সিলেট থেকে: ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টস করতে নেমেছিলেন বাংলাদেশের মেহেদী হাসান মিরাজ ও জিম্বাবুয়ের ব্রেন্ডন মাভুতা। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সিরিজ ছিল সেটি। বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ যুব বিশ্বকাপেও নিজ দেশের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। বিশ্বকাপের পরই জাতীয় দলে জায়গা পেয়ে যান মিরাজ। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন দলের অপরিহার্য সদস্য।
মাভুতার সময় লেগেছে কিছুটা। ঘরোয়ায় সব ফরম্যাটে প্রমাণ করতে হয়েছে তিন বছর। টানা দুই মৌসুম সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়। টি-টুয়েন্টি, ওয়ানডের পর ক্রিকেটের অভিজাত আঙিনায় পা রেখেছেন শনিবার। সিলেট টেস্ট শুরুর আগে চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাতকারে মাভুতা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মিরাজের দাপুটে শুরু অনেক বড় অনুপ্রেরণার।
লেগস্পিন তো কঠিন আর্ট। কীভাবে আয়ত্ত্ব করলেন?
খুব অল্প বয়সে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। আমার যখন সাত বছর বয়স তখন থেকে। শুরুতে অফস্পিনার ছিলাম। সঙ্গে ব্যাটিংটা করতাম। যখন আমার বয়স দশ তখন দেখতাম একজন পেশাদার ক্রিকেটার আমাদের স্কুলের মাঠে এসে লেগস্পিন করতো। দেখে তার মতো বোলিং করার ইচ্ছা জাগে। তার মতো হতে চাইতাম। ওখান থেকেই শুরু।
চাইলেন আর হয়ে গেলেন, রপ্ত করা কি এতটাই সহজ ছিল?
মোটেও না। লেগস্পিনার হওয়া খুবই কঠিন। প্রতিদিনই শিখতে হয়, প্রতিনিয়ত শেখার মধ্যে থাকতে হয়। প্রচুর বল করতে হয়েছে। যেটি এখনও করে যাচ্ছি। যতই বোলিং করবেন কিছু না কিছু শিখতে থাকবেন। যতদিন খেলবেন শিখেই যাবেন। সে চেষ্টাই করছি। অনেক ধাপ পেরিয়ে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসতে পেরেছি। এটুকু বলতে পারি এগিয়ে যাচ্ছি।
লেগস্পিনাররা সাধারণত রান দেয়ার ক্ষেত্রে একটু খরুচে হয়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
এটা ঠিক, কখনও কখনও রান হয়ে যায়। কিন্তু ম্যাচের মাঝপথে যদি ২-৩টি উইকেট দ্রুত নিয়ে নিতে পারেন তখন খেলাটাই বদলে যায়। সেটা কিন্তু দলের জন্য খুব কাজে দেয়। আর এটাই লেগস্পিনারের বিশেষত্ব। এ কারণেই বিভিন্ন দেশ লেগস্পিনার খোঁজে এবং তাদের পোষে। এমনও হয় আমাদের লিগে খুব রান দিয়ে দিয়েছি, কিন্তু কুইক উইকেট নিয়ে সেটি পুষিয়ে দেই। লিস্ট এ ক্রিকেটে গত মৌসুমে সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েছি। আমাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বোলিং ফিগারটা (৩৮/৮) আমারই। যখন নামের পাশে এমনকিছু থাকবে তা অবশ্যই আত্মবিশ্বাস যোগাবে। ভাবতে সাহায্য করবে আমি আলাদা কিছু।
জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে কতজন লেগস্পিনার খেলে। প্রতিযোগিতা কেমন?
৬-৭ জন তো হবেই। আমাদের মধ্যে ভালো প্রতিযোগিতা হয়। দিনশেষে এটিকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখি। বোলিং নিয়ে আলাপও জমে খুব।
সাউথ আফ্রিকা সফরে ওয়ানডে-টুয়েন্টি ভালো করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে সেভাবে দেখা যায়নি। একটি ম্যাচে একাদশেই জায়গা পেলেন না!
