“গ্রাম থেকে শহর, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, ইউরোপ থেকে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন, আপনার দরজায় টোকা পড়তে পারে।”- এরকম বক্তব্য দিয়ে নাটকীয়তায় ভরা একটি ভিডিও কিছুদিন আগে নিজের ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পুত্র ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ।
অনেক দিন নিরব থাকার পর তার এ ধরণের ভিডিও পোষ্ট করার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণের মনে কৌতুহল তৈরি হয়। কী করতে যাচ্ছেন তিনি? নতুন রাজনৈতিক দল? নাকি অন্যকিছু?
এসবের জবাব তিনি দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলন করে। কোনো রাজনৈতিক দল না, কোনো আলাদা কিছু না, হেলথ-লাইফস্টাইল বিষয়ক একটি টিভি রিয়েলিটি শো করতে যাচ্ছেন তিনি।
সোহেল তাজের ফেসবুক পেজে তার নানা পোস্টের নীচে তাকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি অনেকে প্রশ্ন করে চলেছেন। ‘মূলধারার রাজনীতিতে কেন নয়?’, ‘১২ পর্বের টিভি অনুষ্ঠান করে দেশ বদলাবেন?’, ‘মন্ত্রীর দায়িত্ব কেন ছেড়েছিলেন?’…এরকম নানা প্রশ্ন। সোহেল তাজ যদিও অতীতে নানা বক্তব্য, খোলা চিঠি ও সাক্ষাতকারে তার মন্ত্রিত্ব-সাংসদ পদ ছাড়া ও রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবার কারণ বলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তার বাল্যকালে পিতাকে কাছে না পাবার ব্যথা, দেশের প্রতি-দলের প্রতি তার পরিবারের আদর্শের কথা। তারপরও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আগ্রহের শেষ নেই সোহেল তাজকে নিয়ে, সামাজিক মাধ্যম আর টক শো’তে ‘নেপথ্যের নেপথ্য’ খুঁজে চলেছেন অনেকে।
আসলে সময়ের পরিক্রমায় অনেকে নতুন করে সোহেল তাজকে চিনেছেন, আবার অনেকে অনেক ইস্যুর ভিড়ে তার সেইসময়ের ঘটনা ভুলে গেছেন। সেজন্যই হয়তো নতুন করে এসব প্রশ্ন ফিরে আসছে। তবে একটি জিনিস খুব পরিষ্কার, তাজউদ্দিন আহমদের পুত্রের প্রতি দেশের মানুষের অনেক আগ্রহ।
সেই আগ্রহের সূত্র ধরেই কিছুটা পিছনে ফিরে সোহেল তাজ ও তার পরিবার বিষয়ে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ ও রাজনৈতিক কলাম সূত্রে যেসব তথ্য পেলাম, তাতে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবেন কৌতুহলি পাঠক।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও সোহেল তাজের বাল্যকাল
সোহেল তাজ ১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের সময়ে দেশ ছিল দারুণ উত্তাল, মুক্তিযুদ্ধ আর মহান স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্ব চলছিল। পিতা তাজউদ্দিন আহমদ তখন দেশের কাজে নিজেকে ঢেলে দিয়েছিলেন উজার করে। শিশু সোহেল তাজকে সামলে মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনও অবদান রেখে চলেছিলেন নানা সাংগঠনিক বিষয়ে। তার যখন মাত্র একবছর কয়েকমাস বয়স, তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-স্বাধীনতা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর আটক হওয়া, ২৫ মার্চের গণহত্যার পরে তাজউদ্দিন আহমদ নানা ঘটনাবহুল প্রেক্ষাপটের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভারতে অবস্থান নেন। ভারতে যাবার আগে একটি চিরকূটে তাজউদ্দীন স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘লিলি আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিয়ো। আবার কবে দেখা হবে জানি না…মুক্তির পর। ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেও। দোলন চাঁপা (বঙ্গতাজের ছদ্মনাম)।’
মার্চের শেষ সময়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শিশু সোহেল তাজ ও বোনদের নিয়ে মা জোহরা তাজউদ্দিন পাকিস্তান মিলিটারির নজর এড়িয়ে মে মাসে পৌঁছান ভারতে। দীর্ঘসময় যোগাযোগহীন থাকার পরে যখন তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তাদের দেখা হয়, তখন সেই সাক্ষাত ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের। জোহরা তাজউদ্দিন সেই সাক্ষাতের স্মৃতি তার বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য ও সাক্ষাতকারে যে বর্ণনা করেছেন, তা এরকম… গভীর রাতে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হলো স্বামীর সঙ্গে। কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর গৃহে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান জোহরাকে তাজউদ্দীন জানালেন যে, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশ যত দিন স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে মুক্তি না লাভ করবে, তিনি ততদিন পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। যুদ্ধাবস্থায় মুক্তিসেনারা যদি পরিবার ছেড়ে রণাঙ্গনে যেতে পারেন, তিনি তাদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেন পারবেন না। এরপর পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একই শহরে খুব কাছে অবস্থান করেও শিশু সোহেল তাজসহ তার পরিবার দেখা পাননি পিতা তাজউদ্দিনের। