মাঝি স্রোতের প্রতিকূলে নৌকা চালিয়ে গেলে তার গতিবেগ অংক করে বের করা সম্ভব। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যে নৌকার পথচলা শুরু হয়েছে তার গতিবেগ কোনো সূত্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করে সমাধান করা সম্ভব নয়।
নৌকা স্রোতের প্রতিকূলে বয়ে গিয়ে প্রথম কূলের দেখা পায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। ২৩৭ আসনের বিপরীতে জয়লাভ করে ২২৩ টি আসনে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। আর নৌকার প্রধান মাঝি ছিল পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু মাত্র দেড় মাসের মাথায় যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। কিছুটা টালমাটাল হয়ে যায় নৌকা, কিন্তু মাঝি শক্ত হাতে মাস্তুল ধরলেন এবং এটা একদিনে হয়নি।
৫৪ এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পাওয়ার পরেও এহেন অবস্থার পরেই বঙ্গবন্ধু চিন্তা করলেন এখনি সঠিক সময় হিন্দু মুসলিম সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার, তাই তিনি ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাতিল করার প্রয়াস চালান। শুরু করলেন হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমাদারে গ্রহণের আরেক সংগ্রাম এবং তা করতে হলে যে “মুসলিম” শব্দটি আওয়ামী থেকে বাদ দিতে হবে।
যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় তখন সে মিটিং ঠিক করেন হোসেন শাহ সোহরাওয়ার্দী সামনে রেখে কিভাবে এর আত্বপ্রকাশ তারা ঘটাতে পারেন? নীতিগত সিগ্ধান্ত হয় “আওয়ামী মুসলিম লীগ” থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়ার। হ্যা, এর জন্য দরকার একটা সমাবেশ, যে সমাবেশের মাধ্যমে নতুন “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ সকল পত্রিকায় হেডলাইনও হবে।
সকল নেতাই মত দেয় পল্টনে সমাবেশের কিন্তু শেখ মুজিব প্রথম সমাবেশটি নারায়ণগঞ্জে করার প্রস্তাব দেন। সবার চোখই কপালে, এটা কি করে সম্ভব! কারণ নারায়ণগঞ্জ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্থানের সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম লীগের ঘাটি। আতিউর রহমান এর জন্য শেখ মুজিবকে ধমকের সাথে চুপ থাকতে বলেন। শহীদ সাব সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে। বড় বড় নেতারা ধমক দেয় শেখ মুজিবকে। তিনি রিস্ক নিয়ে শহীদ সাবকে বলেন-মঞ্চের সকল দায়িত্ব তার, এ নিয়ে বিজ্ঞ নেতৃত্বকে ভাবতে হবে না।
মিটিং এর পরেই নারায়ণগঞ্জ এ প্রথম সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। পূর্বের দিনই মঞ্চের সকল কাজ শেষ করেন শেখ মুজিব তার নেতৃত্বে। সন্ধ্যার পর মুসলিম লীগ নেতারা পুড়িয়ে দেয় “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” এর মঞ্চ। শহীদ সাব দুশ্চিন্তায় পড়েন, শেখ মুজিব খুশি।
পরের দিন সকালে শহীদ সাব পত্রিকাগুলো কালেক্ট করে মুজিবকে ডেকে পাঠায়। মুজিবের জন্য প্রতীক্ষা যেন শেষ হয় না সোহরাওয়ার্দীর । মুজিব আসার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে পরম স্নেহে। কারণ, মঞ্চে সমাবেশ সফল করে শেখ মুজিব। প্রতিটি পত্রিকার হেডলাই শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। মুসলিম শব্দটি বাদ পড়েই গেল।
ওই দহন মঞ্চ সেজেছে আগামীকাল সোহরাওয়ার্দী নামের সেই রেসকোর্স ময়দানে…
বঙ্গবন্ধু মাত্র ২৯ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক হন এবং ৩৩ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক হন। এ থেকে প্রতীয়মান হন তিনি তৃণমূলে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তৃণমূলের সাথে তিনি কতটা সম্পৃক্ত ছিলেন।
৫২ এর রাষ্ট্রভাষা দাবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করতে বাধ্য হল পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। তারই ধারাবাহিকতায় ৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ১৯৬৬, নৌকার মাঝি উপস্থাপন করলেন “ম্যাগনাকার্টা”, যাকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ। ঐতিহাসিক ৬ দফা। পাকিস্তানের মাটিতে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের সমাবেশে উপস্থাপিত হল ৬ দফা। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। ৬ দফাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করলেন আইয়ুব গংরা।
অতঃপর নৌকার মাঝি জাতির পিতা শেখ মুজিবের উপর নেমে আসলো শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচার। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে! “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য” শিরোনামে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। উত্তাল সমুদ্র হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তান। রাজপথে নেমে আসে নৌকার যাত্রীরা, মুক্ত করতে প্রাণের মাঝিকে।
