চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সোনালী দিনের সেইসব গান

গান শুনতে আমরা কম-বেশি সবাই ভালোবাসি। কাজের ফাঁকে বা অবসরে, মন ভালো থাকলে বা খারাপ থাকলে; কোনো না কোনো কারণে আমরা গান শুনি। আর গান পাগলা আর সিনেমা ভক্তদের তো কথাই নেই। কিছু কিছু গান আছে যা সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, মন জয় করে নিয়েছে।

বাংলা সিনেমায় কিছু গান গীতিকারের লেখনীর ছোঁয়ায়, সুরকারের প্রতিভায় আর কন্ঠশিল্পীর যাদুতে কালজয়ী করে করেছেন। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর সত্তরের দশক ছিলো বাংলা সিনেমার এক সোনালী যুগ। ওই সময়ে চলচ্চিত্রের গানগুলোর বিকাশ হয়েছে অনেক বেশি। সেই যুগে সমৃদ্ধ হয় বাংলা গানের ভান্ডার।

বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় গানের তালিকায় প্রথমেই চলে আসে চিরসবুজ নায়ক রাজ রাজ্জাক ও নায়িকা সুজাতার সেই গানটি। ১৯৬৮ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালনায় সাড়া জাগানো এতোটুকু আশা  সিনেমার ‘শুধু ‘একবার বলে যাও আমি যে তোমার কতো প্রিয়’ গানটি। গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুরকার সত্য সাহার এই অসাধারণ গানে কন্ঠ দিয়ে তাকে চিরসবুজ করে তোলেন খন্দকার ফারুখ আহমেদ ও শাহনাজ রহমতুল্লাহ। 
রাজ্জাক-কবরী জুটির অসাধারণ এক সিনেমা ময়নামতি। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় সিনেমাটি। সেই সময়ের দর্শক হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছিল শিল্পী বশির আহমেদের ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন ছিড়ে যায়’ গানটি। কাজী জহির পরিচালিত সিনেমাটির এই কালজয়ী গানের গীতিকার সৈয়দ শামসুল হক।
১৯৬৯ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালিত আরেকটি কিংবদন্তী চলচ্চিত্র হলো ‘নীল আকাশের নিচে’ । সত্তরের দশকের এই সিনেমাটিকে সবাই এখনো মনে রেখেছে এর ‘প্রেমের নাম বেদনা সে কথা বুঝিনি আগে’ সুপারহিট গানটির জন্য। রাজ্জাক ও মিষ্টি মেয়ে খ্যাত নায়িকা কবরী অভিনীত সিনেমার এই গানটি সবথেকে জনপ্রিয় গান হিসেবে এখনো রয়েছে শীর্ষস্থানে। আর এই গানটি গেয়ে অনেক প্রশংসিত হন শিল্পী মাহমুদুন নবী। গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও মনিরুজ্জামান এবং সুরকার সত্য সাহা।
‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন, কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে’  ১৯৭০ সালে  নাচের পুতুল  ছায়াছবির সেই কালজয়ী গানটির সঙ্গে যে দুটি মুখ ভেসে উঠে তারা হলেন রাজ্জাক ও এক সময়কার সাড়া জাগানো নায়িকা শবনমের মুখ। অশোক ঘোষের পরিচালনায় গানটিতে কন্ঠ দেন মাহমুদুন নবী। হৃদয় ছোঁয়া এই গানটির সুরকার রবিন ঘোষ ও গীতিকার মনিরুজ্জামান।
কম জনপ্রিয় ছিলো না নায়ক বুলবুল আহমেদ ও নায়িকা ববিতার ‘যদি বউ সাজোগো বড় সুন্দর লাগবে’ গানটি। ওয়াদা  চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন বুলবুল আহমেদ নিজেই। বাংলা সিনেমার ভীষণ রোমন্টিক এই গানটিতে কন্ঠ দেন মো: খুরশিদ আলম ও রুনা লায়লা।
১৯৭২ সালে পরিচালক কামাল আহমেদের অশ্রু দিয়ে লেখা  নায়ক রাজ রাজ্জাক ও নায়িকা সুজাতা অভিনীত সিনেমাটি অনেক আলোড়ন তৈরি করেছিলো। সিনেমাটি দেখার পাশাপাশি সিনেমা হলগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকতো গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেওনা’ গানটি শোনার জন্য। সাড়া জাগানো এই গানটির গীতকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুরকার আলী হোসেন।
‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা আর তো প্রাণে সয়না’ সাবিনা ইয়াসমিনের কন্ঠে গাওয়া এই গানটি সত্তর এর দশকের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অতিথি  সিনেমার এই গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও সুরকার সত্য সাহা।
সারেং বৌ ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি কিংবদন্তী বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল্লাহ আল মামুন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা নির্মিত এই ছবিটিতে আবদুল জব্বার এর কণ্ঠে গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। গানটির সুরকার আলম খান ও গীতিকার মুকুল চৌধুরী। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্পে নির্মিত এই ছবিটিতে অভিনয় করেন ফারুক, কবরী, আরিফুল হক, জহিরুল হক, বিলকিস, বুলবুল ইসলাম, ডলি চৌধুরীসহ অনেকে।

