স্বপ্ন তার বিশ্বসেরা হওয়ার। ফ্রেঞ্চ লিগে সেরকম খেলছেনও। বার্সার সময়েও নাম্বার ওয়ান হওয়ার সব গুণ তার ছিল। কিন্তু এই দিনগুলোতে ফ্রেঞ্চ লিগের বাইরে নেইমার পা রাখলেই বাস্তবতা ফুটে উঠছে। ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার সেটা ঠাওর করতে পারছেন না বলেই মনে হচ্ছে। না হলে অমন উদ্যম আর খেয়ালি জীবনে কেন পা বাড়াবেন!
গত সপ্তায় ২৬তম জন্মদিনে পার্টি দিয়েছিলেন। তাতে প্যারিস সেন্ট জার্মেইনের (পিএসজি) সতীর্থদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, আরো স্পষ্ট করে বললে অন্যান্য ফুটবলার যারা নেইমারের ‘প্রজেক্টে’র পক্ষে কাজ করে। ওই রাতের পর বেশিরভাগ খেলোয়াড় ক্যাম্পে ফিরে আসেন এবং অনুশীলনে অংশ নেন, পরের ম্যাচ খেলার জন্য। কিন্তু সেখানে নেইমার ছিলেন না। ওজর দেখিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেন!
২২২ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফার রেকর্ড গড়ে বার্সেলোনা থেকে পিএসজিতে আসার পর নেইমার যেসব অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তার একটি উদাহরণ এটি। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে পেনাল্টি শট নিয়ে ঘটে যাওয়া বিতর্ক। তার আগে থেকেই পেনাল্টি শটের দায়িত্ব পালন করা এডিনসন কাভানির সঙ্গে রীতিমত ইগো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কোচ উনাই এমেরির হস্তক্ষেপে পরে কিছুটা শান্ত হয় পরিবেশ।
আর এল পায়াস পত্রিকা খবর দিয়েছিল, পিএসজির খেলোয়াড়দের একটি নির্দিষ্ট গ্রুপকে নিয়ে ভিডিও অ্যানালাইসিস অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে। যার মূলেও ছিলেন ব্রাজিলিয়ান বিস্ময় বালক।
পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই বলছেন, শুধু এমেরি নয়, নেইমারকে নিয়ন্ত্রণ করতে অন্য যেকোনো কোচেরই ঘাম ছুটবে। যতক্ষণ না তিনি নিজে সরছেন, ততক্ষণ কেউই তাকে স্কোয়াড থেকে বাদ দেয়ার রাস্তা পাবে না। তাকে শৃঙ্খলায় ফেরানোর কোনো রাস্তাও পাবে না অন্যরা। কারণ পিএসজির মালিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তার। নেইমারকে দলে ভেড়াতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে সুখী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাতারি মালিক।
তবে নেইমার এবং এমেরির একটি কাজ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করছে, তার একটা উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সেটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করা।
পিএসজি হয়তো লিগ ওয়ানের শিরোপা বেশ সহজেই জিতবে। তারা হয়তো ফরাসি ট্রেবলও (ফ্রান্সের মূল তিন শিরোপা) জিততে পারে। তার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে কাতারের অর্থ। কিন্তু পিএসজি এর চেয়েও বড় কিছু চায়।
