ভাষা সংগ্রামী মোহাম্মদ খোদা হাফেজ। ১৯৩২ সালের ১ এপ্রিল সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু তাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঘাটিয়ারা গ্রামে। তার পিতা মৌলভী মতিয়ার রহমান।
ভাষা সংগামী মো. খোদা হাফেজ পড়ালেখা করেছেন অর্থনীতিতে। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। অর্থনীতিতে এম এ পাশ করেন ১৯৫৩ সালে। ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়ার কারণে গ্রেপ্তার হন ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি।
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর কিছুদিন ব্যবসা পরিচালনা করেন। পরে যোগ দেন এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এডিএফসিতে। এডিএফসি পরে কৃষি ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। কৃষি ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ‘ডিজিএম’ হিসেবে অবসর নেন ১৯৯০ সালে।
তারিকুল ইসলাম মাসুম ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভাষা সংগ্রামী মো. খোদা হাফেজের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন।
মো. খোদা হাফেজ: আমাদের অসুবিধা হল যে আমাদের, তখনকার থেকে এখনের সময়রে অনেক বিবর্তনে, অনেক রকমের পরিবর্তনটা এমনভাবে হইছে যে? হিসাব মিলানো যায় না।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: আমরা তখনকার দিনে যে আন্দোলন বা তখনের যে চাওয়া পাওয়া যা ছিল এরকম, আমরা এটা করতাম প্রয়োজনের খাতিরে। চাহিদা দেশের মানুষের, দেশের চাহিদাকে লক্ষ্য রেখে ছাত্ররা মনে করতো যে, আমাদের বাপ-মা’রা ঠিক প্রপার গাইডেন্স দেওয়ার মতো না। আমাদেরই কর্তব্য হলো দেশকে কিছু দেওয়া।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: তো সেই চাহিদা থেকেই ছাত্ররা, অ্যাকচুয়ালি এগিয়ে আসতো আন্দোলনে। এখনের অ্যাকচুয়ালি তফাতটা হলো এই, তখন কিন্তু আমাদের কোন পাওয়ার কোন আকাঙ্খা ছিল না। কী পাবো সেই চিন্তা করে আমরা কোন কিছু করি নাই।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: প্রয়োজন! আমরা মাঠে নামছি। এবং বড় জিনিস হলো, তখন ছাত্ররা গাইড করতো রাজনীতিকে।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: আর এখন সেই ছাত্ররা হয়ে গেছে রাজনীতির-রাজনীতিকদের লেজুড়। আমরা তখন শিক্ষকদের যে চোখে দেখতাম, সত্যিকারভাবে তাদের গাইডেন্সও নিতাম এবং ওনারা আমাদের গাইডেন্স দিতেনও। দুইটা জিনিস তফাৎ হলো রাজনীতির সাথে দেশের যে একটা ন্যাশনাল যে চাহিদা।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: সেটার মধ্যে তফাৎ থাকার ফলে, ওনাদের গাইডেন্সটা আমরা সঠিকভাবে পাইতাম তখন। এখনের টিচারদের চরিত্র আনফরচুনেটলি এর মধ্যে আমাদের যেটা চোখে পড়ে, ডিফারেন্ট। ওনারাও যদি কোন একটা দাবি করেন যে, আমরা বুদ্ধিজীবী।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: এই বুদ্ধিবীজীদের মুখ থেকে যেসব জিনিস বাণী বের হয়, জনগণ বিশ্বাস করে না। তখন মনে যেন হচ্ছে, কথাগুলা কোন একটা ভেস্টেড সাইড থেকে ওনারা বলতেছেন। আমার মনে হয়, আমি এর থেকে কিছুটা ইঙ্গিত দিতে পেরেছি।
তা. ই. মাসুম: এখনকার বাস্তবতায়, আপনি যেটা বললেন এটা তো মানুষের বা দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে, এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। সেই মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য কী করা যেতে পারে? বা কারা করতে পারেন? আপনারা যারা আছেন, আপনাদের সময়কার আপনারা কী বলবেন? আরেকবার জাতিকে বা বলার চেষ্টা করবেন?
