যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগটা যে বেশ গভীর ছিলো তা এখন কারো অজানা নয়। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামীর অর্থায়নে বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান। পরবর্তিতে এসবের সেবা প্রতিষ্ঠানের কারণেই একেবারে ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠেছে দেশের স্বাধীনতা বিরোধী দলটি। গোয়েন্দাদের বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে ওইসব অর্থের একটা অংশ ব্যবহৃত হয়েছে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী দেশ স্বাধীনের পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে আবার দেশ থেকে পালিয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরবে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার মুসলমানদের ক্ষয়ক্ষতি, মসজিদ-মাদ্রাসা ভাঙার বর্ণনা আর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশি মুসলমানদের মানবেতর জীবনের কথা বলে তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বিপুল অর্থ সহায়তা জোগাড় করেন।
কিন্তু ওই অর্থ মসজিদ-মাদ্রাসা পুনর্নির্মাণে কিংবা ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে খরচ না করে নিজেই ভোগ করার পাশাপাশি গড়ে তোলেন জামায়াতের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। একসময় গড়ে তোলেন এনজিও। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ফিরে আসা মীর কাসেম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্যপুষ্ট রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর হন। সেই এনজিওর অর্থে তিনি একের পর এক গড়ে তোলেন নানান ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যা আরো বেশি অর্থ যোগান দেয় জামায়াতকে।
মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায়ের পর এখন আবার জামায়াতের সেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলেই মনে করছেন অনেকেই। সৌদি ভিত্তিক জামায়াতের যে সংযোগ সেটাতেও এখন লাগাম টানার সময় এসেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
হিংস্র ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রসংঘ যা পরবর্তিতে ছাত্রশিবির নাম ধারণ করে ওই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মীর কাসেম আলীর মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগটা ছিলো খুবই সুদৃঢ়। আর সেটাই বেড়ে বেড়ে নিয়েছে এক দানবের রূপ। ধীরে ধীরে তা আরো ডালপালা ছড়িয়েছে, শেকড় আরো দৃঢ় করেছে জামায়াতের অর্থনীতির। এখন সেটা ভেঙে দেওয়ার সময় এসেছে বলেই মনে করছেন অনেকে।
এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ বিষয়ক গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা গত বিশ বছর ধরে একই কথা বলে চলেছি। তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক। দেশের ভেতরেই বাংলাদেশ বিরোধীরা ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠবে আর যারা দেশকে স্বাধীন করলো তারা ৪৫ বছর ধরে ভুগে যাবে এটা হওয়া উচিত না।’
তার দাবি, ‘অন্যদের ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে; তাদের (জামায়াত ইসলামী) ক্ষেত্রেও হোক। তাদের সম্পত্তিগুলো বাজেয়াপ্ত করুক সরকার। তারপর সেটা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হোক। মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই নিজেদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চূড়ান্ত বিপদে পতিত হয়েছে এবং সেই হারানোর কষ্টটা তারা ভোগ করেছে টানা ৪৫ টি বছর।’
একই কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত। তিনি বলেন, ‘এসব যুদ্ধাপরাধী যারা পরে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত হয়েছে তাদের অর্থায়নের উৎস নিয়ে বিগত ২০ বছর ধরে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এসবই এখন বন্ধ করার সময় এসেছে। এখন জঙ্গিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও সময় এসেছে। এমনকি সেই সব বাজেয়াপ্তকৃত সম্পদ সরকারের তত্ত্বাবধানে এনে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, অসচ্ছল জীবন-যাপন করছেন এবং পরবর্তীকালে যারা মৌলবাদী জঙ্গিত্বের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে। সেইসাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তা ব্যয় করা যেতে পারে।’
বিগত লম্বা সময়ে এসব জঙ্গিবাদীদের অর্থায়ন কোথা থেকে হয়েছে এবং কাদের মদদে এসব যুদ্ধাপরাধীরা এতটা অর্থনৈতিক বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে তা আর এখন কারো অজানা নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মধ্যপ্রচ্যের কোন কোন এলাকা থেকে টাকা এসেছে, কাদের কাছে এসেছে এবং কোন খাতে ব্যয় হয়েছ তার সবটাই সবার জানা। এখন সেসবের বিরুদ্ধে আরো দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে আবারও হলে আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটতে সময় লাগবে না।’
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জামায়াত ইসলামী পরিচালিত ৭টি ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানি রয়েছে। এছাড়াও ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন নিয়ন্ত্রিত ১২টি সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প, ১৩টি হাসপাতাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ৬টি পরিবহন কোম্পানি, ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১২টি কোচিং সেন্টার, ৬৯টি গণমাধ্যম ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসহ আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।