লিখেছেন, অধ্যাপক (ভারপ্রাপ্ত) রকিব উদ্দীন আহমেদ
আমরা সবাই জানি অক্টোবর মাস হলো স্তন ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতার মাস। এই রোগ প্রতিরোধে অক্টোবর মাসে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ও প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। এবারও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এই রোগ বিষয়ে সচেতন করতে নানান কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
আমরা জানি ক্যান্সার মানেই মারাত্মক ব্যাধি ও আতঙ্কের এক নাম। এই আতঙ্কে যুক্ত হয়েছে স্তন ক্যান্সার। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার এখন সর্বাধিক। প্রতি বছর উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। অজ্ঞতা, অপচিকিৎসা, কুসংস্কার ইত্যাদি কারণেই এই রোগে মৃত্যু ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। এ রোগ সম্পর্কে তাই কিছু ধারণা, সতর্কতা থাকা নারী-পুরুষ সবার জন্য খুবই জরুরি। তবে বলে রাখি স্তন ক্যান্সার কিন্তু পুরুষদেরও হতে পারে যদিও মাত্র ১% পুরুষের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে নারীর আক্রান্তের চিত্রটা খুব ভালো নয়। প্রতি ৮ জন নারীর মধ্যে ১ জনের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথমেই একটু জানা যাক স্তন ক্যান্সারের কারণগুলো কী হতে পারে। বেশিরভাগ স্তন ক্যান্সারের সঠিক বা নির্দিষ্ট কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে কিছু ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টর স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। সেই কারণগুলো হলো- ১. বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্তন ক্যান্সারের সম্ভবনা বেড়ে যায়, ২. পরিবারে যদি অল্প বয়সে মা, খালা, বোনের স্তন ক্যান্সার থাকে, ৩. জিনগত পরিবর্তন ( জেনেটিক মিউটেশন), ৪. অল্প বয়সে (১২ বছর) মাসিক বা পিরিয়ড শুরু হলে, ৫. বেশি বয়সে (৫৫ বছর) পিরিয়ড বা মাসিক বন্ধ হওয়া, ৬. যাদের বিবাহ হয়নি, ৭. অধিক বয়সে (৩০ বছর) প্রথম বাচ্চা গ্রহণ বা সন্তান না হলে, ৮. সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, ৯. স্থূলাকার শরীর ( অবেসিটি), ৯. শারীরিক পরিশ্রম না করা, ১০. ম্যামোগ্রাফিতে স্তনের ঘনত্ব (ডেনসিটি) বেশি থাকলে, ১১. পূর্বে বক্ষদেশে রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা গ্রহণ করলে। মূলত এগুলোই কারণ।
এবার জানা যাক স্তন ক্যান্সারে উপসর্গগুলো কী
সাধারণত স্তনে কোনো চাকা বা পিণ্ডের উপস্থিতিই স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক বা প্রথম লক্ষণ। শক্ত, অমৃসণ এবং ব্যথামুক্ত চাকা বা পিণ্ড নিয়েই স্তন ক্যান্সার প্রথম বা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে। স্তনে চাকার পাশাপাশি বগলেও চাকা হতে পারে। এমনকি শুধুমাত্র বগলে চাকা নিয়েও স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হতে পারে। আবার স্তনের বোটা (নিপল) ভিতরের দিকে ঢুকে যেতে পারে। বোটা হতে রক্ত নির্গত হতে পারে। আবার স্তনের বোঁটাতে অ্যাকজিমার মতো ঘাঁ হতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে স্তনের চাকা বক্ষের সাথে (চেস্ট ওয়াল) বা উপরের চামড়ার সাথে শক্তভাবে লেগে থাকতে পারে। আবার চামড়ায় ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে। স্তনের ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য স্থানে চলে গেলে অর্থাৎ ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়লে (কাশি, শ্বাসকষ্ট, কাশির সাথে রক্ত), হাড়ে ছড়িয়ে গেলে (প্রচুর ব্যথা, হাড় ভেঙে যাওয়া), মাথায় চলে গেলে (বমি, মাথা ব্যথা, প্যারালাইসিস)-এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে। এ পর্যায়ে চিকিৎসা করে রোগী সুস্থ করা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে।
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা
স্তন ক্যান্সারের সকল চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের দেশেই রয়েছে। স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হলো: ১. সার্জারি, ২. রেডিওথেরাপি, ৩. কেমোথেরাপি, ৪. হরমোন থেরাপি, ৫. টারগেটেড থেরাপি, ৬. ইমুনোথেরাপি। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা একজন রোগীর দরকার হয় না। এটি নির্ভর করবে রোগের বিস্তৃতি টিউমারের চরিত্র বা ধরনের উপর। যাকে আমরা টিউমার বায়োলজি বলি।
সার্জারি
অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ সার্জনের মাধ্যমে সার্জারি করা উচিত। সার্জন কী ধরনের অপারেশন করবেন সে সিদ্ধান্ত রোগীর সঙ্গে আলোচনা করেই করা হয়। সম্পূর্ণ স্তন না কেটে অর্থাৎ শুধুমাত্র টিউমার ফেলে দিয়েও দৈহিক সৌন্দর্য বজায় রেখে সার্জারি করা যায়।
কেমোথেরাপি