মো. খোদা হাফেজ: মুশকিলটা হলো, একটা রেসপনসিবিলিটি একজনের ওপর দিতে পারবেন না। এখন আনফরচুনেটলি ঐ যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সবাই দলের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারবে। আমাকে তো বিশ্বস্ততা অর্জন করতে হবে। আমাকে তো পাবলিকে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু আমরাতো এমন হয়ে গেছি যে, সো কল্ড আমাদের যে কী বলে? বুদ্ধিজীবী।
বুদ্ধিজীবী সবাই যে এক রকম খারাপ তা নয়। সবাইতো জনগণের জন্যই বলতেছেন ঠিকই, কিন্তু কেউ ওনাদের বিশ্বাস করতে পারতেছেন না। এই জন্য যে, ওনারা ঠিক দেশের মঙ্গল হবে যে কাজটা করলে তা করছে না। আমরা আইনটা করি কেন? আমরা আইনটা করি মনে হলো যে, এই আইনটা করলে আমার ছেলেমেয়েদের উপকার হবে। বা আমার গোষ্ঠীর একটা উপকার হবে। তো হোয়াই দিস?
তা. ই. মাসুম: সার্বজনীন হচ্ছে না?
মো. খোদা হাফেজ: সার্বজনীন হচ্ছে না। ওনাদের রিকমন্ডেশনগুলা সার্বজনীন হচ্ছে না। যার ফলে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে, কাজও হচ্ছে না। ওনারাই যদি, ওনারাই করতে পারেন, কিছুই না, আজকে যদি, গত এক বছরে দেশে পরিবর্তন হয় নাই? নিশ্চয়ই হইছে।
তা. ই. মাসুম: জ্বি। মো. খোদা হাফেজ: তো কেন হইছে? আপনার উইল থাকতে হবে। ইউ হ্যাভ মাস্ট সাম উইল, যে আমি দেশের জন্য কিছু করব।
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: সবসময় যদি মনের ভেতরে, শোনেন, মোনাফেকী, ইসলামে সবচেয়ে বড় পাপ বলা হয় মোনাফেকীকে, কুফরী। বুঝছেন?
তা. ই. মাসুম: জ্বি।
মো. খোদা হাফেজ: তো আমরা তো সেটা যদি বিশ্বাস করি। আমরা যদি জনগণকে ইনডাইরেক্টলি বিট্রে করতেছি তো! এইটাই মোনাফেকী! আমি বিশ্বাস করি, আমি যদি সত্যিকারের আপনাকে যদি গাইডেন্স দেই বা জনগণের জন্য সত্যিকারে কিছু বলি, জনগণ নিশ্চয়ই এটা গ্রহণ করবে। আই মাস্ট হ্যাভ টু বি সিনসিয়ার ইন মাই পারচ্যুড, ইন মাই স্পিচ, ইন মাই অ্যাকশন।
তা. ই. মাসুম: স্যার, ঐ সময়ের কিছু কথা বলবেন? আপনারা কী করেছিলেন বা কেমন দেখেছিলেন?
মো. খোদা হাফেজ: হা হা হা, এগুলো তো পাবলিসিটি হয়ে যাবে, আমি বলতেছি আমার কথা বোধ হয় এমন মনে হবে।
তা. ই. মাসুম: না, আমি সেভাবে বলছি না, আপনি আপনার জায়গার বাইরে তো আর বলতে পারবেন না?
