শুরু আর শেষটা দুই দলের জন্য হল দুই রকম। গোড়া থেকে আধিপত্য দেখালেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা। ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে অজিদের রেসের গতি থামাল বাংলাদেশ। নিয়মিত বোলারদের ব্যর্থতার দিনে ম্যাজিক দেখালেন সৌম্য সরকার। মাশরাফী-সাকিবদের উইকেটশূন্য থাকার দিনে একাই তিন উইকেট নিয়েছেন এ ওপেনার। তারপরও বাংলাদেশের জন্য দূরহ চ্যালেঞ্জই দাঁড় করিয়েছেন ওয়ার্নার-ফিঞ্চরা। জয়ের জন্য টাইগারদের সামনে ৩৮১ রানের বাধ দিয়েছে অজিরা। জিততে হলে তাই রেকর্ডই ভাঙতে হবে তামিম-সাকিবদের।
এই ম্যাচ জিততে হলে বিশ্বকাপের রেকর্ড গড়তে হবে বাংলাদেশকে। ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের করা করা ৩২৭ রান টপকে জিতেছিল আয়ারল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আগের ম্যাচেই অবশ্য বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২১ রানের স্কোর তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। এবার চ্যালেঞ্চটা ৩৮২ রান করার।
ক্যারিবীয় ম্যাচের সঙ্গে এই রান তাড়ায় বাংলাদেশের প্রেরণা হতে পারে ২০১৫ বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের আসরে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৮ রান তাড়া করে জিতেছিল টাইগাররা। ওই ম্যাচে ৩২২ রান করে তারা। যেটা বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখন তৃতীয় সর্বোচ্চ রানতাড়া করে জেতার রেকর্ড।
বাংলাদেশ ম্যাচের আগেরদিন ওয়র্নারকে নিয়ে দুটি মন্তব্য করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক দুই তারকা। সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ বলেছিলেন, বিশ্বকাপে এখনো নিজের সেরাটা দেয়া বাকি আছে ডেভিড ওয়ার্নারের। তার চেয়ে একটু এগিয়ে মাইকেল স্লাটারের মন্তব্য ছিল, ‘ওয়ার্নারের ফেরারি এখন ফাস্ট গিয়ারে চলছে। সেকেন্ড গিয়ারে ওঠার অপেক্ষা। সেটা হয়তো সেমিফাইনাল থেকেই’।
কিন্তু সেমিফাইনালে নয়, গিয়ারটা আসলে পাকিস্তান ম্যাচ থেকেই বাড়ানো শুরু করেছেন ওয়ার্নার। ভারতের বিপক্ষে স্লো-ফিফটির পর সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। যার জবাব দেন পরের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরিতে। আমির-ওয়াহাবদের বিপক্ষে যদি ফাস্ট গিয়ার হয় তো, মাশরাফী-মোস্তাফিজদের বিপক্ষে সেকেন্ড গিয়ার দিলেন ওয়ার্নার। তার ১৬৬ রানের ইনিংসে ভর করেই বাংলাদেশের সামনে ৩৮২ টার্গেট দাঁড় করেছে অজিরা।
এটা বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে যেকোনো দলের তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। এই বিশ্বকাপেই সর্বোচ্চ ৩৮৬ রান করেছিল ইংল্যান্ড। মাঝখানের ৩৮৫ রানের স্কোরটি ২০১০ সালে গড়েছিল পাকিস্তান। আর বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ এটি। এর আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৪১৭ রান করেছিল তারা। ২০১৫ সালে ঘরের মাঠের বিশ্বাকাপের ওই সংগ্রহটি বিশ্বকাপেরই সেরা সংগ্রহ।
বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ওয়ার্নার। ফিরেছেন বিশ্বকাপে। ফিরেই রান পেয়েছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছেন। ভারত ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে করেছেন হাফসেঞ্চুরি। এবার আবার সেঞ্চুরি।
মাশরাফী-মোস্তাফিজের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সামনে বেশ দেখেশুনে ব্যাট চালাচ্ছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার ও অ্যারন ফিঞ্চ। বাংলাদেশের দুই বোলার যেমন ভালো বল করছিলেন, তখন ঝুঁকিপূর্ণ প্রথম ১০ ওভার একটু হিসেব করেই খেলেছেন দুই অজি ওপেনার। যদিও দুজনে হাত খুলতে শুরু করেন তারপরই। তাতে রানরেট ছয়ের ঘরে পৌঁছে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
টস হেরে বল করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার রানের গতিতে কিছুটা রাশ টেনে ধরতে পারলেও প্রথম এক ঘন্টায় ব্যাটসম্যানদের তেমন বিপদে ফেলতে পারেননি বাংলাদেশের বোলাররা। ওয়ার্নার একাধিকবার ইনসাইড এজ হন, কিন্তু সেটা বড় কোনো বিপদ ছিল না।
বাংলাদেশের জন্য পঞ্চম ওভারের শেষ বলে সুযোগ এসেছিল। সেটা কাজে লাগাতে পারেননি সাব্বির রহমান। মাশরাফীর অফস্টাম্পের বাইরের বল কাট করেন ওয়ার্নার, সেই বল বাতাসে ভেসে চলে যায় ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়ানো সাব্বিরের কাছে। ঝাঁপ দিলেও বল তালুবন্দি করতে ব্যর্থ হন এই বিশ্বকাপে প্রথমবার ম্যাচ খেলতে নামা সাব্বির। শুধু ওয়ার্নারের ক্যাচই না, এদিন পুরো ম্যাচেই বেশ অগোছালো মনে হয়েছে বাংলাদেশের ফিল্ডিং।
শুরুতে উইকেট না পড়ায় বিপদের গন্ধ পেতে থাকে বাংলাদেশ। সাড়ে ১৬ ওভারে দলীয় স্কোরের সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়, আর ওয়ার্নার তুলে নেন চলতি বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ ফিফটি। ফিফটি তুলে নেন ফিঞ্চও।
দুই ওপেনার টানা ২১ ওভার বাংলাদেশের বোলারদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর পর অবশেষে আউট হন ফিঞ্চ। নিজের প্রথম ওভারেই দলকে উইকেটের খোঁজ এনে দেন সৌম্য সরকার।
মাশরাফী থেকে মিরাজ, একে একে পাঁচজন বোলার বল করেও যখন উইকেটের দেখা পাচ্ছিলেন না, তখন অনিয়মিত সৌম্য সরকারের হাতে বল তুলে দেন মাশরাফী। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিতে মোটেও দেরি করেননি তিনি। নিজের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে ফিঞ্চকে আউট করেন। দলীয় ১২১ রানে প্রথম উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া।
সৌম্যর এক্সটা বাউন্সে কিছুটা দ্বিধায় পড়েন ফিঞ্চ। গালির উপর দিয়ে খেলতে গিয়ে শর্ট থার্ডম্যানে রুবেলের হাতে ধরা পড়েন অজি অধিনায়ক। যাওয়ার আগে অবশ্য চলতি বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন। সবশেষ ১১ ওয়ানডেতে এটি তার অষ্টম হাফসেঞ্চুরি। আগের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৫৩ রান করেছিলেন।
ফিঞ্চ ফিরলেও বাংলাদেশের কাঁটা হয়ে থাকেন ওয়ার্নার। তার সঙ্গে যোগ হন আরেক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান উসমান খাজা। ওপেনিং জুটি থেকে ১২১ রান আসার পর এই জুটি তোলে ২৫২ রান।
১১০ বলে বিশ্বকাপের টানা দ্বিতীয় এবং ক্যারিয়ারের ১৬তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি তুলে নেন ওয়ার্নার। ব্যক্তিগত ১২ রানে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত আউট হন ১৬৬ রানে। ১৪৭ বলে ১৪টি চার ও পাঁচ ছক্কায় ইনিংস সাজান ওয়ার্নার। ওয়ানডেতে এটি তার ষষ্ঠ ১৫০ পেরোনো স্কোর। ওয়ানডেতে তার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোরটি পাকিস্তানের বিপক্ষে। ২০১৭’র জানুয়ারিতে অ্যাডিলেডে ১৭৯ রান করেন ওয়ার্নার।
বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় শিকারিও সেই সৌম্য। ওয়ার্নারের আউট যেন ফিঞ্চের আউটের রিহার্সেল। সৌম্যর বলে প্রথম উইকেটের মতো এবারও ক্যাচ নেন রুবেল।
ওয়ার্নার ফেরার পর তার ফেরারি আরও বেশি গতিতে চালাতে শুরু করেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। রানআউটের বাধায় থামে ম্যাক্সি ঝড়। মাত্র ১০ বলে ৩১ রান করে খাজার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির পর রুবেলের সরাসরি থ্রোতে আউট হন ম্যাক্সওয়েল।
ওয়ার্নারের সেঞ্চুরির এক ফাঁকে নিজের ১১তম হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন খাজা। পাঁচ ম্যাচ পর বাংলাদেশের সঙ্গে এসে ফিফটির দেখা পান বাঁহাতি এ ব্যাটসম্যান। শেষ পর্যন্ত ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারেননি খাজা। মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে সৌম্যর তৃতীয় শিকার হওয়ার আগে ৮৯ রান করেন। তার ৭২ বলের ইনিংস সাজানো ১০টি চারে।
৪০-৪৭, এই সাত ওভারে ১০৪ রান তুলে চারশ’র দিকে যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু এই সময়ে দ্রুত চার উইকেট তুলে নেয়ায় সেটা আর হয়নি। ম্যাক্সওয়েলের পর দুই বল খেলে ফেরেন স্টিভেন স্মিথও (১)।
প্রথম পাঁচ ম্যাচে সাত উইকেট পেয়েছেন মোস্তাফিজ। কিন্তু ইনিংসের ৩০ ওভার শেষ হওয়ার আগে একটিও উইকেট নিতে পারেননি। এই ম্যাচেও তাই। ইনিংসের ৪৭তম ওভারে পান উইকেটের দেখা। তার স্লোয়ার বুঝতে না পেরে এলবিডব্লিউ হন স্মিথ। শেষদিকে মার্কাস স্টয়নিস ১১ বলে ১৭ এবং অ্যালেক্স ক্যারির ১১ রানে ৫ উইকেটে ৩৮১ রান দাঁড়ায় অস্ট্রেলিয়ার।