স্তন ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি নিয়ে অনেক প্রশ্ন এবং ভয়। সাধারণত স্যালাইনের মধ্যে ঔষধ মিশিয়ে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। কেমোথেরাপির অবশ্যই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যা কিন্তু চিকিৎসাযোগ্য। কেমোথেরাপি অবশ্যই একজন ক্যান্সার চিকিৎিসকের তত্ত্বাবধানে করা উচিত। যত্রতত্র কেমোথেরাপি নেওয়া উচিত নয়। অনেক ক্ষেত্রে রক্তের উপাদান কমে যায় যা চিকিৎসা না করলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। চুল পড়া নিয়ে অনেকে খুব আতঙ্কে থাকেন । কিন্তু চিকিৎসা শেষে আবারও পূর্বের তুলনায় আরও ঘন এবং কালো চুল উঠে যায়। বিভিন্ন খরচের মধ্যে কেমোথেরাপি পাওয়া যায়। রোগীর প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণ এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এখন অনেক ঔষধ কোম্পানিই স্বল্প মূল্যে কেমোথেরাপি নিয়েও কথা থাকে। রক্তের উপাদান কম হলে যে ঔষধ ব্যবহার হয় (যেমন: পেগফিলগ্রাসটিম) তা পূর্বে অনেক মূল্য হলেও বর্তমানে দেশি কোম্পানি স্বল্প ও সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করছে।
রেডিওথেরাপি
এটি মেশিনের মাধ্যমে বিকিরণ চিকিৎসা। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে মেশিনের মাধ্যমে অপারেশনের স্থানে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। এটি ব্যথামুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা। সকল স্তন ক্যান্সারের রোগীদের এ চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। তবে স্তন না কেটে শুধুমাত্র টিউমার অপসারণ করা হলে রেডিওথেরাপি বাধ্যতামূলক। স্তন ক্যান্সার হাড়ে বা ব্রেইনে চলে গেলেও রেডিওথেরাপি দিতে হয়।
হরমোন থেরাপি
এটি মুখে খাবার ঔষধ। সাধারণত ৫-১০ বছর পর্যন্ত এ ঔষধ ব্যবহার করা হয়। বায়োপসি-এর মাধ্যমে হরমোন থেরাপি কার্যকর কিনা জানা যায়। অর্থাৎ সবাইকে হরমোন দেওয়া হয় না।
টারগেটেড ও ইমুনোথেরাপি
এগুলো স্তন ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসা। তবে সব স্তন ক্যান্সারের রোগীদের এই চিকিৎসা দরকার হয় না। এ চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের দেশেই রয়েছে। তবে অনেক ব্যয়বহুল।
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
সাধারণত স্তনে কোনো চাকা বা পিণ্ডের উপস্থিতি সন্দেহ হলে চিকিৎসকগণ শারীরিব বিভিন্ন পরীক্ষাসহ সহ আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করেন। তবে মনে রাখতে হবে স্তনে বেশিরভাগ চাকা বা পিণ্ড কিন্তু ক্যান্সার নয়। বিশেষ করে টিনএজার মেয়েদের বেলা এটি মনে রাখতে হবে। তবে এরকম কিছু অনুভূত হলে শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে শুরুতে রোগ শনাক্ত করতে পারলে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা সম্ভব। সাধারণত আল্ট্রা-সনোগ্রাফি, ম্যামোগ্রাফি, এমআরআই, হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিস করার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার আছে কি নেই তা নিশ্চিত করা হয়। এরপর স্তন ক্যান্সার নিশ্চিত হলে রোগের বিস্তৃতি কতদূর বা কোন স্তরে রয়েছে তা বুঝার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়। যেমন: বুকের এক্স-রে/সিটি স্ক্যান, পেটের আল্ট্রা-সনোগ্রাম/সিটি স্ক্যান, বোন স্ক্যান, কখনো মাথার এমআরআই-ও করা হয়। এছাড়া চিকিৎসক কিডনি ফাংশন টেস্ট, লিভার ফাংশন টেস্ট, রক্তের সাধারণ পরীক্ষ করা হয়।
স্তন ক্যান্সারের স্ক্রিনিং
স্তন ক্যান্সারের স্ক্রিনিং হলো উপসর্গ হবার পূর্বেই রোগ শনাক্ত করা। স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হলে চিকিৎসার ফলাফল ভালো হয়। অক্টোবর মাসকে স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসেবে বলা হয়। পৃথিবীব্যাপি এ মাস পালিত হয়। এই সচেতনতার মাসে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এখাওে ভয়ের কিছুই নেই। আমরা মনে করি নিয়মানুযায়ী প্রতি মাসে একবার করে পরীক্ষা করে কোনো অস্বাভাবিকতা মনে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া হলো সবচেয়ে বিজ্ঞের কাজ। এ ছাড়া ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন যা
চিকিৎসকের মাধ্যমে করা হয়। রোগী যদি নিজে ভালোমতো বুঝতে না পারে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
শেষ কথা
আমরা ইতোমধ্যে যে সকল ঝুঁকির কথা বলেছি, সেগুলো এড়িয়ে, সতর্কতা অবলম্বন করে আমরা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারি। যদি স্তন ক্যান্সার হয়েই যায়, তবে সেক্ষেত্রে আমাদের সূচনায় অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ ধরা পড়লে ৯৮ ভাগ আক্রান্তের সুস্থ হবার অবারিত সুযোগ রয়েছে। তবে অপচিকিৎসার মাধ্যমে বা বিলম্বে উপস্থিত হবার ফলে ভালো ফলাফল কিন্তু পাওয়া যায় না।
ভয়ভীতি, লজ্জা-শরম ইত্যাদি পরিহার করে আমাদের তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তের উপর জোর দিতে হবে। এ ব্যাপারে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনও রয়েছে। কেননা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন একেবাওে তৃণমূল পর্যন্ত সচেতনতা তৈরিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। স্তন ক্যান্সারের প্রতিরোধ, প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য এগুলো জরুরি।
এ ছাড়া সমাজের উচ্চবিত্ত এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলো আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। এসব উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হলে আমরা স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ এবং মৃত্যুঝুঁকি অনেক কমিয়ে আনতে পারব বলে বিশ্বাস করি।