আবহমান গ্রাম বাংলার আলো বাতাসে আমাদের বেড়ে ওঠা। ফজরের আযানে আমাদের ঘুম ভাঙে। আমরা দুভাই উঠতে একটু গড়িমসি করলেও পাশের বাড়ির সালাম এসে ডাকাডাকি শুরু করলে আমাদের উঠতেই হতো। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই মসজিদে যেতে হতো। উঠে ওজু করে আমরা তিনজন একসাথে দৌড় দিতাম। মসজিদের নামাজ শেষ করে বাইরে আসতে আসতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করতো।
বাইরে এসে বিদ্যুৎ আর শংকরকে ডেকে নিয়ে আমরা চলে যেতাম মাঠে। আমাদের পাড়া থেকে একটা রাস্তা মাঠে ঢুকে বেশ কিছুদূর যেয়ে বটগাছের তলায় তেমাথায় মিলিত হয়ে আবার মন্ডল পাড়া দিয়ে ফিরে এসেছে। আর গ্রামের এবং মাঠের ধার ঘেঁষে চলে গেছে গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের একটা সরু খাল। সেটার ধার দিয়েও পায়ে হাটা পথ আছে। এই দুই রাস্তা আর খালের পার মিলিয়ে একটা ত্রিভুজের আকার নিয়ে আছে। আমরা বটগাছ পর্যন্ত যেয়ে মন্ডল পাড়া দিয়ে ফিরে আসতাম। কখনও বা তাড়া থাকলে মন্ডল পাড়ায় না ঢুকে খালের পার দিয়ে ফিরে আসতাম। কুষ্টিয়াতে যতদিন ছিলাম বা ছুটিতে যখনই বাড়ি যেতাম এটাই আমাদের নিত্যদিনের রুটিন ছিলো।
কখনও ভোরবেলা দাঁতন হাতে নিয়ে রাস্তার পাশের শিশিরে পা ডুবিয়ে হাটা হতো যেদিন মাঠে যাওয়া হতো না। কে যেন বলেছিলো ভোরবেলা শিশিরে পা ডুবিয়ে হাঁটলে বুদ্ধি বাড়ে তারপর থেকেই এই ব্যবস্থা। শীতকালে মাঠ থেকে ফেরার সময় আমাদের পাড়ার আব্বাস কাকুর বাসায় যাওয়া পড়তো প্রায় নিয়মিতই। আব্বাস কাকু সারা বছর ব্যাপী বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শীতকাল আসলেই উনি পাড়ার সব খেজুরের গাছ কেটে হাড়ি বসিয়ে দেন। সারারাত যে রস জমা হয় ভোরবেলা সেই রস বাঁকে করে কাঁধে নিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা দিয়ে দেন। আমরা বলে আসতাম যেন আমাদের জন্য এক হাড়ি রস আলাদা করে রাখেন। উনি শহরের যাওয়ার সময় আমাদের বাড়িতে সেই হাড়িটা নামিয়ে দিয়ে যান। এরপর আমরা দলবল নিয়ে সেই রস খায়।
সারাদিন যে যার কাজ শেষ করে দিনশেষে আবার আমাদের দেখা হতো। আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে একইভাবে দলবল নিয়ে আবারো মাঠে যাওয়া। এইবার আড্ডা চলতো মাগরিবের নামাজের আগে পর্যন্ত। আমাদের তখন ঘড়ি ছিলো না আর মোবাইলের চলও শুরু হয়নি। পাড়ার হিন্দু বাড়িগুলোতে সন্ধ্যায় শাঁখ বেজে উঠলেই আমরা বুঝতে পারতাম একটু পরে মাগরিবের আযান দিবে। আমরা দ্রুত পা চালিয়ে মসজিদে যেতাম আর বিদ্যুৎ, শংকর বাড়ি ফিরে যেতো। খুব কম দিনই এই রুটিনের ব্যাত্যয় হয়েছে।
এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা চলে আসা। কিন্তু প্রথম প্রথম ঢাকায় মন টিকতো না। আমার মনেআছে শুরুর দিকে আমি আর বন্ধু সানজাদ প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর বাড়ি যেতাম। বৃস্পতিবার ক্লাস শেষ করে কল্যাণপুর যেয়ে বাসে উঠে পড়তাম আবার শুক্রবার এবং শনিবার কুষ্টিয়া কাটিয়ে শনিবার রাত্রে ঢাকা ফিরে আসতাম। অবধারিতভাবেই আমাদের সিট হতো বাসের একদম পেছনের সারিতে। বাসের পেছনের সারিতে এমন ঝাকুনি হয় যে শরীরের হাড় মাংশ আলাদা হবার জোগাড় হয় কিন্তু আমি আর সানজাদ সামনের সিটের পেছনের পকেটের মধ্যে পা তুলে দিয়ে রীতিমতো ঘুম দিতাম।