মো. খোদা হাফেজ: ২১ তারিখ আমরা যখনই করতেছিলাম, একটা ঘটনা বলি আপনাকে, যখন সবাই বেরিয়ে যাচ্ছিল ১০ জন ১০ জন করে, একটা সময় আমরাও ভাবলাম আমাদেরও যাওয়া দরকার। এই কিবরিয়া (এসএমএ কিবরিয়া) দেলোয়ার এরা আমরা সবাই ক্লাস ফ্রেন্ড কিন্তু। দেলোয়ার এখন যে বিএনপির নেতা (বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন) কিবরিয়া মানে শাহ এম এস কিবরিয়া (সাবেক অর্থমন্ত্রী), রকীব (সাবেক আইজিপি আব্দুর রকিব খন্দকার) সবাই মিলেই ভাবলাম, বললাম, চল আমরাও যাই।
ইন দি মিন টাইম লাঠির বারি শুরু হয়ে গেল। মানে ওরা এত লোক! মানে ২শ লোক নিয়া ফেলছে, অ্যারেস্ট করে ফেলছে, কাজেই আর নিবে না। তখন দরজা আটকে দিল। এরপরে কিছুক্ষণ ধরে খুব ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলল। খুব গ্যাস, ওটাকে কী বলে?
তা. ই. মাসুম: টিয়ার গ্যাস?
মো. খোদা হাফেজ: টিয়ার গ্যাস মারতে শুরু করল। তো একটা গেমের মতো শুরু হয়ে গেল। আমরা তখন হইছে কি, এখন নেই ওটা সামনে একটা পুকুর ছিল। তো আমি কী করলাম ঐ পুকুরে ঝাঁপ দিলাম, পুকুরে পড়ে শার্ট ভিজিয়ে নিলাম। ঐ টিয়ার গ্যাসটা দেয়, আর পকেটে রুমাল ভিজাইয়া নিছি। টিয়ার গ্যাসটা এসে (টিয়ার গ্যাসের শেল) পড়ে, আর আমরা ওটাকে পিক আপ করি, করে উল্টা ওদেরকে মারি। তো এসব কতক্ষণ গেম চলল। তো কিছুক্ষণ পরে এটা থেমে গেল এ জায়গাটায়।
শুরু হয়ে গেল মেডিকেল কলেজ যেখানে শহীদ মিনারটা, ওখানে ছিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল। এখন জগন্নাথ হল যেটা, ঐখানে ছিল অ্যাসেম্বলি হাউজ। ঐ উল্টোদিকে কাটাতারের বেড়া ছিল। ঐখানে সিনটা শিফট হয়ে গেল। তো আমি আর কিবরিয়া বের হয়ে যাচ্ছিলাম। গেটের মধ্যে ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর গনি। ওসমান গনি আমাদের তখন প্রভোস্ট। ওনারা আমাকে বললেন, এই খোদা হাফেজ? সব যে অ্যারেস্ট হইতেছো? কাজ করবে কে?আমি বলাম, স্যার আমরা ঠিক অ্যারেস্ট হতে যাচ্ছি না। ঐখানে একটা খবর পাইছি, ওখানে একটা প্রবলেম হইতেছে, এই জন্য যাচ্ছি ওখানে।
ওখানে গেলাম, যাওয়ার পরে দেখি, অ্যাকচুয়ালি দেয়ার ওয়াজ ব্রিক ব্যাটিং। সবাই ইট মারছে, বললে তো অসুবিধা নাই। ওরা টিয়ার সেল মারতেছে আর এরা ইট মারতেছে। এই চলতেছে। সাইকোলজিক্যালি এমন হইল এক জায়গায়, আমরা বসে আছি, এরমধ্যে আমার এই জায়গায় (উরুতে) কিছু একটা এসে লাগল। কিছুই না যাস্ট টাচ করছে শরীরটা, তাতেই আমি লাফ দিয়ে উঠে ওটা ধরে আবার মারছি!
এরপরে এখন ডক্টর হইছে ডক্টর সিরাজ হোসেন খান, ইউটিসি করতো। ও আর আমরা কয়জন মিলে একেবারে ইয়েতে চলে গেলাম, একেবারে তারের বেড়ার কাছে আমরা। তো কাটা তারের বেড়ার ভিতরে আছি। ফায়ারিং-টায়ারিং আমাদের মাথায় আসে নাই। তো ব্যাস চলে গেছি ওদের কাছে, ওদের ওখানে গিয়ে আমরা মনে করলাম আমরা একটা ট্রুজ করি। ওরা (পুলিশ) তো ঐখানে ঐ যে অ্যাসেম্বলি হাউজের যে ক্রসিংটা। এখনতো ওখানে একটু, ঐ রাস্তাটা আছে অবশ্য।
তা. ই. মাসুম: মাঝখানের রাস্তাটা।
মো. খোদা হাফেজ: ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যাওয়ার যে রাস্তাটা, ঐ মোড়টা আর কি। ওখানে গিয়ে আমরা ওদের সাথে একটা ট্রুসের ব্যবস্থা করলাম। ওরা (পুলিশ) বলে, তোরা গালি দেতাহে তো?আমরা বললাম, তোমরা টিয়ার গ্যাস কিউ ছোড়তা হ্যায়?
