তু এই স্বর্ণলতার আলোচনা কোথাও উঠলেই আর দাঁড়ায় না মানস।
মানসের বয়স এখন ৪২ বছর। ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রং ফর্সা। শরীরের গড়নও চমৎকার। খুলনা ইউনিভাসিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স। ২০০০ সালে ঢাকায় আসে মানস। এসেই ওঠে বন্ধুর বাসায়। সেই বন্ধুও খুলনার। নিউজ প্রিন্টে কাজ করতো দুজনেরই বাবা। এমন আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকার মিরপুরে একটি মেস ভাড়া নেয় তারা। সেই মেসে থাকে চারজন। মানস, রবিন, মারুফ আর লেলিন। এরা সবাই ছোটবেলার বন্ধু।
মানসের জীবনটাও অদ্ভুত। বাবা নিউজ প্রিন্টে কেমিস্ট হিসেব কাজ করে অবসর নিয়েছেন। মা সেই সময়ের এসএসসি পাশ, এখন গৃহিনী। তিন বোন মানসের। মানসের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে বরিশাল শহরেই এক খণ্ড জমি কিনে বাড়ী বানানোর কাজ শুরু করেছে। দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রতি বছর আদিয়াররা যে অর্থ দিয়ে যায়, তা দিয়ে সংসার চলে। মানসের খালাতো ভাইয়ের বউয়ের সুপারিশে ঢাকায় একটা জব পেয়েছে সে। সেখানেই যোগ দিতে ঢাকায় এসেছে এবার। এসেই উঠেছে বন্ধুদের মেসে। মেসে সবার দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে আসলেও মানসের দায়িত্ব বরাবরই পালন করে মারুফ। মারুফ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা টেলিফোন কোম্পানিতে কাজ করছেন। ভালো আয়। সুতরাং খুশি মনেই মানসের দায়িত্ব নেয় সে। মুখে বলে না, কিন্তু কোন মাসে টাকা না দিলে, তা অনায়াসেই দিয়ে দেয় মারুফ। কোনো কোনো সপ্তাহে যদি বাজারের টাকা মানসের কাছে থাকে এবং সেটা কোন কারণ ছাড়াই দিতে পারে না মানস, সেই সপ্তাহের বাজারটাও হাসিমুখে করে দেয় সে। ঢাকায় বলা চলে মারুফের সহযোগিতায় মাস শুরু হয় মানসের।
নতুন অফিস ধানমন্ডিতে। বাসা মিরপুর -১০ এ। এখানকার বস খুব কড়া। কিন্তু ভাবী এখানে কাজ করেন, তাই ভরসা আর যাই হোক চাকরিটা যাবে না। এই অফিসে ঢুকেই অন্তত দুটো মেয়ে চোখে পড়েছে মানসের। মেয়ে ভাগ্য মানসের বরাবরই ভালো। মেয়েরাই তার প্রেমে পড়ে। এজন্য কাউকে গিয়ে বলতে হয়নি আজ পর্যন্ত। একটু অপেক্ষা করতে হয় শুধু। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
