রবীন্দ্রনাথের ‘ঘাটের কথা’ (রচনাকাল- কার্তিক, ১২৯১) থেকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত’ (গ্রন্থটির প্রকাশকাল, ১৩৯৩) গল্পটির রচনাকাল তার সামান্য আগেই, এটা ধরেই আলোচনা (সময়ের পথ চলার দুলকি চাল যেন ঘাটের কাছে নদীর ছলাৎ ছল গল্প বলা এক পরিক্রমা)। উনিশ বিশের সমাজ তত্ত্বের যে আঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলতে ঘরের আগল ভাঙার একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সময় যে সেই আগলটিকে ভেঙে চুরমার করে এক নোতুন অর্গলবিহীন হৃদয়বৃত্তে মানব সমাজকে প্রতিষ্ঠা করছে না, সেই আগলাকাসা জীবনের দিকে, জীবিকার দিকে, মনের দ্বন্দ্বকে সময়ের যবনিকাতে উপস্থাপিত করছে– সিরাজ সেটাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন ভ্যান গখের মতো একটা অনবদ্য ক্যানভাসে।
সময়কে বিনি সুতোর মালায় গাঁথতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন; “পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও তবে আমার এই ধাপে বইস; মনোযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে।” জলকল্লোলে কান পেতেই সিরাজ তুলে আনেন সময়ের আর এক টিকছাপ, যেখানে, “…জ্যোৎস্নামাখা বালিতে আঁচড় কাটতে থাকল প্রেমিক যুবক।” দিনের পরতে সময়ের গ্রন্থিমোচন রবীন্দ্রনাথের মতোই একটা ছন্দবদ্ধ ভঙ্গিমায় করবার ভিতর দিয়ে সিরাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন, রবীন্দ্রসৃষ্টির জলের সঙ্গে স্থলের গলাগলির কাকুতি রাঢ়ের ঢেউয়ের উথাল পাতালের ভিতর দিয়ে সভ্যতার ভাঙাগড়ার ঢেউয়ের চিহ্ন হয়ে ওঠে। সেই চিহ্ন যেন বাঙালি জীবনের সামাজিক ইতিহাসের একটি পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য হয়ে সারস্বত সমাজের কাছে উঠে আসে।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “তোমরা যেমন ঠিক মনে করিতে পার না, তোমাদের দিদিমারাও সত্য সত্যই একদিন খেলা করিয়া বেড়াইতেন, আজিকার দিন যেমন সত্য, যেমন জীবন্ত, সেদিন ও ঠিক তেমনি সত্য ছিল, তোমাদের মতো তরুণ হৃদয়খানি লইয়া সুখে দুঃখে তাঁহারা তোমাদেরই মতো টলটল করিয়া দুলিয়াছেন, তেমনি আজিকার এই শরতের দিন- তাঁহারা – হীন , তাঁহাদের সুখদুঃখের – স্মৃতিলেশমাত্র – হীন আজিকার এই শরতের সূর্যকরোজ্জ্বল আনন্দচ্ছবি- তাঁহাদের কল্পনার নিকটে তদপেক্ষাও অগোচর ছিল।”
স্মৃতি, আবেগের আবীলতায় কেবল ভেসে থাকেননি রবীন্দ্রনাথ। একটা আলোর প্রয়াসী মনকে তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টির মতোই এখানেও তিনি গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। জেরেন্টৌলজি কেন্দ্রিক যে সমস্যা এই নয়া উদার অর্থনীতির যুগে প্রতি পলে পলে আমরা অনুভব করছি, আজ যেন প্রায় দেড়শো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যেমন সেটি অনুভব করেছিলেন, তেমনিই গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার সঙ্কট, যা ‘ফালতু’র জীবনের নানা সঙ্কটের ভিতর দিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ– একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে রচিত এই দুটি সৃষ্টি যেন মানবসভ্যতার ঘনায়মান সঙ্কটের স্বরূপের পূর্বাভাস হিশেবে আমাদের সামনে উঠে আসে।