এই রকম করে আমরা ওদের সাথে ট্রুস করছি। ট্রুস করে আমরা খালি আসতেছি এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল গুলি। তখন আমার মনে আছে সিরাজ ইউটিসি করতো তো, ও বলল, লাই ডাউন!আমরা সব শুয়ে পড়লাম। বাই দিস টাইম তো যা হওয়ার হয়ে গেছে। এরপর তো সিন হয়ে গেল। সময় ইন ফ্রম টু আপনার, বোধ হয় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মেডিকেল কলেজে ওরা একটা মাইক ফিট করল। মাইক ফিট করে বক্তৃতা শুরু হয়ে গেল।
তখন অ্যাসেম্বলি থেকে মাওলানা তর্কবাগীশ তারপরে কংগ্রেসের যে পার্লামেন্টারি লিডার ওনার কয়েকজন নাম ভুলে গেছি, ওনারা কয়েকজন আসলেন। এসে বক্তৃতা দিলেন। এই মানে মুভমেন্ট স্টার্টেড ফ্রম হেয়ার, মানে এই ইটা। এরপর তো আমরা আমাদের কাজ করতে থাকলাম।
তখন হইল কী অ্যাকচুয়ালি লিডারশিপটা তখন লোয়ার লেভেল যারা, আমরা তো তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। তখন দায়িত্বটা আমাদের ঘারে এসে পড়ল। মানে উপরের লেভেলের যারা কেউ অ্যারেস্টেড হইয়া গেছে অথবা ঐ যে ধরেন যে, ঐ যে অলি আহাদ, তখনো ওনারা অ্যারেস্ট হয় নাই, হাইড আউটে চলে গেছে। তখন, আল্টিমেটলি রেসপনসিবিলিটি কেম অন আস, আমাদের ঘারে এসে পড়ল। এই তখন শুরু হল, এই করে করে আমরা…।
আরেকটা কথা মনে পড়ে,সলিমুল্লাহ হলে পরের দিন আবার বিরাট একটা, আবার একটা মাইক ফিট করা হলো। ঐ ফিট করতে যাইয়া রাত্রে আমরা একটা মিটিং করলাম। আসাদ ভাই বলেছিল আমাদের একারামুল আমিন বলে একজন ভাল ফুটবলার, ভাল ছাত্র ছিলেন। এবং এই মুভমেন্ট স্পোর্টসম্যানরা আমাদের হলে যারা ছিলেন যারা খেলাধুলা করতাম এই গ্রুপটা। এরা কোনো রাজনীতি করতো না, তো দিস ব্যাংক অব পিপল এরা কিন্তু ভীষণ অবদান রেখেছে।
এর পরের দিন তো আবার অনেক কিছু হইল।
টুয়েন্টি ফিফথ এ, তখন কিন্তু স্ট্রাইক করা একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। এরমধ্যে একজন আইসা পরিচয় দিল সে সেক্রেটারিয়েট থেকে আসছে, ক্লার্ক জাতীয় একজন। ওনারা বললেন যে, আমরা আপনাদেরকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি? মানে এই সময় কোনই নাই, কোন লিডার টিডার নাই। যাস্ট যে যেখানে পারতেছে সে সেখানে কাজ করতেছে।