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়, পিতা তাজউদ্দিন তখন হাতে নেন আরেক মিশন। বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ গড়ার মিশন। রাতদিন এক করে তিনি তা করে গেছেন ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুর আগপর্যন্ত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে খন্দকার মোশতাকের নানা চাল-কৌশলে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল অনেক, যা ইতিহাসে লেখা আছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। পিতাকে না পাবার বাল্যস্মৃতি সোহেল তাজকে এই পরিণত বয়সেও যে তাড়া করে চলেছে, তা তার বিভিন্ন কথায় পরিষ্কার।
জোহরা তাজউদ্দিন ও আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানো
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার পত্নী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন (লিলি) ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য জুটি। একজন ধরেছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের হাল, অন্যজন চরম দুর্দিনে ধরেছিলেন আওয়ামী লীগের হাল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এর পরপরই রাষ্ট্রের সূচনালগ্নের নেতা তাজউদ্দিন আহমদ ও তার তিন সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে নেমে আসে অন্ধকার। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি প্রায় পুনঃ প্রতিষ্ঠিত। আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-কর্মীদের অনেকেই জেলে অথবা পলাতক।
নেতৃত্বের চরম শূন্যতার সময় ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে এক ঘরোয়া বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে জোহরা তাজউদ্দিনের ওপর অর্পিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। একজন সচেতন সমাজকর্মী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহরা তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রূপে দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। সে সময় জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকাল। বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ। দলের ওইরকম চরম দুর্দিনে সামরিক শাসক আরোপিত প্রবল বাধা-নিষেধ ও হুমকির মধ্যেও জোহরা তাজউদ্দিন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—রাস্তাঘাট ও বিদ্যুৎবিহীন দুর্গম এলাকাগুলো ভ্রমণ করে আওয়ামী লীগে প্রাণসঞ্চার করেন। নেতা–কর্মীদের উজ্জীবিত করেন, ধীরে ধীরে রাজনীতি তার প্রকৃত রূপ ফিরে পেতে থাকে। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোহেল তাজের মা জোহরা তাজউদ্দিনের এই অবদান আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটসহ নানা ইতিহাস গ্রন্থে স্মরণীয় হয়ে আছে। পিতা-মাতার রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সোহেল তাজ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
রাজনৈতিক জীবনের উত্থান পতন
নানা সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সোহেল তাজ ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে একই আসন থেকে আবারও নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সোহেল তাজ। তবে সেই পদে তিনি বেশিদিন থাকেননি, ওইবছরই ৩১ মে মন্ত্রিসভা থেকে ব্যক্তিগত কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। আর ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার পদত্যাগপত্র তখন গ্রহণ করা না হলে, ২০১২ সালের ৭ জুলাই তিনি আবার পদত্যাগপত্র পেশ করেন; তখন তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়।
কেন তিনি মন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করলেন? কেন সংসদ সদস্য পদ ছাড়লেন? কেন রাজনীতি থেকে দূরে গেলেন? এরকম নানা বিষয়ে প্রশ্ন তাকে সেসময় ফেস করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মন্ত্রী পদ থেকে তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে বিভিন্ন অসমর্থিত তথ্য ও গুজব প্রচলিত থাকলেও সাংসদ পদত্যাগের পরপরই তিনি ঘটনা প্রবাহে এসবের জবাব দিয়েছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি গণমাধ্যমে একটি খোলা চিঠি পাঠান। তার নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে লেখা সেই চিঠিতে অনেক ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন।
সোহেল তাজ তার ওই খোলা চিঠিতে সেসময় লিখেছিলেন, ‘সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা, ভালোবাসা, স্নেহ- আমার জন্য এলাকার মানুষের ত্যাগ স্বীকার, আবেগ এই সবকিছু চিন্তা করার পরও বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কাপাসিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।’
কী কারণে পদত্যাগ করলেন, সে বিষয়ে ওই চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কথার পেছনে অনেক কথা থাকে। অনেক লুক্কায়িত সত্য থাকে – যা দেশ, জনগণ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে জনসম্মুখে বলা উচিত না। আর তা সম্ভবও নয়। শুধু এইটুকু বলি, আমি ‘সংগত’ কারণেই এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি।’
মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অভিজ্ঞতা বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, যে কয়দিন দায়িত্বে ছিলেন, মন্ত্রিত্বের শপথ থেকে বিচ্যুত হননি। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দুর্নীতি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সোচ্চার ছিলাম- একথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘যখন মনে করেছি, আমার সীমিত ক্ষমতায় জনগণের প্রতি দেওয়া কমিটমেন্ট আর রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি তার অনুরাগ ও শ্রদ্ধার বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সক্রিয় রাজনীতিতে পুনরায় আসার সম্ভাবনা না থাকলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার বাবা তাজউদ্দিন আহমদের আদর্শে গড়া আওয়ামী লীগই আমার শেষ ঠিকানা। কারণ, এ দলটির সঙ্গে আমার বাবার রক্ত মিশে আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েছেন। কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত করেননি। জীবন দিয়েও তা প্রমাণ করে গেছেন।’
রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার সম্ভাবনার বিষয়ে লিখেছিলেন, সক্রিয় রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা তার নেই। তবে তিনি ‘প্রতিজ্ঞা করেছেন’ সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তিনি কাপাসিয়াবাসীর পাশে থাকবেন সবসময় – হয়ত অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনো পথে।
তার পদত্যাগের পরেও মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের ভাতা হিসেবে তার ব্যাংক একাউন্টে মাসে মাসে ভাতা নিয়মিত জমা হয়েছিল। পদত্যাগের ৩৩ মাস পরেও কেন তার একাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে, তা জানতে চেয়ে ও সেই টাকা সরকারকে ফিরিয়ে নিতে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ২ দফা চিঠিও দিয়েছিলেন। বর্তমানে একজন প্রতিমন্ত্রীর মাসিক বেতন ৯২ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন সরকারি বরাদ্দ, ভাড়া-ইউটিলিটি বিল মিলিয়ে মাসে আরো লাখ টাকা। সেসময় হয়তো প্রতিমন্ত্রীর বেতন-ভাতা কম ছিল, তারপরেও ৩৩ মাসে যে টাকা তার একাউন্টে জমেছিল, তা তিনি প্রত্যাখান করেছেন অনন্য আদর্শ ও নৈতিক অবস্থানে থেকে। তাছাড়া মন্ত্রী পদ নিজে থেকে ছেড়ে দেবার যেকয়টি উদাহরণ দেশের ইতিহাসে আছে, তারমধ্যে তিনি অন্যতম।
সোহেল তাজ এরপর দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান পরিবারের কাছে, নিজের বাল্যকালের স্মৃতি মাথায় রেখে পুত্র-কন্যাদের বেশি বেশি সময় দিতে থাকেন। তার অবর্তমানে কাপাসিয়া থেকে নির্বাচন করেন তার বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি। পরে অবশ্য সোহেল তাজ দেশে ফিরে আসেন এবং পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সূত্রে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগও রেখে চলেছেন।
বর্তমানে টিভি শোর সংবাদ সম্মেলনে বলা কথা
‘হটলাইন কমান্ডো’ নামে ১২ পর্বের যে টিভি অনুষ্ঠান তিনি করতে যাচ্ছেন, তার ঘোষণামূলক সংবাদ সম্মেলনে সোহেল তাজ অনেক কথা বলেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম সরাসরি প্রচার হওয়া ছাড়াও সামাজিক মাধ্যমে সেই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও বহু লাইক-শেয়ারে ছড়িয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সোহেল তাজ মানুষের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থতা নিয়ে কথা বলেন। এ ছাড়া সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা ও অসংগতি তুলে ধরেন। উপস্থিতি গণমাধ্যম কর্মীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন, বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল রাজনীতি বিষয়ক।
আবার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, প্রশ্নের জবাবে সোহেল তাজ বলেন, ‘রাজনীতিতে আমি নাই। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। রাজনীতি আমার রক্তে, দেশ আমার রক্তে। এটার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই। এই মুহূর্তে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করার সুযোগ নাই। এই প্রোগ্রামটা আমার সমস্ত সময় নিয়ে নেবে। মানুষের কাছে আমি ঋণী। মানুষের ভালোবাসা পরিশোধ করতে যাচ্ছি এই প্রোগ্রামটার (হটলাইন কমান্ডো) মধ্য দিয়ে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যদি সোহেল তাজকে কোনো রাজনৈতিক দায়িত্ব দেন, তা তিনি গ্রহণ করবেন কি না-জানতে চাইলে সোহেল তাজ বলেন, তিনি ও তার পরিবার দেশের ও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে পাশে ছিল, থাকবে। আজকের সুদিনে থাকবেন কি না প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সুদিনে আমি অন্যভাবে সহায়তা করছি।’
দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল তাজ বলেন, ‘যেকোনো দেশ যদি উন্নতি করতে চায়, তার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। আমি শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের সন্তান হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে অবশ্যই চাই, বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে। ব্যক্তিগতভাবে সে লক্ষ্যে আমি কাজ করে যাব। এই প্রোগ্রাম হচ্ছে সামাজিক বিষয়বস্তু নিয়ে, সোনার মানুষ তৈরি করা নিয়ে।’
শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি সমাজের সুস্থতাও দরকার উল্লেখ করে সোহেল তাজ বলেন, ‘সুস্থ থাকা মানে শুধু স্বাস্থ্যই না; সমাজের সুস্থতাও দরকার। গণমাধ্যমে এখন ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইভটিজিং রয়েছে, মাদক—এগুলো সমাজের ব্যাধি। সমাজের সব ব্যাধিকে আমাদের লাল কার্ড দেখাতে হবে। সমাজের সমস্যাগুলোকে সমাধান করা না গেলে সোনার বাংলা গড়া যাবে না।’
সামাজিক সুস্থতা না থাকলে কী নিয়ে রাজনীতি, এরকম প্রশ্ন করে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘একটা সমাজ যদি প্রস্তুত না থাকে, আপনি কী রাজনীতি করবেন? রাজনীতি কাকে নিয়ে করবেন? সমাজ গড়তে পারলে, মানুষকে তৈরি করতে পারলে, সবকিছুরই সমাধান চলে আসে। হয়তো এটাই আমার পন্থা রাজনীতি করার।’
সংবাদ সম্মেলনের পরে তিনি কয়েকটি টক শো’তে অংশ নিয়েছিলেন, সেখানেও তাকে ঘুরে ফিরে একই ধরণের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। জবাবও তিনি প্রায় একইরকম দিয়েছেন। তিনি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ক্ষুদ্র অবস্থানে থেকেও কিছু করার পারিবারিক আদর্শ-শিক্ষা ও নিজের ইচ্ছার কথাও বলেছেন। সবাইকে কেন সবকিছু অবশ্যই করতে হবে, কিছু করতে হলে কোনো প্ল্যাটফর্মে কেনো থাকতেই হবে… এসব প্রশ্নও তিনি ছুড়ে দিয়েছেন টক শো’তে।
বিষয়গুলো দেখে একজন সাধারণ দর্শক-পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে, টিভি অনুষ্ঠানকে ক্ষুদ্র পরিসর উল্লেখ করে অনেকে সেখানে সোহেল তাজকে দেখতে চাচ্ছেন না। অনেকে হয়তো চাইছেন, সোহেল তাজ আওয়ামী লীগ থেকে সরে গিয়ে নতুন কোনো প্ল্যাটফর্ম তৈরি করুক, উত্তেজনা তৈরি হোক। অনেকে আবার হয়তো চাইছেন, তিনি আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে এসে মূলধারার রাজনীতি করুক। সারমর্ম হিসেবে মনে হয়েছে, পিতা তাজউদ্দিনের অনন্য অবদানকে মাথায় রেখে সোহেল তাজের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার পারদ বেশ উচ্চ অবস্থানে আছে।
অতীত-বর্তমান প্রেক্ষাপট আর জনগণের প্রত্যাশা যাই হোক না কেন, সোহেল তাজ হয়তো তার মতো করেই ভাববেন এবং কাজ করে যাবেন। আর তার টিভি অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্ব সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির জনগণসহ তার পক্ষে-বিপক্ষের রাজনীতির মানুষরাও আগ্রহ ভরে দেখবেন বলেও মনে হচ্ছে। তার এই উদ্যোগ কীভাবে-কতটুকু সমাজ পরিবর্তন করছে, তাও হয়তো সময় বলে দেবে। সেপর্যন্ত তাজউদ্দিন আহমদ পুত্র’র প্রতি রইল শুভ কামনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)