আজ যখন বার্ধক্যজনিত সমস্যা, বিশেষ করে প্রজন্মান্তরজনিত সঙ্কট গোটা বিশ্বকে বার বার ভাবাচ্ছে, তখন বুড়ি ঠাকুমার প্রতি সময়ের স্মৃতিকাতরতা ঘিরে রবীন্দ্র আখ্যান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, উনিশ শতকের প্রথম যুগের সামাজিক প্রেক্ষিত আর বিশ শতক যখন প্রায় অস্তগামী, সেই সময়ক্ষেপনের কালপর্বেও ‘পরিচয়’ ঘিরে সঙ্কট, গোটা মানব সমাজকে কতো গভীর অসুখের ভিতরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই অসুখ নিরাময়ে কজন বৈদ্য ই বা সক্রিয় হয়েছেন এই কালান্তক কালে- সে প্রশ্ন ও যেন আমাদের কাছে, একুশ শতকের সামাজিক সঙ্কটের ব্যাপক ঘূর্ণাবর্তে বার বার ই একটা বড় রকমের জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে দেখা দেয়।
সিরাজ যেভাবে গ্রামগ্রামান্তরে কখনো আলকাপের দলের সঙ্গে, কখনো বা কমিউনিস্ট পার্টিরকর্মী হয়ে ঘুরেছেন, দেখেছেন, চিনেছেন মানুষকে, জেনেছেন তাঁদেরকে, এমনটা গোটা বাংলা সাহিত্যে তাঁর সমতুল আর মাত্র একজনকেই পাওয়া যায়, তিনি হলেন সমরেশ বসু, সোমেন চন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, শওকত ওসমান, শহীদুল্লাহ কায়সার , আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো মানুষেরাও তাঁদের সৃষ্টিকে কখনো কেতাবী বিদ্যা আর কল্পনা বিলাসের জারকে অভিষিক্ত করেন নি। তবে সমরেশ বসু আর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মাপের মানুষরতনকে দেখা, চেনার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লেখক, বাংলা সাহিত্য খুব একটা পায়নি। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথ সমরেশ বা সিরাজের সমতুল, কার্যত বাউন্ডুলের মতো না ঘুরলেও, পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অর্থভিত্তিক এবং বর্ণভিত্তিক পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গে তাঁর সংযোগ কোনো অংশে কম ছিল না। তাই লেখালেখির প্রায় সূচনাপর্বেই ‘ ঘাটের কথা’ র ভিতর দিয়ে বয়ঃকালীন সমস্যা এবং সেই সমস্যাকে ঘিরে, সেই সময়কাল, যখন সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ড আজকের থেকে একদম ভিন্ন ছিল, নিউক্লিয়ার পরিবারের ন্যুনতম প্রকাশ কোথায়, কখনো, এতোটুকু প্রতিভাত হয়নি, যৌথ পরিবারই বাংলার সামাজিক পরিকাঠামোর একমাত্র পারিবারিক পরিকাঠামো, সেখানে একটা চোরাস্রোতের মতো জেরেন্টোলজি জনিত সঙ্কট আর সেই সঙ্কট যে বাঙালির সামাজিক পরিকাঠামোকে আগামী দিনে ভয়ঙ্করকমভাবে ছাড়খার করতে চলেছে, তার পূর্বাভাস রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। সমরেশ, সিরাজের মতো বন্ধনহীন গ্রন্থিকে পথ আর সময়কে না বেঁধেও, সমাজবীক্ষণের যে মর্মবস্তু তিনি আরোহন করে আনছেন, তাতে মনে হয়, সমরেশের ‘মানুষ ‘ বা ‘মানুষ রতন’ কিংবা সিরাজের ‘ রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত’বা ‘ গোঘ্নে’ র একটা সময়োচিত খসড়াই ‘ ঘাটের কথা’তে রবীন্দ্রনাথ করে গিয়েছেন।
নারীর অসহায়ত্বকে যেমন গোটা সময়ের অসহায়তার নিরিখে উনিশ শতকের প্রথমাব্দে উদীয়মান গ্রামীন মধ্যবিত্তের পটভূমিকাতে এই ‘ ঘাটের কথা’ ছোটগল্পের ভিতরে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছিলেন, সেই প্রেক্ষিত বিশ শতকের প্রায় শেষ লগ্নে কেবল নারী নয়, মানুষের অসহায়তা, সেখানে লিঙ্গগত লক্ষণরেখাকে অতিক্রম করে, নারী- পুরুষ সকলেরই অস্তিত্ব ঘিরে ঘনায়মান সঙ্কটকে মেলে ধরেছেন সিরাজ তাঁর ‘নারীর ঘাটের বৃত্তান্তে’। ফালতু’র মাকে ঘিরে ছোট একটি গ্রামীণ সমাজে যে ঢেউ, তার ভিতর দিয়ে গোটা সমাজের একটা নখদন্তহীন ছবি সিরাজ মেলে ধরেছিলেন। বাস্তব অভিজ্ঞতার জীবন্ত চিত্র যদি সিরাজ তাঁর নিজের জীবন দিয়ে সঞ্চয় না করতে পারতেন, এমন গল্প তাহলে তাঁর পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব হতো না।