ওনারে বললাম যে, তোমরা এক কাজ কর যে, কেউ বাসায় থাকবে না। মানে, হরতাল যে করতেছে, অফিসেও যায় না। কোথায় থাকবে? সলিমুল্লাহ হলের সামনে, মনে করেন এখানে, এ্যাট লিস্ট ৪০-৫০ হাজার লোক সম্পূর্ণ এরিয়াটায় বসে থাকতো, আর বক্তৃতা দিতেছে। দিনরাত বক্তৃতা দিতেছে। মানে বিকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন। এইখানে একটা বিরাট জমায়েত হয়েছে। পরে তো সেকেন্ড ডে’তে না জানি থার্ড ডে’তে মাইকটা নিয়া গেল পুলিশ আইসা। এরপরে আপনার, টুয়েন্টি ফিফথ, ঐ দিন রাতে আমরা তো ঐ সময় চাঁদা-টাদা আদায় করতাম। আমরা চাঁদা আদায় করতাম আমাদের আবার ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট, অমুক ডিপার্টমেন্ট, সব ডিপার্টমেন্ট। আমাকে এক আইপি বলছিল পরে, যখন ধরা পড়ি যে, আপনারা সবচেয়ে মারাত্মক করলেন, যে কাজটা করলেন, আপনারা আপনাদের হলটাকে ফোর্ড বানাইয়া ফেললেন।
মানে কেউ ঢুকতে পারতো না, এমন রেস্টিক্টেড ব্যবস্থা ছিল।
তা. ই. মাসুম: আপনি ধরা পড়েছিলেন?
মো. খোদা হাফেজ: হ্যাঁ, আমরা ওটা পরে বলতেছি, ২৬ তারিখের কথা, ২৫ তারিখে না জানি ২৪ তারিখে, আই কান্ট এক্সাক্টলি রিমেম্বার, একটা হরতাল দেওয়া হইছিল একেবারে খুব…সব… টোটাল…তখনকার দিনে হরতাল দেওয়া খুব কঠিন ছিল।
তো আমি, আই বোস্ট ফর ইট, যে, ১৫ জনকে আমাদের একটা লিস্ট, বলা হইছিল যে তোমরা সেক্রেটারিয়েট মুভ করবা। যখন বের হলাম, তখন আমি আর কিবরিয়া মাত্র, সকালে আমরা যখন বের হইছি তখন আর কেউ ছিল না। তখন সাথে আর কউকে পাই নাই, তখন আমরা দুই জনই গেলাম।
যাওয়ার পরে, এখন যেখানে এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট এর ডিরেকটরেটটা? ঐখানে ছিল আম গাছ, সেই আম গাছের ওখানে যখন হাইকোর্ট থেকে পাস করছি আমরা, তখন দেখি ঐ আম গাছের তলাটা ফুল, সম্পূর্ণটা আর্মি দিয়া ভর্তি। দুইটা লোক যাচ্ছি, চিন্তা করেন? এই সব আর্মির চোখ আমাদের দিকে। আমি তো নার্ভাস হয়ে গেছি সত্যি কথা বলতে কি? আমি অবশ্য এইসব ব্যাপারে ট্যাটফুল ছিলাম। আস্তে এইখানে (কাঁধে) কালো ব্যাচটা আস্তে পকেটে ঢুকাইয়া দিছি।
