চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্টিল শিল্পে ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির শঙ্কা, বিভিন্ন সুবিধা দাবি

করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্টিল শিল্পে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হবে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ)। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা সরকারের কাছে একগুচ্ছ সুবিধা চেয়েছে।

সোমবার এক ভিডিও কনফারেন্সে এসব তথ্য জানায় সংগঠনটি। আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানায় তারা।

এতে বলা হয়, স্টিল শিল্প বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত। দেশের অবকাঠামো ও আবাসন নির্মাণে স্টিল খাতের ভূমিকা অপরিসীম। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং প্রায় ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এ শিল্পের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

স্টিল শিল্প একটি ভারী শিল্প অর্থাৎ উচ্চ বিনিয়োগ, উচ্চ চলতি মূলধন, উচ্চ উপরিভাগ ব্যয়বহূল একটি শিল্প। স্টিল শিল্প ভলিউমেট্রিক অর্থাৎ উচ্চ বিক্রয় এবং স্বল্প মুনাফার একটি শিল্প। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশের স্টিল শিল্পে সম্ভাব্য লোকসানের পরিমান প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত খাতের অন্যতম হবে স্টিল শিল্প। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসতেও শিল্পটির দীর্ঘ সময় লাগবে।

সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশের স্টিল শিল্প ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি নির্ভর সমগ্র বিশ্বের স্টিল স্ক্র্যাপ সরবরাহব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। গ্রীষ্মকালীন সংগ্রহ নির্ভর এই কাঁচামাল এবছর আর সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং সম্মিলিত ইউরোপে প্রচুর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে। কন্টেইনারের অভাবে শিপমেন্ট হচ্ছে না। ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে জাহাজের অভাবে কন্টেইনারের স্তুপ জমাট বাঁধছে। শুধু চায়নাতে আটকে আছে আশি ৮০ লাখের বেশি খালি কন্টেইনার। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে আগামী বছর পর্যন্ত এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল সরবরাহে ভয়াবহ সঙ্কট থাকবে। এ খাতকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে অন্ততপক্ষে ১৮ মাস সময় দরকার। আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অন্ততপক্ষে ৫ থেকে ৬ বছর লাগবে।

এ প্রেক্ষিতে স্টিল শিল্পের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য লোকসানের পরিমাণ কমাতে অর্থ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। যথা-

১. এ শিল্প সরকার থেকে প্রণোদনা চায় না, শুধু সম্ভাব্য লোকসান এবং জিডিপিতে স্টিল শিল্পের অবদানের ভিত্তিতে সরকারের ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার সরকারি প্যাকেজ থেকে স্টিল শিল্পকে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়ার দাবি।

২. অর্থনৈতিক অবকাঠামো ঠিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সম্প্রসারণমূলক ব্যবসা-বান্ধব এবং তড়িৎ সিদ্ধান্তে অগ্রসরমান ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেয়ার অনুরোধ। যেমন-

ক) স্টিল শিল্পের জন্য ৪ মাসের সমপরিমাণ অতিরিক্ত এলসি লিমিটের অনুমোদন প্রদান প্রয়োজন। অর্থাৎ ননফান্ডেড সুবিধাদি প্রদানের অনুরোধ করছি।

খ) এ শিল্পের প্রতিটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও শ্রমিকদের ৪ মাসের বেতন-ভাতা ঋণ আকারে অন্তত ১২টি কিস্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থা করার অনুরোধ।

গ) এ শিল্পে আগামী এক বছরের জন্য কোন প্রকার অতিরিক্ত সুদ বা পেনাল ইন্টারেস্ট মুক্ত রাখতে হবে।

ঘ) সব ব্যাংকের সব গ্রাহকের জন্য ঋণে ৯ শতাংশ সুদ হার বাস্তবায়ন করা।

ঙ) এ শিল্পে লোকসানের চাপ কমাতে অন্ততপক্ষে ১২ বছরের জন্য ৬ মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ সব দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল পরিশোধ সংক্রান্ত
১. মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত সময় এ শিল্পের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল পরিশোধ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত করা।