এই অফিসে রিসিপশনিস্টের কাজ করে সেঁজুতি। শ্যামবর্ণ, লম্বায় ৫ফুট ৪ ইঞ্চি হবে। গড়ন স্বাভাবিক, তবে শরীরে কোন চড়াই-উৎড়াই নেই। থাকে ভাইয়ের বাসায়। বাবা-মা নেই। এইচএসসি পাশ করে কাজ করছে। এই মেয়েটা মানসের ভাবীর সহকারীর কাজ করে। সেই সুবাদে মানসের বড়খালার বাড়ীর সবার সাথে তার ভালো সম্পর্ক। অফিস ছাড়াও সেঁজুতির সাথে দেখা হয় বড়খালার বাসাতে। আর একজন দেখতে একটু বয়স বেশি মনে হয়। কিন্তু মানসের চেয়ে দুই বছরের ছোট। কাজ করেন একই প্রতিষ্ঠানে আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে। বাড়ী একটু দূরে উত্তরে। মাথায় কোকড়ানো চুল, ফর্সা রং, তবে একটু বেটে। নাম তপতী। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে বড় সে। কথায়-বার্তায় সেঁজুতির চাইতে ভালো। সাহসী আর পরিশ্রমী। সবচেয়ে বড় গুন হলো, সেঁজুতির চাইতে আয় বেশী।
সেঁজুতি আর তপতী দুজনই ঘুরে ফিরে মানসের পাশে থাকতে চায়। একই অফিসে দুই নারীকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সামাল দিতে হয় মানসকে। সুবিধা একটাই তার বেতনে আর হাত দিতে হয় না। টাকা হাতে নাই এটা বুঝতে পারলেই সেঁজুতিও টাকা গুজে দেয়, তপতীও। সুতরাং বাড়তি টাকায় বাড়তি খরচ করতে একটু দ্বিধা নেই তার, নেই এতটুকু লজ্জাবোধ। বাড়তি খরচ মানেই বাড়তি আয়োজন। আর বাড়তি আয়োজনে ফেন্সির বিকল্প নেই। ফেন্সিডিলকে সে সংক্ষেপে ফেন্সি ডাকে। এটা অবশ্য মারুফ জানে না। ওকে না জানিয়েই ফেন্সিতে আসক্তি তার। শুরু কবে এখন আর মনে পড়ে না। তবে খুলনায় স্কুলে পড়ার সময়ে যে শুরু তা নিশ্চিত সে। তখন অবশ্য ফেন্সি খেতো না। বন্ধুদের সাথে সিগারেট খেতো নিয়মিত। এর এক ফাঁকে আসলো গাঁজা বাবা। পরে এই ফেন্সিতে আসক্তি। এটা কোনমতেই কমে না তার। দিনে দিনে আসক্তি আরো বাড়ে। গাঁজাই নিয়মিত খায় মানস। গাঁজা নিয়মিত খেলেও ফেন্সিডিল তার সবচেয়ে প্রিয়। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে থাকে। স্বর্গের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মুহুর্তেই। এসবের খরচ তো আর মারুফের কাছ থেকে বা বাড়ী থেকে নেয়া যাবে না। তাই সেঁজুতি বা তপতীর কাছে টাকা নিতে লজ্জা পায় না মানস। বরং কোন মাসে না দিলে ভাবতে থাকে কিভাবে চাইবে? তাই বলে অতটা নির্লজ্জ নয় মানস।