কিবরিয়া আবার ঐ সব ব্যাপার পরোয়া টরোয়া করে না। আমি কিন্তু ব্যাচ পকেটে ঢুকাইয়া ওখানে গেছি। ঐখানে যাওয়ার পরে একটা জিপ আসলো। ও ঐটাকে ফেস করলো। ফেস করার পরে, ভিতর থেকে দুইটা পিওন আইসা আমাদের বলল, আপনারা এখান থেকে সইরা যান, ওনারা আপনাদেরকে অ্যারেস্ট করবে।
আপনাদের কিছু করতে হবে না, আমরা ভিতরে সব তালা মাইরা দিছি।
এর মধ্যেই আসল, ঐ অ্যাকচুয়াল এসপি, এক পশ্চিমা ছিল, ওরা পা’টা ই হইছিল। আঘাত পাইছিল, ঐ গুলির কারণ, ওর পায়ে আঘাত লাগছিল। সেই লোকটা ল্যাংড়াইয়া ল্যাংড়াইয়া আসতেছিল। উই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ, কইয়া সেই লাঠি দিয়া…একধারছে পুলিশ দিয়া পিটুনি! আর দৌঁড়! দৌঁড়াইয়া সেক্রেটারিয়েট দিয়া ঐদিক দিয়া বের হইয়া ইয়েতে গিয়ে পালাইলাম। তখন ছিল রেলের ছোট ছোট কোয়ার্টার, সেই ঘরের মধ্যে গিয়া ঢুকলাম। ঢুইকা কোনো মতে জান বাঁচাইলাম।
বিকালের দিকে তো হলে চলে আসলাম আর কি। এরপরে পরের দিন তো, স্ট্রাইক উইথড্র করা হইল। এই ঘুম দিলাম, ঘুমের পরে ২ টার সময় দরজার মধ্যে শব্দ। ধ্রুম ধ্রুম শব্দ। দরজা খুলতে হবে। এইখানে একটা জিনিস, আই মাস্ট রেফার হিজ নেম। নাজু বলে একটা পশ্চিমা বিহারি আমাদের হলে গার্ড ছিল। এই সলিমুল্লাহ হলের গার্ড।
এই নাজু বলছে, ‘গোলি মারো, মাগার হাম দারওয়াজা নেহি খোলেগা’। ও দরজা খোলে নাই। শেষ পর্যন্ত কিন্তু ওরা, আমাদের তো লোহার সাইড ভাঙতে পারে নাই ওরা। ওরা করছে কি তিনটা ভাগে আসছে। আর্মি বেরিকেট দিছে, পিছন দিয়া, দুই দিক দিয়া মেশিনগান ফিট করছে। তারপরে পুলিশ আসছে সামনে। ওরা ধইরা নিছে আমরা ভিতরে যেন কি একটা করে ফেলছি! এত প্রটেকশন নিয়ে আসছে!
পেছনে ডাইনিং হলটা ছিল, ওখানে কাঠের দরজা ছিল। সেই দরজা ভেঙে ওরা ঢুকল। ওরা ঢুকার পর সবাই আসল-টাসল। এদিক দিয়া হইছে কি? আমরাতো সবাই কাজ করতাম, হলের সবার নামেরই একটা লিস্ট করা ছিল। তো ঐ লিস্টটা ওরা পেয়ে গেল। এরপর মনে করে যাকেই ধরে আনে লিস্ট দেখে বলে আরে! এই তো আছে!
তখন আমার নামও পেয়ে গেল। হইছে কি ডিআইজি ছিল, আইবি যে ছিল হাফিজ উদ্দিন সাহেব। ঐ এসপি আমাকে দেখেই হঠাৎ আমার জামার কলার ধরে বলছে যে, এখন কোথায় যাবে?আমার তো কিছু বলার নাই, বুঝে ফেলছি যে ব্যাটা আমাকে চিনে ফেলছে। আমি একটু যাস্ট তার সাথে কিছু কথা হইছিল ।
তা. ই. মাসুম: বিতণ্ডা হইছিল?
