চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সৃষ্টির কাছে আনা হলো স্রষ্টাকে, বিদায় জানাতে

দুপুর সোয়া ১২টায় ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের নিথর দেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে থেকে আনা হলো কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের পাদদেশে। এই ভাস্কর্য তৈরি করেছ্নে সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলার সামনে রাখা হয় মরদেহ। যেন শেষবারের মতো সৃষ্টি দেখে নিচ্ছে তার স্রষ্টাকে। বা স্রষ্টা বিদায় নিচ্ছেন সৃষ্টির কাছ থেকে। এ সময় সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের বন্ধু, সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

এখানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডাকসুর তৎকালীন সেক্রেটারি ম হামিদ বলেন, ‘ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ ডাকসুর সহযোগিতায় ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে “অপরাজেয় বাংলা” ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে কাজ করতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় এর নির্মাণ কাজ। ১৯৭৮ সালে আবার শুরু হয়। তখন তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ওই সময় সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদসহ ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাধার মুখে পড়তে হয়। মৌলবাদীরা নির্মাণ বন্ধ করতে আন্দোলন শুরু করে। ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসহ সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ এর পক্ষে অবস্থান নেন। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয় ‘অপরাজেয় বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী এই ভাস্কর্য নিয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিজয় বাঙালির ইতিহাসে আরেকটি বড় জয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। এজন্য বলি, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য থাকবে ততদিন অমলিন হয়ে থাকবে একটি নাম। তিনি সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ।’

সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদকে শ্রদ্ধা জানানো হয়

শিল্পী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সম্মিলিত সংস্কৃতি জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর ফকির আলমগির, কলা অনুষদের ডিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ নানা স্তরের ব্যক্তিবর্গ।

আব্দুল্লাহ খালিদের স্ত্রী উম্মে কুলসুম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের সবচেয়ে বড় ও ভালোবাসার কাজ ছিল এই অপরাজেয় বাংলা। এটা নির্মাণ করতে তাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুধু যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই বাধা দিয়েছেন, এমনটা নয়। তার অনেক বন্ধু, সহকর্মীও চাননি ভাস্কর্যটি নির্মাণ হোক। যার কারণে দেখেন, দেশের প্রায় সব ভাস্কর্যে ভাস্করের নাম থাকে। কিন্তু অপরাজেয় বাংলায় তার নাম নেই।’ অচিরেই তিনি অপরাজেয় বাংলায় সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের নাম ফলক স্থাপনের দাবি জানান।

অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সোয়া একটা পর্যন্ত রাখার পর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। যোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদকে শ্রদ্ধা জানান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা

গত ১০ মে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বারডেমের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিউ) চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তিনি ফুসফুস-সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছিলেন। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগেছেন।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ‘অপরাজেয় বাংলা’ স্থাপনার জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্রের সামনে অবস্থিত ম্যুরাল ‘আবহমান বাংলা’ ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান দপ্তরের সামনে টেরাকোটার ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ‘অঙ্কুর’, ‘অঙ্গীকার’, ‘ডলফিন’, ‘মা ও শিশু’ ইত্যাদি।

শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ২০১৪ সালে শিল্পকলা পদক এবং ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ সিলেট জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে চিত্রাঙ্কন বিষয়ে স্নাতক এবং পরে ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতা দিয়ে আবদুল্লাহ খালিদ কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭২ সালে সেখানকার প্রভাষক থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর উদ্যোগে কলাভবনের সামনে নির্মিতব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ‘অপরাজেয় বাংলা’ নির্মাণের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৭৩ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ শেষ করার পর স্থাপনাটির উদ্বোধন করা হয়।

ছবি: জাকির সবুজ