প্রত্যেক মাসে বোনের অসুখ বা ভাইয়ের পরীক্ষা কিংবা মায়ের অসুধ কেনার কথা বলে টাকাগুলো তাকে পেতে হয়। এজন্য কত অলীক গল্পই না বলতে হয় মানসকে। একটু কান্নাভেজা চোখ, সারাদিন গোমড়া মুখে থাকা। দুপুরের খাবার না খাওয়া, ব্যস। এর মধ্যেই সেঁজুতি এবং তপতী দুজনেরই চোখে পড়ে যাবে মানস। এক অফিস হওয়ায় এই সুবিধাটা পেয়েছে সে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় সহজেই। তবে দুজনকেই সমান সময়ও দিতে হয় মানসকে। এই সময় দিতে গিয়ে মাঝে মাঝেই বিড়ম্বনায় পড়ে মানস। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা শুরু হলো তখন, যখন মারুফ তার বোনকে বিয়ে করতে চাইলো। বিয়েও ঠিক। এবার তো মারুফ আলাদা বাসায় থাকবে, কিন্তু মানসের কি হবে? সে তো এই মেসে অন্যদের সঙ্গে থাকতে পারবে না। এদিকে, আবার সেঁজুতি চাপ দিচ্ছে ওর ভাইয়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য। আর তপতী চাপ দিচ্ছে লিভ টুগেদার এর জন্য। বিয়ে এখনই নয়, পড়ে। তপতীর এর আগেও দুবার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু সেই দুই সংসার টেকেনি। একবার নাকি গণধর্ষনের জন্য তুলে নিয়ে গিয়েছিল দস্যুরা। তপতী অবশ্য বলে কিছু করতে পারেনি তারা। তবুও ঘটনা তো ঘটনাই। তপতীর এই একটা গুন মানসের ভালো লাগে, সেটা হলো সত্যকথন। মেয়েটা অনায়াসে সত্য বলে। গোপন করে না কোন কিছু। তপতীর আরো একটা ঝামেলাহীন দিক আছে, অভিভাবককে সামলাতে হবে না। ওটা ওই সামলাতে পারবে। তাছাড়া, নগদ ৫ লাখ টাকা দিতে পারবে মানসকে- এটা বলেছে সে। এই টাকা মানসের পরিবারের জন্য লাগবে। বাড়ী বানানোর কাজকে অনেকটা এগিয়ে দেবে। এমনিতেই বড় ছেলে হিসেবে কিছুই করতে পারছে না সে। এই টাকাটাও একটা বড় দ্বিধা মানসের। লোভও।
অন্যদিকে, সেঁজুতির আগে বিয়ে হয়নি। ও চাইছে পরিবারের সবাইকে জানিয়ে বিয়েটা সারতে। মানে খরচ। লাখ লাখ টাকার খরচ। অথচ এই মুহূর্তে এক টাকা খরচ করার সম্ভব নয়। ছোট বোনের বিয়েতে তো খরচ হচ্ছে। এমন সময়ে নিজের বিয়ের কথা বাবা-মা’কেই বা বলবে কিভাবে? তার ওপর বাবা-মা বাড়ি বানাচ্ছেন। কিন্তু বউ হিসেবে মনে হয় সেঁজুতি তপতীর চেয়ে ভালো হবে-এমনটাও মনে করে মানস। বুঝেও কিছু করার নেই মানসের, করতে পারছে না আসলে। তপতীর আন্তরিকতাতেও কমতি নেই। যেদিন ছোট বোনের বিয়ের জন্য যাবে, সেদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকার কেনাকাটা করে দেয় তপতী। যাবার সময় বাসে উঠতে গিয়ে বিদায় নেয়ার সময় অবাক হয় মানস।
– আপনি নামবেন না? নামার তো সময় হয়ে গেলো, গাড়ী তো ছেড়ে দেবে? তপতীকে তখনও আপনি ডাকে মানস।
-না, আমিও যাবো। কাল সকালের গাড়ীতে আবার ঢাকা ফিরে আসবো।
-পাগল নাকি, এটা কেউ করে?