মো. খোদা হাফেজ: হ্যাঁ, এটা, দ্যাট ওয়াজ মাই ফুলিশ অ্যাকটিভিটি, এটা না করলেই পারতাম। যাই হোক তারপরে তো, দেখি ধরে আনতে আনতে ২৬ জন।
শুধু ১ জন, কিবরিয়াকে আলাদাভাবে নিয়ে গেল জিপে করে, তার অন্য একটা কারণ ছিল। একটা চিঠি পাইছিল একজনের লেখা ওর নামে। তো কিবরিয়াকে নিয়ে গেল আর আমাদের সব এক খানে।
তো আমাকে যে ঐ পুলিশটা যে, ও আর ছাড়ে না। পরে সব নিয়া গেল আপনার ঐ সদরঘাটে আইপি হেডকোয়ার্টার সেখানে। সবাইকে নিয়া গেল, নিয়া রাখল।
আমি শুধু আফসোস করি এখন, যদি তখন, যদি আমি শুধু নোটগুলা রাখতাম, যে ঘটনা। তাহলে আজকে, অনেক সময় দেখি যাদের জন্মও হয় নাই তারাও বড় বড় বই লিখতেছে। অনেক ঘটনা লিখতেছে। এখন সেগুলা কথা না, কথা হইল যে, এখন তো আমি লিখতে পারি না এই জন্য যে, আমি একটা কিছু লিখলেই এক নম্বর হইল নাম মনে নাই। আমি তো ই করতে পারব না। যেহেতু আমার কাছে রেকর্ড নাই, আমি কিছু বলতে পারব না।
কারণ তখনকার দিনে যারা, যে সব লোক এখানে কাজ করছে, যে সব, এরা তো মোস্টলি লেফটিস্ট। এই যে আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের যে সব দাবি, ঐ হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর ভাঙার পক্ষে তারা ছিল না। এটা আপনি তো জানেন। হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর তারা ভাঙতে চায় নাই।
তা. ই. মাসুম: ছাত্ররা চেয়েছে।
মো. খোদা হাফেজ: ইয়েস, ইট ইজ। এই সেজন্যই ওনার কথা বলি কেন? অ্যাডভোকেট ওনাকে বলি কেন?
তা. ই. মাসুম: গাজীউল হক?
মো. খোদা হাফেজ: দেয়ার ডিড নট বিলং টু দ্যাট গ্রুপ। দে অল আর, এখন তো সব আওয়ামী লীগ হইছে, যে কোনোভাবেই হোক। এই সামাদ (আব্দুস সামাদ আজাদ) ও তো ভাসানী ন্যাপ করত, তখন ছিল যুবলীগ।
তা. ই. মাসুম: যুবলীগ, অলি আহাদ সাহেব ছিলেন ওনারা এক সাথে যুবলীগ করতেন।
মো. খোদা হাফেজ: হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপরেও ধরেন আমগাছ তলায় যারা গরম বক্তৃতা দিছে কমিউনিস্টরা, কমিউনিস্ট ছিল। নাম এখন স্মরণ করতে চাচ্ছি না। সে তো মারা গেছে, পরে তো সিএসপি হইছে। তারপর কমিউনিস্টরা ছিল আমার ক্লাসমেট ছিল, যাইহোক, এবং তাকে আমি হেল্পও করেছি, জেলখানায় যাইয়া, হি কন্ট্রিবিউট অন ইট।
তো জেলখানায় আমার বিছানা, তখন তো খাট ছিল ছোট ছোট খাট। আই ওয়াজ লাকি, যেহেতু সলিমুল্লাহ হল থেকে গেছি। আমাদেরকে ওনারা ক্লাস ওয়ান দিয়া দিছিল। এটা মজা। তখনই আমরা বুঝলাম আমরা সিকিউরিটি প্রিজনার হচ্ছি।
এর আগ পর্যন্ত খুশীতে গেছি, নিয়া গেছে, স্বাধীনভাবে চলব।
তা. ই. মাসুম: আপনাকে তো ২৬ তারিখ নিয়া গেল?
মো. খোদা হাফেজ: হ্যাঁ।
তা. ই. মাসুম: এরপর ছাড়ল কবে?