২. কারখানার বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল পরিশোধের বিলম্বের কারণে কোনো প্রকার জরিমানা বা অতিরিক্ত অর্থ বা সারচার্জ আদায় না করা।

৩। কারখানার বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিল অক্টোবর মাস হতে ৬টি সম-মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া।

আমদানি শুল্ক বিষয়ে প্রস্তাবনা
১. মেল্টেবল স্ক্র্যাপ (এইচএস কোড:৭২০৪.৪৯০০) আমদানি শুল্ক ১৫শ টাকা থেকে কমিয়ে ৫শ টাকা র্নির্ধারণ করা।

২. বিশ্ব বাজারে মন্দার কারণে এমএস রড ডাম্পিং হবার সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্য এমএস রড আমদানি পর্যায়ে (এইচএস কোড:৭২১৩.২০.০০) এর উপর অতিরিক্ত ১৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপের অনুরোধ।

মূল্য সংযোজন কর ও ভ্যাট প্রস্তাবনা
১. স্টিল উৎপাদন এবং সরবরাহ পর্যায়ে (হেডিংনং: ৭২.১৪ থেকে হেডিং নং ৭২.১৬ পর্যন্ত) বর্ধিত মূসক হ্রাস করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অনুরূপ নির্ধারণ করা। অর্থাৎ (ক) আমদানিকৃত মেল্টেবল স্ক্র্যাপ হতে বিলেট টনপ্রতি ১০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৪৫০ টাকায় পুনঃনির্ধারণ করা।(খ) বিলেট হতে এম এস রড টনপ্রতি ১ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৪৫০ টাকায় পুনঃনির্ধারণ করা। (গ) মেল্টেবল স্ক্র্যাপ হতে এমএস রড ২০০০ টাকা থেকে কমিয়ে টনপ্রতি ৯০০ টাকায় পুনঃনির্ধারণ করা।

২. স্টিল শিল্পের সকল কাঁচামাল আমদানি পণ্যের উপর আরোপিত ৫% আগাম কর প্রত্যাহার করা।

৩. উৎসে মূল্য সংযোজন কর কর্তন প্রত্যাহার করা।

৪. খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে রডের মূসক টনপ্রতি ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা নির্ধারণ করা।

৫. স্ক্র্যাপ বা শিপ স্ক্র্যাপ (হেডিং নং ৭২.০৪) মূসক টনপ্রতি ১০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা।

আয়কর বিষয়ক প্রস্তাবনা
১. পরবর্তী অর্থবছরের জন্য কর্পোরেট আয়কর ১০% নির্ধারণ করা।

২. কাঁচামাল আমদানির উপর আরোপিত টনপ্রতি অগ্রিম আয় কর ৫০০ টাকা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা।

৩. রড বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান উৎস কর কর্তন প্রত্যাহার করা।

৪. স্থানীয় পর্যায়ে স্টিলের স্ক্র্যাপ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আরোপিত ৩% অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা।

৫. বিলেট বিক্রয়ের উপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা।

সংগঠনটির অভিযোগ, স্থানীয় রপ্তানির ক্ষেত্রে এনবিআর অযথা জটিলতা সৃষ্টি করে রাখলেও, ক্রেতাদের বিদেশ হতে সম্পূর্ণ শুল্কবিহীন এমএস রড আমদানির সহজ সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রয়োজন দেশীয় উদ্যোক্তাদের পাশে থেকে, দেশীয় পণ্য সহজলভ্য করা। শুল্কবিহীন এমএস রড আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ, স্থানীয় রপ্তানি সংক্রান্ত সব জটিলতা দূর করা। একই সাথে অগ্রিম আয়কর ও আগাম কর আরোপ বন্ধ করার অনুরোধ জানায় তারা।