-হ্যাঁ , আমি করি। করতে পারি। আমি কোন কথা শুনবো না বললো তপতী।
সেই রাতে সত্যিই তপতী গিয়েছিলো খুলনা। ভোর ৫ টার দিকে নামিয়ে দিলো সোহাগ পরিবহন। কিন্তু ফিরতি বাস তো সকাল ৯টায়। এতোক্ষণ মেয়েটাকে একা রেখে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিলো না মানসের। মুখে কিছুই বলছে না সে। শুধু পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তপতীই বলল, চলো আশে-পাশের কোন একটা হোটেলে উঠি। ফ্রেশ হই, তারপর ফিরে যাবো। সব খরচ আমার। তপতীর এই প্রস্তাব মেনে নিলো মানস। পাশেই একটা হোটেলে উঠলো। রুমে আর কেউ নেই। তপতী বেডে শুয়ে, সুন্দর সবুজ একটা জামা পড়েছে। পাশে বসে আছে মানস। সব ছাপিয়ে তপতীর সুডোল স্তনের দিকে চোখ আটকে আছে মানসের। তপতী কি নির্বিকার। একটা পরপুরুষের সামনে সে দিব্যি শুয়ে আছে। মানস ভেতরে ভেতরে জ্বলে যাচ্ছে। মানসের খুব ইচ্ছে করছে একবার একটু স্পর্শ করার। মানসও নিরীহ’র মতো পাশে শুয়ে পড়ে। মুখে কিছুই বলে না। তপতীই এগিয়ে আসে। মানসের হাতটা হাতে নেয়, হাতটা নিয়ে গিয়ে ঠিক নাভীর ওপরে রাখে। এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না মানস। তপতীকে একটানে বুকের ভেতর নিয়ে আসে। মনে হয় পিষে ফেলবে। ফেলেও। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় তপতীকে। মাত্র কয়েক মিনিটের ঝড়েই মানস শেষ। এখন তপতীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চূড়ান্ত কিছু করার অনুমতি কি দেবে মেয়েটা। ভেবে পাচ্ছে না। কারণ এই ঝড়ে যতবার ওই মোয়েনাক পর্বত (তপতীর স্তন) স্পর্শ করতে গেছে ততবারই সযতনে হাতটাকে থামিয়ে দিয়েছে তপতী। তাই একটু বিরতি দিলো তাপস। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলো। এসে দ্যাখে তপতীও উঠে বসেছে। চুল আচড়াচ্ছে। বের হওয়ার প্রস্তুতি। মেয়েটা কিভাবে স্থির হয়ে আছে। ওর কি কিছুই হলো না? এমন নানান কথা ভাবছে তাপস। তপতীর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে কোন ঝড় বয়ে গেছে কি না? মুখ দেখে না বুঝলেও মানস ঠিকই টের পেলো। তপতী বলল, একটু ওয়াশরুমে আমাকেও যেতে হবে। মাথাটা ঘুরছে। তপতী চলে গেলো ওয়াশরুমে। কিন্তু ঠিক যে যায়গাটায় তপতী বসে ছিলো, সেখানটা গোল করে ভিজে আছে বিছানা। মানে তপতীর মধ্যেও শারিরীক একটা পরিবর্তন হয়েছে। খুশী হলো মনে মনে। কিন্তু মুখে সেও গম্ভীর ভাবটা ধরে রাখলো।
তপতী আর মানস বের হলো। গন্তব্য ঢাকায় ফিরবে তপতী আর মানস যাবে বোনের বিয়েতে। হলোও তাই। কেউ কোন কথাই বলল না মুখে, কিন্তু একরাশ যৌনাকাঙ্খা অন্তর জুড়ে দুজনের। খুলনায় যে কয়েকদিন থাকলো মানস প্রত্যেকদিন, কতবার যে তপতী ফোন দিয়েছে তার হিসেব নেই। ফোন ধরতে খারাপ লাগেনি মানসের। এমনকি ৩০০ টাকার গ্রামীন কার্ড নাম্বারও ম্যাসেজ করে পাঠিয়েছে তপতী। খুলনা থেকে ফিরে এক রাতও দেরী করেনি তপতী আর মানস। ছুটে গেছে একে অপরের কাছে। এবার তারা মিলিত হতেই মিলিত হয়েছে। পরিকল্পনা করে শ্যামলীর একটি হোটেলে উঠলো দুজন। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। ওই মাসেই মিরপুর ১০ এ ২৫০০ টাকা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া করে নিয়ে উঠলো মানস আর তপতী। মানসের বাসার কেউ জানলো না। কিন্তু তপতী তার বাড়ীর সবাইকে জানালো যে, সে বিয়ে করেছে। সুবিধা হলো কেউ কাজী অফিসের কাগজ দেখতে চায় নি। এক বাসাতেই থাকে মানস আর তপতী। অফিসের কেউ জানে না। কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে মানসকে নিয়ে বাড়ীও ঘুরে আসলো তপতী। তপতীর পরিবার নিশ্চিত হলো, তপতী আবারো সংসারী হয়েছে।
অন্যদিকে, অফিসে মানসের কাজে খুশি নন অফিসের বড় কর্তা। তিনি কড়া আদেশ দিলেন, এমন হলে চাকরি থাকবে না মানসের। শেষ মেষ চাকরিটা হুট করে ছেড়েই দিলো মানস। তপতী তখনও কাজ করছে। মায়ের নামের একটা জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ৫ লাখ টাকাও এনে দিয়েছে মানসকে। সেই টাকা নিয়ে সে তার বাবা-মাকেও দিয়ে এসেছে। সংসারের সবটাই চলে তপতীর আয়ে। বাড়ী ভাড়া, খাবার খরচ, এমনকি যাতায়াতও। প্রায় ৬ মাস পর সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ পায় তাপস। করেও কিছুদিন। অনিয়মিত অফিস করা, আর নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন না করার অভিযোগে সেখান থেকেও তাকে বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ। আরো একটা কারণ অবশ্য বলে মানস, সেটা হলো সেখানকার রিসিপশনিস্ট মায়া। ওর কারণেই নাকি আর অফিসে যেতে ভালো লাগে না মানসের-এটা সে তপতীকে জানায়।
এর মধ্যে তপতীও এনজিও চাকরি ছেড়ে দেয়। যোগ দেন একটি দৈনিক পত্রিকায়। সেই আয় দিয়েই চলে সংসার। অথচ বিয়ে করেনি তারা। দুই বছর পর বন্ধু মারুফের চাপে বিয়েতে রাজী হয় মানস। মাঝে ঘটে যায় বহু ঘটনা। কেটে যায় ১২ বছর। এর মধ্যে প্রায় ১০টি কর্মস্থল পরিবর্তন করেছে মানস। কোনটিই ৩ থেকে ৬ মাসের বেশি টেকেনি। বিয়ের আগে পর্যন্ত মানসের নেশাগ্রস্থতার কথা জানতে পারেনি তপতী। যেমন জানতে পারেনি মারুফও। ঘরের মধ্যে উদ্ভট গন্ধের কারণে একটা সময় তপতী টের পায়। এমন উদ্ভট গন্ধের সাথে পরিচয় নেই তপতীর। পরে বুঝতে পারে—এটাই হলো মানসের একমাত্র প্রেম, আসক্তি। বুঝতে পেরে ৪ বার মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করায় তপতী। নিজের আয় করা অর্থ ব্যয় করে মানসকে শোধরানোর জন্য, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু মানস কোনভাবেই পরিবর্তন হয় না। মাকাল ফলের উদাহরণ হয়ে ধরা দেয় তপতীর কাছে। এই ১২ বছরের ৩টি শাড়ী আর এক জোড়া চুড়ি ছাড়া কিছু দেয় নি তপতীকে মানস।