পাঠক লক্ষ্য করবেন, এখানে গল্প ‘লেখা’ শব্দটি কিন্তু উল্লেখ করা হল না। উল্লেখ করা হলো ‘সৃষ্টি’। ‘রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত’ নিছক বাংলা ভাষায় লেখা একটা মামুলি ছোটগল্প নয়। এটি ভাষা নির্বিশেষে, দেশ- সময়- সমাজ- সংস্কৃতি নির্বিশেষে একটি ‘সৃষ্টি’। এমন সৃষ্টি সাহিত্য জগতে খুব কম ই আসে। রবীন্দ্রনাথের, ‘ ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ ল্যাবরেটারি’ , সমরেশের ‘ গঙ্গা’ ,’ জগদ্দল’ বা ছোট গল্প,’মানুষ রতন’ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’, শওকত ওসমানের ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ ইত্যাদিকে যে অর্থে নিছক লেখা বলে অভিহিত না করে, ‘ সৃষ্টি’ বলে বর্ণনা করা যায়, সাহিত্য যতোদিন বেঁচে থাকবে, ততোদিন এইসব সৃষ্টির অমরত্ব কেউ মুছতে পারবে না বলে অভিহিত করা যায়, সিরাজের ‘রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত’ সেই পর্যায়েরই একটি অনুপম সৃষ্টি।
প্রান্তিক জীবনের সঙ্কটে মানবজীবনের অস্তিত্বের প্রশ্নটিকে ‘রাণীরঘাটের বৃত্তান্তে’ সিরাজ যেভাবে মেলে ধরেছেন, পরতে পর পরত ধরে সেই কালপর্বের মোড়ক উন্মোচন করেছেন, যেখানে ফালতুর মায়ের নারী জীবন ঘিরে সঙ্কট, আর তার সন্তান ,যাঁকে সমাজ অনেকখানি কৌতুকে, বেশ খানিকটা ঘৃণায়’ ফালতু’ নামকরণ করেছে, সেই নামকরণের গহিন অব্যক্ত যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করে সেই ‘ফালতু’, জীবন সংগ্রামের যে নতুন অর্থ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, তার থেকে বলতেই হয় যে, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অতীতের ধারণাকে সিরাজ, মানুষের অস্তিত্বের মহাসঙ্কটের যাপনচিত্রে পর্যবসিত হওয়ার যে অনুপম, অথচ যন্ত্রণাবহুল চিত্র উপস্থাপিত করেছেন, তা কেবল সাহিত্য জগতের ক্ষেত্রেই নয়, গোটা সমাজবিজ্ঞানের পরিসরে একটি অনন্য সংযোজন। সাহিত্য কিভাবে সমাজতত্ত্বের গহীনে প্রবেশ করে, সামাজিক ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠতে পারে, জাত পাতের দীর্ণতার বেড়াজালে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েও শেষপর্যন্ত জয়গান গায় জীবনের, অন্তজ জনজীবনের বারমাস্যার ধারাবিবরণীর ভিতর দিয়ে তা দেখিয়েছেন সিরাজ।
জনগণনাতে ফালতুর নাম তোলা জনিত যে আএনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর প্রশ্নগুলি এখানে উত্থাপিত হয়েছে, সেই প্রশ্নের অন্তরালেই যেন লুকিয়ে আছে আজকের ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ঘিরে ঘনায়মান সঙ্কটের একটা আগাম পূর্বাভাস। তাই গল্পটি পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয়, আটের দশকে লেখা এই গল্পটি যেন, এন আর সি, এম পি আরের এই সঙ্কটদীর্ণ ভারতে বসে, গতরাতে সৃষ্টি করেছেন সিরাজ। লেখার প্রেক্ষিত, ঠিক এতোখানিই জীবন্ত।
ভারতের জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে অহিংস ধারার যাঁরা সমর্থক ছিলেন, অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী বা তাঁর সতীর্থরা জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলতেন। যদি ও সেই লড়াইয়ের ভিতরে আন্তরিকতা কতোখানি ছিল, সেই প্রশ্নকে সক্রিয় রেখেই বলতে হয়, জাতপাতের বেড়াজাল পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজনীতি সচেতন রাজ্যেও সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে নিম্নবর্গীয়দের মনুষ্যেতর জীব হিশেবে কি ভাবে গণ্য করেছিল, সিরাজ নিজের অভিজ্ঞতার থেকে তুলে নেওয়া চিত্রের ভিতর দিয়ে তা অঙ্কিত করে গিয়েছেন।
