বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি প্রথম দফা আক্রান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর যে সদস্যদের দেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল স্বস্তি আর নিশ্চিত বোধ করেছিলেন, তারাই প্রথমে তাঁকে এবং এরপর একে একে অন্যদের হত্যা করেছে।
মামলার বাদী এবং এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলামের সাক্ষ্যে অবশ্য এটাও স্পষ্ট হয়েছে, প্রথম হামলার পরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নিরাপত্তায় ৩২ নম্বরে অবস্থান করা নিরাপত্তাকর্মীরা কেউ কিছু করছে না। ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কি করো!’ বলে বিরক্তিও প্রকাশ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি।
মুহিতুল ইসলাম বলেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে দোতলা থেকে নীচে নেমে সেনা সদর, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং গণভবনে টেলিফোন করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই এক ঝাঁক গুলি দক্ষিণ দিকের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে নীচতলার অফিসকক্ষের দেয়ালে লাগে।
বঙ্গবন্ধু তখন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিনকে টেলিফোনে পেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই গুলিতে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে তাঁর ডানহাতের কনুইয়ে লেগে রক্ত ঝরতে থাকে। সেসময় বঙ্গবন্ধু ‘এতো গুলি কিসের?’ জানতে চাইলে একজন সেন্ট্রি বাইরে থেকে হামলার কথা জানান বলে জানিয়েছেন মামলার ৫০ নম্বর সাক্ষী সাবেক পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম খান।
ডিএসবির প্রটেকশন ফোর্সের সদস্য হিসেবে তখনকার হাউস গার্ডের দায়িত্বে থাকা নুরুল ইসলাম খান সেন্ট্রিদের ‘কাউন্টার ফায়ারিংয়ে’ প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বললেও নিরাপত্তাকর্মীদের কেউ সেটা করে নি। সেসময় কালো এবং খাকি পোষাকধারী কিছু সেনাসদস্য ‘পূর্ব-দক্ষিণ এবং পশ্চিম-দক্ষিণ’ দিক থেকে ক্রলিং করে বাড়ির দিকে আসছে দেখে বঙ্গবন্ধু দোতলায় চলে যান।
এর পরপরই বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল নীচে নেমে এসে নুরুল ইসলামকে জিগগেশ করেন, আর্মি কি এসেছে? উত্তরে তিনি বলেন, মনে হয় এসেছে।
ধারণা করা হয়, এর আগেই বঙ্গবন্ধু তাঁর শয়নকক্ষ থেকে টেলিফোনে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এবং বিদায়ী প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। তাই প্রেসিডেন্টের জীবন রক্ষায় সেনা সদস্যদের আশা করছিলেন শেখ কামাল।
‘তখন শেখ কামাল উৎফুল্ল হয়ে বলেন, আর্মি ভাইয়েরা কারা এসেছেন ভেতরে আসেন। দ্বিতীয়বারও একই কথা উচ্চারণ করেন,’ জানিয়ে নুরুল ইসলাম খান বলেন: কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ ছিলো না। পরে হঠাৎ ৫/৬ জন কালো ও খাকি পোষাকধারী আর্মি গেট ধাক্কা দিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে।
কিছুদূর এগিয়ে তারা ‘হ্যান্ডস-আপ’-এর নির্দেশ দিলে তিনি এবং এক পুলিশ সার্জেন্ট ‘হ্যান্ডস-আপ’ করেন। ‘শেখ কামাল কিছুটা আশ্চর্য হয়ে হাত উঠিয়ে বলেন, আমি শেখের ছেলে কামাল। তারা দ্বিতীয়বার ‘হ্যান্ডস-আপ’ বললে হ্যান্ডস-আপ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করে,’ জানিয়ে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তাকেও দুটি গুলি করা হয়।
প্রসিকিউশনের ছয় নম্বর সাক্ষী হাবিলদার সোহরাব আলী জানিয়েছেন, শেখ কামাল সেখানে এসে ‘আর্মি-পুলিশ ভাই আপনারা আমার কাছে আসেন’ বলার পর খাকি পোষাকধারী ক্যাপ্টেন হুদাসহ অন্য অফিসাররা শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল চীৎকার করে রিসেপশন রুমের কাছে পড়ে যান। ক্যাপ্টেন হুদা তখন আবারও তাকে গুলি করে।
যে সেনা সদস্যদের শেখ কামাল তাদের জন্য উদ্ধারকারী মনে করেছিলেন, তারা কিভাবে তাকে হত্যা করেছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন মামলার বাদী এবং প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের রেসিডেন্ট পি.এ মুহিতুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন: শেখ কামাল আর্মি ভাই, পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসেন বলার পর ৩/৪ জন কালো ও খাকি পোষাকধারী সশস্ত্র আর্মি এগিয়ে আসে। খাকি পোষাকধারী মেজর হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। শেখ কামাল তখন শেখ মুজিবের ছেলে কামাল হিসেবে নিজের পরিচয় দিলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে হুদা।
(আগামীকাল দ্বিতীয় কিস্তি: আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে গুলি ছিলো না)