যে আয়োজনে পাতা নড়ে, যে প্রয়োজনে কচ্ছপের পায়ের সঙ্গে সরে বালি – তারো থেকে কাছে, অতি নিকটেই তৈরি হয় মূলের বিস্তার এবং প্রাণের সঞ্চরণ। ফাঁকা চাকায় একদিন ঝুল দিয়েছিলো সময়, এবং তার ঝুঁটি ধ’রে সেই বৈদেশ – ফৈজত পার ক’রে যখন ফিরি তখন কাণ্ডে নতুন প্রকাণ্ডে, আর খসখসে পিঠে নুনের ফেনা – ঢেউ। যে পাড়ি দিতে হয় বিরহে, সে প্রত্যাবর্তনও বুঝিবা বেদনার। তাই ফেরা ছিলো ধোয়ামোছা কব্জায় নতুন ক’রে পাল্লা জুড়ে দেয়া। থই মিলতে – মিলতে খই ফুটছে – আর দিনের মধ্যাহ্ন, দিনেরই অপরাহ্ণে তালি বাজাচ্ছে কী সাকুরায়, কী শেরাটনে।
কী এমন বয়স হয় পঞ্চাশে, যখন ত্রিশ স্পর্শ করা যায়? যায়, অহংকারের দানা ধীরে – সুস্থে খোলার কায়দা জানলে সব হয়! খুলে যেতে থাকলো বেদনার রং, ভুলে যেতে থাকলো ফোঁটার ভাষা। মিলমিশে টুইটুম্বুর কী আশা, কী রফিক আজাদ-বাদল রহমান-মাহবুবুল হক শাকিল। ঢেঁড়া পিটিয়ে কাক তাড়ানো যায়, কাঁসর বাজিয়ে প্রতিমা জাগানো যায়, আবার চোঙা ফুকিয়ে রাজপথকে জনপথ বানানোর অঙ্গীকারও করা যায়। মূল কথাটা বাজনার, বিষয়টি আওয়াজের! হ্যাঁ, শব্দরূপের সেই ঘোরে জিহ্বার জোরে একদিন তোড়েশোরে কাচ ভেঙে, মেঝে ঠুকে, টেবিল চাপড়িয়ে শাকিল যেমন তার উপস্থিতি জানান দিয়েছিলো; তেমনি আমি কিংবা রফিক ভাই, অথবা বাদল – আমরা কেউ-ই বিস্মিত হয়নি, বরং গলা তুলে ব’লেছিলাম: এসো ভাই, ভাই-ভাই ফতুর করি দিন – মুছে দিই রজনীর ঋণ! চলে, চ’লছে – চ’লতে থাকে গ্লাসে; বলে, ব’লছে – বলা হ’চ্ছে পাতায় – পাতায়, কচ্ছপের পায়! রফিক ভাইয়ের কবিতা, বাদল রহমানের ছায়াছবির সঙ্গে শাকিল সগৌরব জুড়ে দিচ্ছে তার জনতার দাবি, বাংলাদেশের ঊন ঠোঁটের কাহিনী।
আমাদের বাহিনীতে তখন পদাতিকের সঙ্গে বিমানসেনার জোর ভাব। নৌচলাচলের খবর তো সেই বঙ্গোপসাগরের জাহাজে, – তার মধ্যেই ফুঁ দেয় জাদুকর, ঢুঁ মারে দাবাড়-, অবহেলা নাড়ায় বেকার গায়ক আর হাই তোলে মধুমেহ রোগের চিকিৎসক। দুপুর থেকে মধ্যরাত – হাল ধরেন বিদ্যাসাগর মহাশয়, ফৌত হন মাইকেল সাহেব এবং ঘণ্টা বাজিয়ে চলেন ঠাকুর। রবি মামা দেয় হামা গায় রাঙা জামা ঐ – হৈ-হৈ-হৈ -; ভাসছে কবিতার গলুই। বুকের কথা মুখে এসে তল পায়, শাকিল নাচায়! ওর পাঁচ আঙুলে উঠে আসে পঞ্চবর্ণের ঢং, ফুটে ওঠে পঞ্চদেহের রং। বিচারক এজলাসে ওঠে, শিক্ষক চল্লিশ মিনিটের দম নেয়, পেনাল্টিতে গোল দেয় ফরওয়ার্ড, ভূমি-মহাজন ক্রেতার খোঁজে পোস্টার সাঁটেন – এবং নীতিমালা রাজনীতিতে রূপান্তরিত হ’য়ে বুড়িগঙ্গা পার ক’রে পদ্মাপাড়ে চখাচখির তল্লাশ নেয়। শাকিল জানে, শাকিল বোঝে – একটি কানামাছি, দুইটি ভোঁদড় থেকে তিনজন দালাল আর বুড়ো-হাবড়ার সঙ্গে জোয়ানির কারবার এক নয়। তবু ক্ষয় হয়, জয় ব’লে কোনোকথা তখনও অভিধানে বসেনি। হোক,- হ’লো, শাকিল মিলে গেলো তার ছাত্রত্বের কপিকলে রাজনীতির সাবালক বালতিতে। কুয়ো থেকে জল উঠছে, চৌবাচ্চা ভ’রছে। দেখি, স’রে থাকি – আবার সরিও না। হঠাৎ-হঠাৎ কুয়োর জলে ব্যাঙ পর্যন্ত উঠে আসে। মরা ব্যাঙ গন্ধ ক’রে দেয় চাষের ভূমি, বিষ বানায় পানীয় জল। তারপর তো একদিন রাজপথ টলমল, জনপথে পালে-হালে সয়লাব।