এরপর সময়ের সাথে সাথে বাড়ি যাওয়া কমে আসলো। তবুও যতদিন ক্যাম্পাসে ছিলাম ছুটি পেলেই বাড়িতে ছুট দিতাম আমরা। চাকুরী শুরু করার পর বাড়ি যাওয়া একটু বেড়ে গেলো। টেলিকম কোম্পানির চাকুরীতে সপ্তাহের পুরো সময়টায় ঢাকার বাইরে বাইরে কাটাতে হতো। আমার বাড়ি যেহেতু কুষ্টিয়াতে অফিস থেকে আমাকে কুষ্টিয়ার আশেপাশে সাইট দিতো যাতে বাড়িতে থাকতে পারি। এরপর একসময় বিয়ে করে ঢাকতেই থিতু হতে হলো। কিন্তু তখনও অন্ততপক্ষে দুই ঈদে বাড়িতে যাওয়া হতো। আর বাড়িতে গেলেই আমরা সবাই মিলে সেই পুরোনো রুটিনে ফিরে যেতাম। শেষবার বাড়ি গিয়েছিলাম বাংলাদেশ ছাড়ার আগে। সেবারের বেড়ানোটা এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
এমন একটা ঘরকুণো মন নিয়ে আমি দেশান্তরী হলাম সেই ২০১৫ সালে। এরপর ছয়টা বছর কেটে গেছে। এই প্রথম কুষ্টিয়া ফেলে এতোটা সময় দূরে আছি। দিনশেষে পাখি যেমন নীড়ে ফেরে ঠিক তেমনি সারাবছর দেশের যেখানেই থাকতাম না কেন উৎসবের দিনগুলোতে কুষ্টিয়া ফিরে যেতাম। ঠিক কিসের টানে ফিরতাম সেটা জানি না কিন্তু ফিরতে হবে সেটা জানতাম। গত ছয়টা বছর আমি আসলে বাংলাদেশকে ঠিক কতটা মিস করেছি সেটা পরিমাপ করার কোন বাটখারা আমার কাছে নেই। তবে আমি যেটা চেষ্টা করেছি আমাদের শৈশব কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলো আমাদের সন্তানদের মধ্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। এতে দুইটা কাজ হয়েছে। প্রথমত ওরা সামান্যতেই আনন্দ পেতে শিখে গেছে আর দ্বিতীয়ত আমি ওদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি আমার ফেলে আসা দেশের স্মৃতি।
গিন্নী এবং সন্তানেরা ইতোমধ্যেই বেশকবার দেশ থেকে ঘুরে আসলেও নানান ঝামেলায় আমার যাওয়া হয়ে উঠছিলো না। অবশেষে করোনার আঘাত হানার আগে আগেই গতবছর আমরা টিকেট করেছিলাম ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার কিন্তু করোনা এসে সব উলটপালট করে দিলো। এ বছর করোনার প্রকোপ কমে আসলে এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা বললঃ আমাদের নতুন করে টিকেট করা লাগবে না। তারাই টিকেট নবায়নের জন্য আবেদন করবে। এরপর কেটে গেছে তিন সপ্তাহ। এই তিন সপ্তাহ আমার কাছে অনেক দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছে। এই তিন সপ্তাহে আমার জীবনে এসেছে কিছু মৌলিক পরিবর্তন।
অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাপনে এমনিতেই আমাকে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সাধারণত মোবাইলের এলার্ম ডেকে দেয়ার কাজটা করে। কিন্তু টিকিন নবায়নের আবেদনের পর থেকেই আর ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক। রাত্রে এলার্ম বাজার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে যায়। এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ থাকে না। অনেক সময় ঘড়ি দেখে তড়িঘড়ি উঠে সব কাজ শেষ করে দেখি তখনো এলার্ম বাজে নাই। পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমি মিনিটের কাটা দেখে উঠে পড়েছিলাম। মিনিটের কাটা ঠিকই ছিলো কিন্তু ঘন্টার কাটা ছিলো ঘন্টা পেছনে। ভোরের পাখির কিচিরমিচির শুনে ঘুম ভেঙে যায় ঠিক যেভাবে কুষ্টিয়াতে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতো।
