চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্বদেশ বিপন্ন করা মানবতার শেষ পরিণতি কী?

রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশে চলছে চরম উৎকন্ঠা৷ এমনই একটা উত্তপ্ত সময়ে আসামে নাগরিক তালিকা হতে বাদ দেয়া হল বাংলা ভাষায় কথা বলা ভারতের নাগরিকদের৷এই অবস্থায় আসা‌মের অর্থমন্ত্রী ব‌লে‌ছেন, নাগ‌রিক তা‌লিকা থে‌কে বাদ পড়া‌দের বাংলা‌দে‌শে ফি‌রি‌য়ে নেয়ার জন্য তারা সেদে‌শের সরকা‌রের স‌ঙ্গে কথা বল‌বে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার, সেখানে আসামের মন্ত্রীর এ কেমন কথা! বাংলাদেশ কেন ওইসব আসামের নাগরিককে জায়গা দিতে যাবে? সরকার কি রোহিঙ্গাদের মতো এই নাগরিকত্ব বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মানবিক দৃষ্টিতে গ্রহণ করতে যাচ্ছে? এখন য‌দি সি‌লেট সীমা‌ন্তে রোহিঙ্গাদের মত আসামের ওইসব মানুষের ঢল না‌মে, কী করবে তখন সরকার?

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানীয় জল সরবরাহের জন্য এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৭১টি গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা সে পানি পান করে না। এসব টিউবওয়েলের পানি দিয়ে তারা গোসল, থালাবাসন ধোয়াসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম সারে। খাবারের জন্য তারা বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী বা এনজিওদের কাছ থেকে ত্রাণ হিসেবে পাওয়া মিনারেল ওয়াটারের পানি আর ফলের জুস পান করে। উদ্বৃত্ত পানি ও জুস তারা স্থানীয় বাঙালির কাছে বিক্রি করে দেয়। রোহিঙ্গাদের মাঝে লড়াই করে অধিকার আদায়ের তাগিদও নেই। নেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন৷ আর বাঙালিরা দেশে ফেরার দিন গুনেছে৷ রোহিঙ্গারা কেউ হয়ে উঠছে ডাকাত সর্দার,কেউ মাদক ব্যবসায়ী৷ কারও জীবন হয়ে উঠছে বিলাসী রাজা জমিদারদের মতো৷ আশ্রয়দানকারী বাঙালিরা যখন দু’ বেলা ভাতের জন্য হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে, তখন রোহিঙ্গারা ইউরোপের সয়াপ্রোটিন বিস্কুট দিয়ে চা পান করে। দাতাগোষ্ঠী ওদের বাংলাদেশে খাইয়ে- দাইয়ে কী উদ্দেশ্যে সুখে রাখছে? আরাকান রাজ্যে পশ্চিমাদের বিনিয়োগ নির্ঝঞ্ঝাট করতে নয় কি?

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী নূর মোহাম্মদের মেয়ের কান ফুটো করার অনুষ্ঠানে এক কেজির উপরে সোনার অলঙ্কার পেয়েছে গিফট হিসেবে, সাথে নগদ কয়েক লক্ষ টাকা! রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদের এদেশে চার-চারটি বাড়ি রয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রোহিঙ্গা ডাকাতকে স্মার্টকার্ড দিয়েছিল ইসি৷ রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদ কীভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হলো জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ তা জানেনা৷ তারা বলছে,রোহিঙ্গা ডাকাত কীভাবে ভোটার হলো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শীঘ্রই তদন্ত কমিটি গঠন করবে৷ তারা এও বলছে, অপরাধীরা অবশ্যই শাস্তি পাবে৷ কিন্তু প্রশ্ন হল অপরাধীদের এখন চিহ্নিত করবে কিভাবে? নূর মোহাম্মদ কিভাবে স্মার্ট কার্ড পেলো সেটা জানতে কি তাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিলো না?এখন তদন্ত কমিটি কিভাবে বের করবে তা? বন্দুক যুদ্ধে তাকে মেরে ফেলা কি মূল অপরাধীদের আড়াল করা নয়? এছাড়াও শরনার্থী হিসাবে এসে সে চার চারটি বাড়ির মালিক হলো কী করে?১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে শরনার্থী হিসাবে বাঙালীদের এমন কোন নজির ছিলো কি?বাঙালীরা শরনার্থী হয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে৷ রোহিঙ্গাদেরতো তেমন কোন স্বপ্নও নেই৷