মো. খোদা হাফেজ: ১ মাস পরে আর কি। তখন ডিটেনশন দিয়েছিল ১ মাসের। সিকিউরিটি প্রিজনার হিসেবে। রাজবন্দী যাকে বলা হয় তখনকার দিনে। ৫ নম্বর আরে কত মজার কাহিনী হইছে? তো ঐ সময় আইবি যে আমাদের চার্জে ছিল, সে বলল যে, এরা তো সব বড় বড় অফিসার হইব, সলিমুল্লাহ হল থেকে আসছে এদেরকে সব ক্লাস দিয়া দাও। রাতারাতিই ক্লাস ওয়ানে দিয়া দিছে আমাদের। পরের দিন বুঝলাম আরকি।
যখন গেছি পরে তখন বলল, এই সিটে ভাসানী সাহেব ছিল, এই সিটে শেখ মুজিব ছিল, এখানে তর্কবাগীশ ছিল। সবই সরাইছে, সরাইয়া নিয়া খালি করছে আমাদের জন্য। তো থাকলাম। তারপরে জেলার আসছে, তো জেলার আইসা কিবরিয়াকে বলতেছে যে, দেইখা যান আপনারাইতো সংস্কার করবেন! তো আমাদের জেলের ব্যবস্থাপনাটা দেইখা যান। আমরাও মজা করতাম। আমি অবশ্য তখন থেকেই নামাজ পড়তাম। তখন তো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে হতো। আর ঐখানে নামাজের মধ্যেও লোক, হাফপ্যান্ট পড়া লোক মাঝে মাঝে দাঁড়াইয়া আছে, কথা বলে কি-না। ওরাও জানতো কী হয়, হা হা হা। নামাজে ওখানে কে কে আসছে ঐ খবর নেওয়ার জন্য, সিজদা দিয়া, সিজদার মধ্যে কী খবর? হা হা হা। সিজদার মধ্যে খবর। খবর দিয়া দিয়া এইগুলা আইসা আবার আমরা বলতাম। তো তখন এই সব ব্যাপার হইত আর কি।
তা. ই. মাসুম: আব্দুল মতিন সাহেবের সাথে আপনার যোগাযোগ কেমন ছিল?
মো. খোদা হাফেজ: ওনাকে বলা হতো ছাত্র মতিন। এটা বলার পিছনে অন্য একটা কারণ আছে, ভাষা মতিন বা ছাত্র মতিন। পরে হইছিল কি, উনি যখন কনটেস্ট (ইলেকশনে) করতে গেছিলেন সিরাজগঞ্জে। সেখানে আরেক মতিন ছিলেন আব্দুল মতিন। তার অন্য একটা নিক নেম ছিল, সেটা বলব না। একে বলা হতো ছাত্র মতিন আর তাকে অন্য মতিন বলা হইতো আর কি।
তা. ই. মাসুম: অন্য মতিনের নাম কি মতিন ছিল?
মো. খোদা হাফেজ: না, ঐটা বলব না, হা হা হা। এটা বলা ঠিক না, হি ইজ এ ডেড ম্যান। মুসলিম লীগের পরে প্রেসিডেন্ট হইছিলেন।
তা. ই. মাসুম: আব্দুল মতিন সাহেব ভাষা মতিন সাহেবও আব্দুল মতিন ই বলেছেন।
মো. খোদা হাফেজ: একই বাড়িতে, একই বাড়ি না, মানে একই জায়গায়।
তা. ই. মাসুম: একই কনস্টিটিউয়েন্সি।
মো. খোদা হাফেজ : হ্যাঁ, একই কনস্টিটিউয়েন্সি। দে কনটেস্টেড, সেখানে এই নামটা উঠছিল আর কি, যাইহোক। এটা, এটা বলা উচিৎ না। ঠিক আছে?
তো যাই হোক উনি (ভাষা মতিন), আমার সাথে লাস্ট ওনার সাথে দেখা হইছিল, একসময় উনি খুব আশা করছিল যে, আমি ওনার সাথে রাজনীতি করব। তো, আমারে একদিন বলতেছে সিরাজগঞ্জে দেখা, তখন আমি ব্যবসা করি। যাও আর কি একটা বিয়া কর? ওনার সাথে এই রকম সম্পর্ক ছিল আর কি।
তা. ই. মাসুম: ওনার সাথে রিলেশনটা ভাল ছিল?
মো. খোদা হাফেজ: আমরা তো জেলখানায়, জেলে একসাথে ছিলাম তো। ওনার এমএ’র রেজাল্টটা আমরা জেলখানায় পাই। ঐ সময়, আই হ্যাড ফরচুন যে, অনেকের সাথেই পরিচয় ছিল আমার। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি চাকরিতে যাওয়ার পরে, বেশি সিনসিয়ার হওয়ার ফলে, আমার পোস্টিং বিভিন্ন জায়গায় হওয়ার কারণে সবার সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখা হয় নাই।
চলবে…