দলটির স্কোয়াড প্রতিভায় ঠাসা। তাদের প্রথম একাদশ সম্ভবত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে যাওয়ার আশা করে এমন দলগুলোর সমতুল্য। কিন্তু পিএসজির সমস্যা হল যে, বারবার তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যখন এমন একটি দলের সামনাসামনি হয়। যেমনটা হয়ে গেল রিয়ালের বিপক্ষে শেষ ষোলোর প্রথম লেগে। ধুঁকতে থাকা রিয়ালের বিপক্ষে তারা খড়কুটোর মতো উড়ে গেল ৩-১ গোলে।
বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপেও একই অবস্থা। প্যারিসে বায়ার্নকে প্রথম হারিয়ে দেয় পিএসজি। তাতে চাকরি যায় বাভারিয়ান কোচ কার্লো আনচেলেত্তির। ফিরতি ম্যাচে নিজেদের মোটেও তুলে ধরতে পারেনি পিএসজি।
চলতি বছরের শুরুতে পিএসজি দুরন্ত ফর্ম নিয়ে লিঁও’র মুখোমুখি হয়, কিন্তু অনেকটা আচমকভাবে হেরে যায়। লিঁও শুধু ইউরোপিয়ান ফুটবলে নয়, ফরাসি ফুটবলেও এমন কোনো দল নয় যে, যাদের বিরুদ্ধে পিএসজি ছড়ি ঘোরাতে না পারার আশা করে। কিন্তু সেখানে তারা ভুগেছে।
ওই ম্যাচে নেইমার খেলেননি। যদিও আগের ম্যাচে ৮-০ গোলে জেতার দিনে একাই চার গোল করেছিলেন নেইমার। ফুটবলের সবচেয়ে নিখুঁত খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে, যেখানে তাকে ছাড়াও দল চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে।
রিয়ালের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ পিএসজির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পিএসজির সঙ্গে কোচ উনাই এমেরির ভবিষ্যৎ এবং সেই সঙ্গে সম্ভবত নেইমারের পুরো প্যারিসীয় লেগাসির হিসাব-কিতাব। কিন্তু বার্নাব্যুতে নেইমার নিজে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সঙ্গে দল ব্যর্থ হওয়ায় প্রথম লেগ সেই পথে বিশাল ধাক্কা খেয়েছে। এই ধাক্কা কোথায় গিয়ে ঠেকে এখন তা নিয়েই শুরু হয়ে গেছে চর্চা।
স্বপ্নের রাজ্যে নেইমারকে নিজের ঘুম ভাঙাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, সপ্তাহে ৭ লাখ ইউরো বেতন নিয়ে ইউরোপ সেরাদের বিরুদ্ধে পার্থক্য গড়তে তিনি সক্ষম। তাকে এটাও প্রমাণ করতে হবে যে, তাকে দলে নেয়া হয়েছে শুধু ফ্রেঞ্চ লিগে গোল করার জন্যে নয়।
কোনো সন্দেহ নেই যে, নিজের মাঠে নেইমারকে চোখে চোখে রেখেছে রিয়াল মাদ্রিদ। বার্নাব্যু সেই স্টেডিয়াম যেটাকে নেইমারের নিজের মাঠ বলে অনেকবারই ভেবেছে লস ব্লাঙ্কোসরা। অবশ্য তিনি নিজেও। কিশোর বয়সে এই মাঠে তিনি অনুশীলন করেছেন। কিন্তু ২০১৩তে তার ইউরোপ যাত্রায় রিয়ালকে রীতিমত হতভম্ব করে দলে নেয় বার্সেলোনা।
তবে অনেকেরই বিশ্বাস নেইমার একদিন রিয়ালের বিখ্যাত সাদা জার্সি গায়ে তুলবেন। দুদিন আগেই তার জাতীয় দলের সতীর্থ মার্সেলোও এমন কথা বলেছেন। কিন্তু বার্নাব্যু হল বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে চাহিদা সম্পন্ন রণক্ষেত্র।
পিএসজিতে নেইমার থাকেন রাজার হালে। যা প্রায় সবাই মেনে নিয়েছে। তার উদ্দাম জীবন-যাপনও আলো ছড়াচ্ছে প্যারিসে। কিন্তু যে আশায় এবং স্বপ্ন নিয়ে তিনি ফ্যাশনের শহরে পা রেখেছেন তাতে ওই ঝাড়বাতির জীবন সব এলোমেলো করে দিবে বলেই মনে হচ্ছে। দূর আকাশের তারা হয়ে যেতে পারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় এবং ব্যালন ডি অর জেতার সাধ।