মানবিক বাংলাদেশ মানবিক দৃষ্টিতে অপরকে অধিকার দিতে গিয়ে নিজের অধিকার খোয়াতে বসেছে৷ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভয় পেয়ে চলতে হচ্ছে আশ্রয়দানকারী খোদ বাঙালীদেরকেই৷ রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়ে উঠছে সশস্ত্র ঘাঁটি৷ এমন একটি সময়ে আসামে ১৯ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করল৷ কয়েক মাস আগে বন্যায় ভেসে গিয়েছে তাদের বাড়ি ঘর। এমন দুঃসময়ে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা হতে আসামের বাংলাভাষীরা৷ নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য রাজ্যের সব অধিবাসীকে তাদের জমির দলিল, ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টসহ নানা ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়েছে। যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মেছেন তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে তাদের বাবা-মা ঐ তারিখের আগে থেকেই আসামের বাসিন্দা। খসড়া তালিকা অনুযায়ী, রাজ্যের মোট তিন কোটি ২৯ লক্ষ বাসিন্দা তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সমর্থ হন।
আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। সেটা ছিল ভারত ভাগের চার বছর পর। সে সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ লোক সীমান্ত অতিক্রম করে নবগঠিত ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ অভিবাসী বিরোধ একসময় সেখানে সহিংস রূপ নেয় এতে কয়েকহাজার সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসী প্রাণ হারান।

১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসামের বাসিন্দা প্রমাণ করতে না পেরে ভোটার তালিকা হতে বাদ পড়ে গেল ১৯ লক্ষ বাংলাভাষী। তাদের পরিচয় নিয়ে আসাম সরকারের সংশয় থাকলেও তারা আদৌও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কিনা, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে কী উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক পরিণত করা হল? সে বিষয়ে ভেবে দেখা দরকার। এই অসহায় বাংলাভাষী আসামের মানুষরা আজ কোথায় যাবে? নাকি পুশইন করে তাদেরকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হবে? কী আছে এই ১৯ লাখ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে? অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত থেকে অনেকে আশ্রয় নেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে। এই উদ্বাস্তুরা ‘মোহাজের’ নামে পরিচিত। জাফলংয়ে বনের জমি অধিগ্রহণ করে এদের থাকার ব্যবস্থা করে তৎকালীন ত্রাণ অধিদপ্তর। এরপর ১৯৮৫ সালের গেজেটে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধিগ্রহণ করা জমিগুলো বন বিভাগকে ফিরিয়ে দিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই এলাকায় বন বিভাগ গড়ে তুলে গ্রিন ফরেস্ট।

সর্বশেষ এসএ রেকর্ডেও এই ভূমি বন বিভাগের নামে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বন বিভাগের জমি নিজেদের বলে দাবি করেছে ‘মোহাজের’ পরিচয়দানকারী একটি গোষ্ঠী। এখানেও সহিংস হয়ে উঠছে মোহাজেরদের সাথে স্থানীয়দের বিরোধ৷

জমি পেতে আদালতে মামলাও করেছে মোহাজেররা। কিন্তু আইনি প্রতিকারের অপেক্ষায় না থেকে বনের জমি দখল করে নিচ্ছে তারা৷ ইতোমধ্যে বনবিভাগের প্রায় পাঁচশ’ একর জমি দখলও করে নিয়েছে ৷ রোহিঙ্গা, মোহাজেরের পর এবার কি আবির্ভূত হচ্ছে আসামের নাগরিকত্ব বঞ্চিত মানুষগুলো? এমনটি ঘটলে কী করবে তখন বাংলাদেশ?আসাম-নাগরিকত্ব তালিকা-আসামের নাগরিকমানবতার মূল্য দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলো৷ তবে কি এবার বন্ধুত্বের মূল্য দিতে গিয়ে আসামের নাগরিক বঞ্চিত ১৯ লাখ মানুষকেও আশ্রয় দেবে?এখন আবার পশ্চিম বঙ্গের বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলছে,পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এমন লোকের সংখ্যা কত হবে তখন? বাংলাদেশ কি তাদেরকেও আশ্রয় দেবে? রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েই ভৌগলিক নিরাপত্তা পড়েছে চরম ঝুঁকিতে৷ মোহাজেরদের পর রোহিঙ্গা তারপরে আসামের মানুষের পরে পশ্চিম বঙ্গীয়রা৷ বাংলাদেশ কি তবে মানবতার ঢালি খুলে বসেছে?স্বদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিপন্ন করে অন্যকে আশ্রয়দান কেমন মানবতা?এ মানবতার শেষ পরিণতি কী?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)