শাকিল কবিতা লেখে! এক মধ্যবেলায় পানশালায় রফিক আজাদের দু’চরণের নিচে আমার দু’ আঙুলের টিপ ব’সে গেলে – ও জোড়া স্বাক্ষর ক’রে পূর্ণ কবিতা বানিয়ে দিলো। তা হ’লে, এই কথা! তলে-তলে এই। শাকিল কবি। তারপরে তো দেদার ফেসবুকে লেখার ইতিবৃত্ত। অভি, অভিজিৎ পাল বললো সে ‘ছিন্নপত্র’ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা ক’রে শাকিলের বই বের করবে। রফিক ভাই ও আমি পাণ্ডুলিপি দেখে দেবো। আয়োজন চললো। তবে এ পক্ষের চেয়ে বোধকরি অন্যপক্ষে একটু অন্যভাব। ‘অন্বেষা’ বের করলো মাহবুবুল হক শাকিলের প্রথম কাব্য ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় অন্বেষার স্টলের সামনে আমরা চোঙা ফুকিয়ে বইয়ের মোড়ক খুললাম। সে কী আনন্দ শাকিলের তরুণ বন্ধুদের! ভালোবাসা চোখে জল এনে দেয়। ভালোবাসা থাকে হাড়ের উল্টো পিঠে / এক বৈকালে জোড়া পায় খোঁজে মাটি / ঘাসে ফুলে তার অভিমান ঝরে গেলে / বৃষ্টি পায় যে নুনের দলা খাঁটি। এই মাটি, এই ভালোবাসা, এই হাড় … ইত্যাদি-ইত্যাদি ছাপিয়ে অনেক-অনেক দূরে ব’সে কিন্তু অভিমান পালা দেখে। আর পরশ্রীকাতরতা এসে তার দোহার হয়। এই মেলবন্ধনের কোনো ক্রম নেই, নেই কোনো বিধি। ভালোবাসা এক নিধি ! প্রেম এক খোয়াব দেখা জোয়ার! যে দেখে, সে বোঝে – কিংবা বোঝেও না। শাকিলের কবিতা তাই যেমন শাকিলের, আবার তারও না। এই কবিতা এক প্রেমিকের নুন – জীবনের খুনে যা সর্বদা রাঙা!
খুব তাড়াহুড়া হ’য়ে গেলো। তা-ই বা বলি কী করে? ফেসবুক নাকে সুতো বেঁধে টানতে লাগলো – টানতেই লাগলো! আর সুতোর অন্য প্রান্তে আগুন, জল, বায়ু, মাটি ও আকাশ! ও আমার কপাল – জাল কৈবর্তের, আর মাছ দাবড়ায় জেলে! ’চমকাই, আপ্লুত হই, মাহবুবুল হক শাকিলের দ্বিতীয় বই ‘মন খারাপের গাড়ি’- ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বেরিয়ে গেলো।
“ও আমার চিরচেনা দুঃখ
আজো আমি কেনো
তোমারই দাসানুদাস?
… …
পাড়ি দেয়ার সময় হলো
এখনো শিয়রে আসে না
শুশ্রুষার কমলাকোয়া ঠোঁট।”
নতুন জলবায়ু,- নতুন প্রদেশ আর নতুন-নতুন খনি-বিহার! কবির যা চাই, রাজনীতিকেরও কি তাই? প্রেমিকের যা চাই, ঘাতকেরও কি তাই? প্রশ্ন তো উত্তরের কাছে যায়। আর উত্তর, দক্ষিণে। দেড় যুগের জল-বসন্ত এমন কিছু না। আশা ছিলো, আমার নতুন গদ্যের বই ‘আয় রে আমার গোলাপজাম’ – ওর হাতে দিয়ে চমকে দেবো! উৎসর্গের পাতাটি যে কেবল মাহবুবুল হক শাকিলের জন্যই বরাদ্দ।
২০ ডিসেম্বর শাকিলের জন্মদিন। ৪৮ বছর বয়সী এক বালক, এক তরুণ, এক যুবক – কিংবা এক ছাত্রনেতা, এক নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এক বন্ধু, এক ভাই – তারোপর এক কবি নিজেকে যে জানান দিয়েছিলো:
“… লাশকাটা ঘরে
আজ তোমাকে দেখতে এসেছি।”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)