স্বাধীনতার আগে মানুষের মুক্তি সংগ্রাম আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে দেশছাড়া করবার বিষয়টিকে একটি অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখেছিলেন বামপন্থী ধারার মানুষজনেরা। সেই আঙ্গিকেই তাঁরা তাঁদের সব আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।ব্রিটিশ বিরোধী বামপন্থী ধারার লড়াইয়ের আঙ্গিক ও ছিল তেমনটাই। সেই আঙ্গিকে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশেষ মর্যাদা স্বভাবতই দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিরই ভারতীয় আঙ্গিকের যে সমস্যা, ধর্ম আর জাতপাতের বিন্যাস এবং সেই বিন্যাসজনিত সমস্যাকে সমুচিত মূল্য দেওয়া হয়েছিল, কি হয়নি, দেওয়া হলে, আমাদের ভারতীয় সমাজব্যবস্থাতে সেই মূল্যের প্রভাব কতোখানি গভীরে প্রবেশ করেছিল, আদৌ করেছিল কিনা– এইসব জরুরি প্রশ্নগুলি পাঠকের মনে গভীরভাবে জাগিয়ে দেবে সিরাজের এই অনুধ্যান।
স্বাধীনতা, দেশভাগের পর মানুষের বেঁচেসথাকার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, দাসত্বের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলমুক্তির অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার– এসব নিয়ে কম গণআন্দোলন হয়নি। ছিন্নমূল মানুষদের অধিকার রক্ষা ঘিরেও আন্দোলনের অপ্রতুলতা ছিল না। তবু আমাদের সমাজে, বিশেষ করে প্রান্তিক সমাজে ফালতুর মায়ের মতো জনম দুঃখিনী ছিলেন এবং আজ ও আছেন। ফালতুর মতো ফালতুরা ছিল এবং আজ ও তাঁরা আছে। এঁরাই যুগে যুগে রাজনীতির নামে যাঁরা আপনস্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করাকেই জীবনের ধ্যানজ্ঞান মনে করেন, তাদের হাতের দাবার ঘুঁটি হয়।তবু রাজনীতিকেরা এঁদের জন্যে কোনো সামাজিক আন্দোলন করেন না। মনেই করেন না, শ্রেণীর পাশাপাশি ধর্ম এবং জাতপাতের যে বিন্যাস আমাদের দেশ ভারতের সার্বিক প্রেক্ষাপটে আছে, যা ভারতকে অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়াতেও এখন ক্রমেই বিস্তার লাভ করেছে, সেই সামাজিক অভিশাপগুলির বিরুদ্ধে লড়াই শ্রেণী সংগ্রামেরই একটা অংশ। শ্রমিক- কৃষক-মেহনতী জনতার হাত থেকে নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের হাতে কুক্ষিগত করলে যে জনতার মুক্তি অসম্ভব, রাণীরঘাটের বৃত্তান্তে তার দুরন্ত ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সিরাজ। সেই ইঙ্গিত ই নিজে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের কোনোরকম সমর্থক, এটা ক্ষীণ কন্ঠে ও না বলা রবীন্দ্রনাথ তাঁর গোটা জীবনব্যাপী আলোর সন্ধানের ভিতর দিয়ে দেখিয়েছেন। আলোর পিয়াসী সমরেশ বসুর যাত্রা ও ছিল সেই পথেই।সে পথকে বোঝার ক্ষমতা নেই, মেধা নেই, ঔদার্য নেই – এমন কতগুলো লোক দলীয় মতাদর্শকে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে ‘দল’ বিষয়টিকে কেবল গোষ্ঠী সংঘাতের আখড়া করতে চেয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে চেষ্টা করেছিল সমরেশ বসুকে। অতীতে যেমন ভবানী সেনের , ‘৪৯ সালে বি টি রণদিভের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তেভন ধারার আক্রমণের ঝড় যে সিরাজকে একদম সইতে হয়নি, তা বুক বাজিয়ে বলা যায় না। তবে আজ (১৪ অক্টোবর) সিরাজের জন্মদিনে এ কথা জোরের সঙ্গে বলতে হয় যে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এই ‘অলীক মানুষ ‘কে। তাই সমরেশ বসুকে যেমন আজ ও তাঁর সৃষ্টি ঘিরে কথা বলার ক্ষেত্রে মেধা, মননশীলতায় সমরেশের পায়ের নখের যোগ্যতা না থাকা লোকেদের কাছে, শেষপর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিজীবন ঘিরে অনুযোগ শুনতে হয়,’ ভাগ্যদেবী’, ততোটা অপ্রসন্ন ছিলেন না সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের প্রতি।