মাঝি ছাড়া দিশেহারা যাত্রীরা। দীর্ঘ আন্দোলনের শেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে তীব্র আন্দোলনের মুখে মুক্তি দেয় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। দীর্ঘ কারাবরণে নৌকার যাত্রীরা মুক্তির পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রাণপ্রিয় মাঝিকে ভূষিত করে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে। তার আগে রক্তে ভিজে গিয়েছে আসাদের শার্ট আর মতিউরের জামা। মুক্তির পর দুরদর্শী মাঝি বুঝে ফেললেন ৬ দফা আদায় না করে নিলে যাত্রীরা তীরে পৌঁছার আগেই ডুবে মারা যাবে। তাই মাঝি ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ করেন “বাংলাদেশ”।
সে থেকে অপেক্ষার পালা গোনা শুরু। ১৯৭০ এর ভয়াবহ সাইক্লোনে মারা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের অবহেলায় দুর্গত অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হল জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। ১৬৯ আসনের ১৬৭ আসনে জয় পেয়ে বিপুল ব্যবধানে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবুও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নৌকার মাঝি এবং যাত্রীকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বঞ্চিত করে।
ফুঁসে উঠে জনগণ। ততোদিনে নৌকার মাঝি এবং যাত্রীদের ধ্বংস করার নীল নকশা করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। চালায় গণহত্যা। বন্দি করে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৩০ লক্ষ প্রাণ আর ৪ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে মুক্ত হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নৌকা পৌঁছে যায় তার নির্দিষ্ট গন্ত্যবে, তার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে বিপুল।
মাত্র ১ বছরের মাথায় সংবিধান প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। জাতিসংঘ, OIC, কমনওয়েলথের স্বীকৃতির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেন নৌকার মাঝি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তারপর আবারো স্বপ্নভঙ্গ। পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রে এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতার পরিবারকে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। এবার সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত নৌকার যাত্রীরা। চারিদিকে যখন ঘোর অন্ধকার, কোন আশায় যখন আর রইল না, তখন মঞ্চে আবির্ভুত হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। রবি ঠাকুরের ভাষায় শেষ হইয়াও হইল না শেষ…
চাঞ্চল্য ফিরে আসলো নৌকার যাত্রীদের মাঝে। তেজদীপ্ত সূর্যের মত উদ্ভাসিত হল প্রতিটি যাত্রী। এ যেন ফিনিক্স পাখি। শুরু হল নতুন সংগ্রাম। লড়াইটা জারি থাকলো। স্বৈরচারের বুলেটবিদ্ধ নির্যাতনের শিকার হলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা। বুক পেতে দিলো নৌকার অসীম সাহসী যাত্রীরা। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন।
অনেক সংগ্রামের পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার লড়াই শুরু করলেন। দীর্ঘ ৫ বছর মানুষের মুক্তির জন্য নিরলস কাজ করে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের কাছে পরাভূত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো নৌকার মাঝিকে। কারণ শেখ হাসিনাকে সরাতে পারলেই বাংলাদেশকে লুট করা সম্ভব, একাত্তরের পরাজিতপক্ষ তা ভালোই জেনে গেছে ততদিনে। নেমে আসলো রাষ্ট্রীয় বর্বরতা। তাজা ১২ টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হল।
এ যাত্রায় রাখে আল্লাহ মারে কে, ভাগ্যচক্রে বেঁচে ফিরলেন। তীব্র আন্দোলনের সংগ্রামের মাধ্যমে আবারো তীরে উঠতে সক্ষম হল নৌকার যাত্রীরা।
সালটা ২০০৯। দৃশ্যপটে শেখ হাসিনা। পালটানা নৌকা এবার উন্নয়নের নৌকায় পরিণত হল।
এবার শুধুই অর্জন।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৪,০৭৭ মেগাওয়াট, খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে ১০ম, ধান উৎপাদনে চতুর্থ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১০০টি, রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি আয় ৩৪.৪ বিলিয়ন ডলার, রেমিটেন্স ১৫.৭২ বিলিয়ন ডলার, মাথা পিছু আয় ১,৪৬৬ ডলার, জিডিপি ৭.০৫%, ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সহসভাপতির দায়িত্ব, গোল্ডম্যান স্যাকসের নেক্সট-১১ এর অন্যতম বাংলাদেশ, চারিদিকে অর্জনের স্বীকৃতি। এ শুধুই বাংলাদেশের অর্জন। কিন্তু যার হাত ধরে এ অর্জন তিনিও ছিনিয়ে এনেছেন অসংখ্য পুরুষ্কার, দেশকে নিয়ে গেছেন অন্যান্য উচ্চতায়।
মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বসের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় ৩৬তম শেখ হাসিনা, ফরচুন ম্যাগাজিনের শীর্ষ ৫০ নেতার তালিকায় ১০ম, সাউথ সাউথ পুরুষ্কার, চ্যাম্পিয়ন্স অব দা আর্থ সহ অসংখ্য পুরুষ্কার।
এসব অর্জনের পিছনে ছিলেন দুজন দক্ষ মাঝি। এক মাঝির হাত ধরে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আরেক মাঝির নেতৃত্বে আমরা বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। আজ বাংলাদেশের একজন নারী নেত্রী শত বাধা প্রতিকুলতা পেরিয়ে সারা বিশ্বে জায়গা করে নিয়েছেন স্বমহিমায়। এ যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসের মত “A man can be destroyed but not defeated”. অন্তহীন ছুটে চলা…
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)