কখনও কখনও এমন হবে। ক্রিকেট খেলাটাই এমন। আমাদের দেশের উইকেট ও সাউথ আফ্রিকার উইকেটের তুলনায় এখানে অনেক ভিন্নতা পেয়েছি। আমি এখানকার উইকেটে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টাতেই ব্রুত আছি। শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি যতটা পারি। ট্রায়িং টু লার্ন। প্রতিটা ট্যুর থেকেই কিছু না কিছু শিখব। একটা সময় হয়তো এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবো। বাংলাদেশ সফর আমার জন্য অনেককিছু শেখার সুযোগ। যা বুঝেছি তা টেস্টে হয়তো কাজে লাগবে। টেস্ট খেলার জন্য আমি প্রস্তুত, সুযোগ পেলে সেরাটাই দেবো। কতটা শিখেছি সেটি দেখানোর সুযোগ থাকে টেস্টে।
বাংলাদেশে লেগস্পিনার খুঁজে পাওয়া কঠিন। যারা আসেন তারা হারিয়েও যান দ্রুত। ম্যাচ খেলার সুযোগও কম।
হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। শিখে যেতে হবে। আমার মনে হয় তারা ধারাবাহিক না। আন্তরিক প্রচেষ্টা না থাকলে এটা সম্ভব না। আর যা শেখা সেটা সময় মতো কাজে লাগানোর চেষ্টাই লেগস্পিনার তৈরি করতে পারে।
ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্নের জায়গা কত বড়?
প্রথমত জিম্বাবুয়ে দলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এরপর আইপিএল, বিপিএল, সিপিএল এসব ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে চাই। সেই মানসিকতা নিয়েই নিজেকে গড়ছি। নভেম্বরে সাউথ আফ্রিকার ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে ডারবান হিটের হয়ে খেলবো। সেই দলে আরেকজন লেগস্পিনার আছেন, রশিদ খান।
আপনার বোলিংয়ে বিশেষ কার্যকারিতা কী?
আমার উচ্চতা ভালো (৫ ফুট ৮ ইঞ্চি) হওয়ায় বাড়তি বাউন্স পাই। ভ্যারিয়েশন, টার্ন তো আছেই। এছাড়া বিভিন্ন গতিতে বল করতে পারি।
ক্রিকেটের পথচলায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও আক্ষেপ কি?
আমার যখন ১৪ বছর তখন বয়সভিত্তিক দল থেকে বাদ পড়ে যাই। হতাশায় ক্রিকেট ছেড়ে দেই। এক বছর ক্রিকেটের বাইরে ছিলাম। ফুটবল খেলে সময় কাটিয়েছি। এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় আবার ক্রিকেটে ফিরি। তাকে ধন্যবাদ যে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। শিক্ষিকা মায়ের ও বোনের কারণেই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমার যখন ২ বছর বয়স তখন বাবা মারা যান। অনেক উত্থান-পতন দেখে বড় হয়েছি।
একসময় জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশকে হরহামেশায় হারাত। এখন তার বিপরীত চিত্র। জিম্বাবুয়ের পক্ষে কী হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব। আমরা এবার একটি ওয়ানডেও জিতিনি, এটা ঠিক। তবে কখনোই নিজেদের আন্ডারডগ মনে করে নামিনি। দুটি ম্যাচে এমন হয়েছে আমাদের জয়ের সম্ভাবনাও ছিল। এই মানসিকতায় থাকলে আবারও আমরা সাফল্যের পথে হাঁটব।
মিরাজকে তো অনেকদিন ধরেই চেনেন। সে বাংলাদেশ দলের নিয়মিত সদস্য এবং ভালোও করছে…
এটা আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। দু’জন নেতৃত্ব দিয়েছি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও। এই পর্যন্ত খেলে অনেকেই হারিয়ে যায়। মিরাজদের মতো তরুণদের সাফল্য দেখে আরও তরুণরা ক্রিকেটে আশা খুঁজে পায়, স্বপ্ন দেখে। টেস্টে দারুণ করে ওর শুরু। শুধু আমার না, অনেক তরুণ ক্রিকেটার মিরাজকে দেখে খেলে যাবে।