আমাদের অফিসটা একেবারে বোটানি বে’র পাশেই। একপাশে বোটানি বে অন্যপাশে এয়ারপোর্ট। আমার ডেস্কটা তিনতলায় হওয়াতে এয়ারপোর্টে বিমানের আনাগোনা দেখা যায়। করোনার পুরো সময়টা আকাশটাকে ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। এখন আবার সুঁইচোরা পাখির মতো বিমানগুলো উড়াউড়ি শুরু করেছে। এছাড়াও এম ৫ রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়ার পথে সিডনি এয়ারপোর্টের বিমানগুলোকে দেখি আর মনেমনে ভাবি কবে আমাকে নিয়ে বিমানটা উড়াল দিবে। এম ৫ রাস্তায় ছোট বড় মিলিয়ে তিনটা টানেল আছে। অফিস থেকে ফেরার মুখে প্রথম যে টানেলটা পড়ে সেটা আসলে বিমান ওঠানামার বর্ধিত জায়গা। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলাম সেই টানেলের উপর একটা বিমান টেক অফ করতেছে। দেখে খুবই ভালো লাগছিলো।
বাংলাদেশে কোন এক ঈদের আগে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানী একটা গানের মর্মস্পর্শী ভিডিওচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। গানের কথাগুলোর সাথে ভিডিওচিত্রটার মানুষদের অভিনয় আমাদের মনপ্রাণ ছুঁয়ে গিয়েছিলো। উৎসব সামনে রেখে গ্রামের বাড়িতে ফেলে আসা স্বজনের কাছে ফেরার আকুতি ছিলো গানের বিষয়। কেউ ফিরছেন ট্রেনে, কেউবা বাসে আবার কেউবা লঞ্চ, ফেরিতে। এতো কষ্ট করে প্রিয়জনের কাছে পৌঁছানোর পর ছিলো আনন্দের বাধভাঙ্গা প্রকাশ। এভাবেই যুগযুগ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষ উৎসবের দিনগুলোতে একত্রিত হয় পরিবার পরিজনের সাথে। ভাগ করে নেয় উৎসবের আনন্দ। এমনকি করোনার এই কড়াকড়ির সময়েও সব পরিবহন বন্ধ রেখে মানুষকে আটকে রাখা যায়নি। এই অনুভূতি শুধুমাত্র তারাই বুঝবেন যারা প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য দিনের পর দিন তাদের থেকে দূরে থাকেন।
টিকেট নবায়নের আবেদনের পর থেকে আমরা বাসার টিভিতে ইউটিউবে সেই গানটা বাজিয়ে যাচ্ছি। এক দুবার দেখার পর আমাদের ছেলে পাঁচ বছরের রায়ান নিজে থেকেই সেই গানটা দেখা শুরু করেছে। বাসার টিভি বেশিরভাগ সময় তার নিয়ন্ত্রণে থাকে তাই আমাদেরকে সেই প্রোগ্রামই দেখতে হয় যেটা সে দেখে। এই গান ছেড়ে দিয়েই সে ডাকা শুরু করে বাবা, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। এই গানটা যতবারই দেখি ততবারই সেই ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া ফেরার স্মৃতি মনের মধ্যে ভীড় করে। আসলে মাতৃভূমির সাথে মানুষে টানটা এমনই। সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থান করুক না কেন সে এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়ে থাকে মাতৃভূমির সাথে।
মা, মাটি, মাতৃভূমির প্রতি মানুষের এই টান একেবারে সেই সৃষ্টির আদি থেকে। কারণ আমরা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার আগে মায়ের উদরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকি। তাই পৃথিবীর যেখানেই যায় না কেন আমরা যেমন মাকে ভুলে যায় না ঠিক তেমনি ভুলে যায় না নিজ মাতৃভূমিকে। আর যতদিন ফিরতে না পারি ততদিন ফেরার প্রহর গুণী আর মনেমনে গেয়ে চলি -`মন বলে চল ফিরে আবার, স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’।