চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ফিরে আসুন স্বপ্নদেখানো পুরুষ

স্বপ্ন দেখা সহজ। কিন্তু দেখানো কঠিন। সরাসরি রাজনীতিবিদ না হয়েও যিনি একটি নতুন ঢাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নাগরিকদের, তিনি এখন গভীর ঘুমে। অনেকদিন ধরেই নিশ্চুপ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তার অবস্থা এখনও স্থিতিশীল। আশা করা হচ্ছে, তিনি ধীরে ধীরে জেগে উঠবেন, ওষুধে সাড়া দেবেন। এ এক অদ্ভুত অসুখ।

মস্তিষ্কের রক্তনালীর প্রদাহ বা সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ১৩ আগস্ট থেকে লন্ডনের একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক। শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রতিদিনই তার ফিরে আসার প্রত্যাশা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। প্রার্থনা করছেন। মানুষকে স্বপ্ন দেখানো এই মানুষটি নিজেই এখন এক গভীর স্বপ্নের জগতে।

গত বছরের মে মাসে ব্র্যান্ড ফোরামের আয়োজনে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে তরুণদের একটি সমাবেশে আনিসুল হক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন,‘আমার জীবনটা শুরু হয়েছিল একটা অগস্ত্যযাত্রার মতো। এ এক অন্তহীন পথে ছুটে চলা।’

তিনি বলেন ‘লাইফ ইজ আ ট্রিপ, ওই ট্রিপে কোনো ম্যাপ নেই। এই ম্যাপ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। আমাদের কার কতটুকু টাকা আছে, সেটি একটি অংকের হিসাব। কিন্তু তার কতুটুক সময় আছে? জীবনের কোন পথ পর্যন্ত পেরোনোর জন্য বিধাতা লিখে রেখেছেন, আমি জানি না। সময়ের হিসাব আমরা জানি না।’

আনিসুল হক বলেন, ‘টাকার পেছনে আমরা ছুটি। কিন্তু টাকা দিয়ে চরিত্র কেনা যায় না। বিশ্বাস কেনা যায় না। মোরাল কেনা যায় না।ম্যানারস কেনা যায় না।টাকা দিয়ে ক্লাস হওয়া যায় না। ইনটেগ্রিটি কেনা যায় না। প্রেম-ভালোবাসাও পাওয়া যায় না।আমরা টাকার পেছনে ছুটি। কিন্তু সময়ের পেছনে ছোটো। জীবনের পেছনে ছোটো।’ সময় ও জীবনের পেছনে ছোটা এই মানুষটি এখন সত্যিই জীবনের পেছনে ছুটছেন।কিন্তু তার পেছনে ছুটছে এক বিরল ব্যাধি। তিনি কি জয়ী হতে পারবেন?

আনিসুল হক মনে করিয়ে দেন, ‘জীবনটা কম্পিউটার নয়। অর্থাৎ এখানে কোনো ব্যাকস্পেস নেই। পেছনে যাওয়ার ‍সুযোগ নেই। যে সময় পার করে এসেছি, সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো ‍সুযোগ নেই।’

আমরা কেন আনিসুল হককে নিয়ে উদ্বিগ্ন? তাকে যদি আমরা স্রেফ একজন পলিটিশিয়ান অথবা সিটি মেয়র হিসেবেই দেখি বা দেখতাম, তাহলে তাকে নিয়ে আমাদের আবেগপূর্ণ অথবা কান্নায় ভারাক্রান্ত হওয়ার মতো কথা ফেসবুকের মতো পাবলিক প্লেসে লিখতাম না। আমরা আনিসুল হককে শুধু একজন মেয়র হিসেবেই চিনি না। আমরা তাকে চিনি একজন কাজ করে দেখানো এবং অসাধ্য সাধন করতে পারার মতো সাহসী পুরুষ হিসেবে।

মেয়র হিসেবে তিনি দুই বছরের কিছু বেশি সময় দায়িত্ব পালনের পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ধরা পড়ে এই বিরল রোগ। এই সময়ের মধ্যে তিনি কি ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশকে বদলে দিয়েছেন বা দিতে পেরেছেন? হয়তো পারেননি। কিন্তু তিনি যা পেরেছেন, তা হলো তিনি একটা পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। একটা নতুন ঢাকা গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন।তবে তিনি এও বুঝতে পেরেছন যে, সিটি করপোরেশনে মাফিয়াদের কী দৌরাত্ম্য। কাজ করতে গেলে পদে পদে কী ভীষণ অন্তরায় এবং এ কথা তিনি পাবলিকলি বলে সমালোচিতও হয়েছেন। এখানেই আনিসুল হক একজন ভিন্ন মানুষ। তিনি যা দেখেন এবং যা বোঝেন ও বিশ্বাস করেন, সেটি অকপটে বলে ফেলেন বা বলতে পারেন। একজন নিপাট পলিটিশিয়ান এভাবে প্রকাশ্যে সবকিছু বলতে পারেন না। যিনি কেবলই দলীয় আনুগত্যের বলে মেয়র হয়েছেন, তার পক্ষে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের মফিয়াদের বিরুদ্ধে স্রেফ একা দাঁড়ানো এবং ওই এলাকার চেহারা বদলে দেয়া সম্ভব নয়। এটা আনিসুল হকের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। কারণ তিনি মাস্তান বা রাজনৈতিক ক্যাডার পোষেন না বা তাকে পুষতে হয় না। ফলে তার উপরে গোস্বা হন ক্ষমতাবান মন্ত্রীরাও। তার বিরুদ্ধে নালিশ যায় খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। কিন্তু আনিসুল হক এসব পাত্তা দেয়ার মানুষ নন।

তিনি মানুষকে, তার নাগরিকদের স্বপ্ন দেখান।একটা পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলার সূচনা করেন। গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় খোদ বিভিন্ন দূতাবাসের সামনে রাস্তায় তিনি যে সংস্কার করেছেন, যেভাবে বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে ফেলেছেন, সেই কাজটি করার জন্য যা লাগে, তা হচ্ছে বুকের পাটা এবং কমিটমেন্ট। এরকম কমিটমেন্ট এবং বুকের পাটাওয়ালা মেয়র সবশেষ কবে এই নগরীর মানুষ দেখেছে, তা আমরা জানি না।

কিন্তু অর্ধেক সময় না যেতেই সেই মানুষটি কেন এমন গভীর ঘুমে মগ্ন হবেন?…এটা কি এই নগরবাসীর সঙ্গে একধরনের ‘ধোঁকাবাজি’ নয়? আপনি কেন এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বেন মি. মেয়র? অনেক কাজ তো বাকি। ফিরে আসুন দ্রুত। যে পরিবর্তনের সূচনা আপনি করেছেন, তার শেষটা আপনাকেই করতে হবে। এত ঘুমালে চলে না। আপনিই তো বলেছিলেন, ‘জীবনের অনেক কাঁটা আছে, সেই কাঁটা সরিয়ে ধীরে ধীরে জীবনকে গোলাপের জায়গায় নিয়ে যেতে হয়।’ অজস্র গোলাপ অপেক্ষা করে আছে আপনাকে বরণ করে নিতে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)