তপতী অফিসে যায়, আর মানস কোল বালিশ বুকে নিয়ে দিনভর ঘুমায়। সন্ধ্যার পর বের হয়, আবার গভীর রাতে ফেন্সিডিল খেয়ে বাসায় ফেরে। এটা তার নিয়মিত রুটিন। তপতী বাধা দিলে তাকে ইদানিং আঘাতও করে সে। কিন্তু একদিনের ঘটনায় বদলে গেলো তপতীর মন। সেদিনের কথা আজো মনে আছে মানসের। তপতী অফিসে গেছে। বাসায় এসেছেন তপতীর মাসীমা। তপতী বলেছিল, এই মাসীর কাছেই বড় হয়েছে সে। কিন্তু হঠাৎ কি যে হলো, এখন কিছুই মনে পড়ে না মানসের। কিন্তু সেই মাসীকেই অনাকাঙ্খিত এক আহ্বান জানিয়ে বসলো মানস। সেই থেকে শুরু হলো তপতীর কথা বলা। এর আগে পর্যন্ত অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিলো মানসের। এই ঘটনার পর আর তপতীর বাধ রইলো না। কথায় কথায় টিপ্পনী শুরু করে দেয়, বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলে। অসম্ভব মেধাবী, দারুণ সুদর্শন এই মানসকে প্রতিদিন স্বর্ণলতা, পরজীবী- টাইপের কটুক্তি করে। এমনকি টাকা পয়সাও এখন আর বাসায় রাখে না তপতী, দিতেও চায় না। এটিএম কার্ড নিয়ে ঘোরে। এখনও যে মানসের প্রতিদিন টাকা লাগে এটা বুঝেও কোন অর্থ দিতে রাজী নয় তপতী। খাওয়া ও থাকা নিয়ে কোন সমস্যা না হলেও হাত খরচ কোথা থেকে পাবে-এটা বুঝতেই চায় না তপতী-এই আচরণকে অন্যায় মনে করে মানস। আর ভাবে সবাইকে দিয়ে কি চাকরি হয়? কেউ কেউ জন্মই নেয় কাজ না করার জন্য-যেমন মানস নিজে।
কিন্তু টাকা তো তার চাই চাই। একদিন সুযোগ পেলো সে। তপতীর এটিএম কার্ড কি করে যেনো বাসাতেই ফেলে যায়। কার্ডটা চোখে পড়ে মানসের। আর মানস জানে তপতীর কার্ডের পাসওয়ার্ড কি? কার্ড হাতে পেয়েই বুথে এক দৌড়। প্রয়োজনীয় অর্থ তুলে নিয়ে কার্ড এনে রেখে দিলো যথাস্থানে। তারপর একদম গোবেচারা ভাব। কোন কিছুই জানে না যেন। যা হবার তাই হলো, তপতী কার্ড বিষয়ে জানতে চাইলে-ঝাড়া অস্বীকার করে মানস। কিন্তু তপতীও কম যায় না, ৭ দিন পর এটিএম বুথে মানসের টাকা তোলার ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে এসে সামনে রাখে। এবার আর না করার কোনো উপায় থাকে না মানসের। এমন ছোটো ছোটো অনেক ঘটনার ঘটঘটায় কেটে যায় ১২ বছর। তপতী আর মানসের সম্পর্ক খারাপ থেকে অতি খারাপ হয়।
এই এতটা বছরে কোনো কাজেই থিতু হতে পারে না মানস। সে নিজেও বোঝে না…কেন তার কাজ করতে ইচ্ছে করে না। ভোরের ঘুমটা কিছুতেই ভাঙ্গতে চায় না কেন? যত যাই হোক তপতী মানসকে ছাড়বে না- এই বিশ্বাস ছিলো মানসের। এমনিতেই তপতীর আগেই দুইবার তালাক হয়েছে। আবার বয়সও তো হয়েছে। মানসকে ছাড়লে তৃতীয়বার তালাকপ্রাপ্ত হবে মেয়েটি। এই ঝুঁকিটা কখনই তপতী নেবে না ভেবেছিলো মানস। তাই অনেকটাই নির্ভার ছিলো। যত কথাই বলুক না কেন, সমাজের ভয়ে হলেও মানসের সংসারই করতে বাধ্য সে। আর যাবে কোথায়? কিন্তু মানসের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ১২ বছর পর তাকে তালাক দিয়েছে তপতী। এখন তপতী আর মানস আলাদা থাকে।
কি থেকে কি হয়ে গেলো, কিছুই ভেবে পায় না মানস। তবুও যা হবার হয়েছে, পুরোনোকে আকড়ে থাকার মানুষ মানস নয়। বেঁচে থাকতে যা করার তা সে ঠিকই করবে। করেছেও তাই। এতে কোনো ভুল হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতে বন্ধুদের কাছ থেকে নতুন বাসার কাছে চলে আসে মানস। দরজায় নক করে। ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় সেঁজুতি।