‘ইটুস খানি দেখো, একখান কথা রাখো, ভালোবাইসা একবার তুমি বউ কইয়া ডাকো’ বাংলাদেশী সিনেমায় এ যাবতকালের যতো সুপার হিট গান আছে তার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে বুলবুল আহমেদ ও নায়িকা কবরীর এই গানটি। ১৯৭৮ সালে ‘বধূ বিদায়’ সিনেমার এই গানটির সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। 
‘আরে ও প্রাণের রাজা, তুমি যে আমার, কাছে কাছে থেকো চাই না কিছু আর’ নায়ক খসরু ও নায়িকার শাবানার বাদশাহ ছবির রোমান্টিক এই গানটি ৮০’র দশক থেকে শুরু করে জনপ্রিয় রোমান্টিক গানের তালিকায় এখন পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে তার স্থান দখল করে আছে। মন ছুঁয়ে যাওয়া রোমান্টিক এই গানটিতে কন্ঠ দেন উমা খান ও প্রবাল চৌধুরী। গানটির সুরকার আলী হোসেন ও গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
রুনা লায়লা ও অ্যান্ডু কিশোরের গাওয়া ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে; তোমার মুখের কথা না শুনিলে’ গানটি তখনকার তরুণ প্রজন্মসহ সবার কাছে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত দুই জীবন  সিনেমাটি ১৯৮৬ সালে মুক্তি পেলেও গানটির জনপ্রিয়তা এখনো রয়েছে। রোমান্টিক এই গানটির গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির ও সুরকার আলম খান। 
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে সবার মন জয় করে নিয়েছে ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানটি। চিরস্মরণীয় এই গানটিতে কন্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা ও অ্যান্ড্রু কিশোর। পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোসনা  সিনেমাটির গীতিকার তিনি নিজেই। আর সুর করেছেন আবু তাহের। গানটির ব্যাপাক জনপ্রিয়তাই সিনেমাটিকে ব্যবসা সফল করে।
হাজারো ভক্তদের কাঁদিয়ে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে বিদায় নিলেও নায়ক জাফর ইকবালকে একটি গানেই কেউ ভুলতে পারবেন না। মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘অবুঝ হৃদয়’ সিনেমার ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন, দুজন দুজনার কত যে আপন’ বিখ্যাত গানটির শিল্পী রুনা লায়লা ও অ্যান্ড্রু কিশোর। গানটির গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল, ববিতা ও চম্পা অভিনীত ত্রিভুজ প্রেম কাহিনী নিয়ে তৈরি সিনেমার এই গানটির জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি।
১৯৯২ সালে বাংলা চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের গানের জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলো সোহানুর রহমান সোহানের পরিচালিত কালজয়ী সিনেমা কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। আর এই সিনেমাটির একটি গানের জনপ্রিয়তার সঙ্গে টেক্কা দিতে এখনো অনেক গানের কাঠখর পোড়াতে হয়। আর গানটি হলো ‘ও আমার বন্ধু গো চির সাথী পথ চলার’। সারাজীবনের জন্য মনে গেঁথে যাওয়া এই রোমান্টিক গানটির শিল্পী আগুন ও রুনা লায়লা। স্মরণীয় এই গানটির  সুরকার আলম খান ও গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির।

চলচ্চিত্র জগতের ৬০ থেকে ৯০’র দশকের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া অসাধারণ এই গানগুলোর সফলতার পিছনে শুধু কন্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকারদেরই অবদান রয়েছে তা কিন্তু নয়। সোনালী ফ্রেমের সোনালী এই গানগুলোতে যে কিংবদন্তী নায়ক-নায়িকারা অভিনয় করেছেন তাদের অবদানও অসামান্য।

গানগুলোতে তাদের রোমান্টিক ও ট্র্যাজেডিক অভিনয়ে গানগুলোর গভীরতা ও মাধুর্যতা আরো সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠেছে।