শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম উপকরণ বই। বই জ্ঞানের ধারক ও বাহক। বর্তমান সরকারের বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারী) আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার মতো মহৎ কার্যক্রম পালন করে আসছে। সামাজিকভাবেও বাংলাদেশের কোনো কোনো পরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে ছোট্ট সোনামণিদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়। পড়া লেখা শুরু করা হয়, যাকে বলে হাতেখড়ি।
দেশ আজ উন্নতির ধারবাহিকতায় এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শিশুর জন্য বই নির্ধারণে কোন যাচাই-বাছাই নাই। শিশুর প্রথম পাঠ বর্ণ পরিচয় বই, তাতে আছে (সব বর্ণপরিচয় নয়) ”অ-তে অজগর, অজগরটি আসছে তেড়ে। আমি প্রত্যক্ষদর্শী ২০১৮ সালে চার বছরের শিশুকে পড়তে দেওয়া হলো এমন ভয়ঙ্কর বর্ণপরিচয় বই। অভিভাবকের মাঝে সচেতনতার অভাব থাকতেই পারে। প্রশ্ন থেকে যায়, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এখনো কেন এসব বর্ণপরিচয়মূলক বই নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়না।বাঙ্গালি সংস্কৃতির একটা বিশেষ অংশ নাচ। মধ্যযুগে বা এরও আগে নাচ ছিলো রাজপ্রাসাদে নর্তকীর নাচ। সেখানে কৃতদাসী যুবতি মেয়েকে বাদ্ধ করা হত নাচতে।
আজ আর দাসপ্রথা নেই। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের রুচি ও প্রথারও পরিবর্তন হয়েছে। যুবতি মেয়ে নর্তকী বা বাঈজী থেকে মুক্ত। আজ তাদের পরিচয় নৃত্য শিল্পী রূপে। বাংলাদেশ সহ আধুনিক বিশ্বে “নাচ” একটি শিল্প হিসেবে পরিগনিত হয়েছে। বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণীদের মাঝে নাচের প্রতি দারুণ ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। এখন আর কাউকে পেশাদারী নর্তক-নর্তকী বলে ঘৃণা বা অবহেলা করা হয়না। বরং নৃত্যশিল্পী হিসেবে তাদের রয়েছে অনেক কদর ও সম্মান। মনিপুরি নাচ দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। ক্লাসিক ও বিভিন্ন ধরণের নাচ দেখে আমাদেরও চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়।
তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো, যা প্রথম চোখে পড়লো ‘নাকিব কিন্ডার গারটেন” এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালীন, আট-নয় বছর বয়সের এক ছাত্রী “আজি বা হাল করিয়া বাজান কে দুতারা সুন্দরী কমলা নাচে” (বর্তমানে সময়ের দাবিতে যুবতী, সুন্দরী ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ বেমানান) গানটির তালে তালে নাচে। মেয়ে শিশুটি নাচ শেষ করে মধ্যযুগীয় কায়দায় দর্শকদের উদ্দেশে মাথা নোয়ালো।
এরপর থেকে বিষয়টি অনেক বার নজরে পরল। এইতো ২০১৮তে এক স্কুলে আসনে উপবিষ্ট শিক্ষকদের ছাত্রীরা হাতে হাতে ফুলের মালা দিয়ে (মাথা নত করে) বরণ করে নিতে বাধ্য করা হল যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় কন্যা শিশুদের ব্যাক্তিত্বের-আত্মমর্যাদার বিকাশ ঘটার সুযোগ নেই।
প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু এদেশের কোনও নিষেধই ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর হয় না, যতক্ষণ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়। রাস্তা-ঘাটে স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের ধূমপান করতে দেখলে তা মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি যেমন বেমানান তেমনি ক্ষতিকর। রাস্তায় চলতে গেলে ভালো কিছুও চোখে পরে। যেমন- লক্ষ্য করলে বা কথা বললে জানা যায় দুইএকটা শিক্ষার্থী পেটের দায়ে রিক্সা চালাচ্ছে। এতে তাদের প্রতি মমতায় মনটা ভরে যায়।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্বজুড়ে অনেকটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেন এটি একটি বিশাল পরিবার যেখানে বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে যোগাযোগ হয় মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মীর সাথে। অথচ সেখানে কিছু অশোভন মন্তব্য লেখা হয়, যা আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হওয়া আবশ্যক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শালীনতাপূর্ণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য।
দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী ৪ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করল। বার্ষিক পরিক্ষা চলাকালীন কেন্দ্রের ভিতর পরিক্ষারত অবস্থায় অরিত্রীর নিকট মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিভাবক ডেকে অপমান করেছেন বলে জানা যায়। মা-বাবার প্রতি সেই অপমান সইতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যা করে। প্রধান শিক্ষকের প্রতি আত্মহত্যার দায়ভার চাপিয়ে অভিযোগ উঠলো অত্র স্কুলের ছাত্রী-অভিভাবক সহ বিভিন্ন জনের নিকট থেকে। প্রায় সকল শিক্ষার্থী স্কুল-প্রাঙ্গণে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। একপর্যায়ে তাদের তোষামোদ করে, আন্দোলন থামিয়ে ঘরে ফেরা সহ বাকি পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করার সম্মতি আদায় করা হয়। প্রধান শিক্ষক মূলত স্কুলের নীতি-নির্ধারণ অনুযায়ী অভিভাবক ডেকে দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। কেননা, ভিকারুননিসা স্কুল জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এতদূর এগিয়ে আসে নি।
নবম শ্রেণির কোমলমতি ছাত্রী অরিত্রী আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যার মত হীন কাজটি করে ফেলেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শান্ত করে বোঝানো দরকার ছিল যে, তাদের আন্দোলন অযৌক্তিক এবং অনুচিত (কেননা, শিক্ষক এবং পিতা-মাতা প্রয়োজনে যত কঠোরই হোক তা তাদের কল্যাণে) তাদের আরও প্রয়োজন ছিল, এমন শপথ করানো- “আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে আবেগ তাড়িত হয়ে আত্মহত্যা করব না।”
অথচ আলোচ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-অভিভাবক উভয়েই ছাত্র এবং সন্তান দ্বারা নিজেদের হুমকির মুখে দার করিয়েছেন।
অন্যদিকে, ২০১৮ তেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা “নিরাপদ সড়ক চাই” নামে আন্দোলনের মাধ্যমে যে ভূমিকা রেখেছে তা প্রশংসনীয়।
“মানুষ বাস করে সমাজে আর পশু ও দেবতারা বনে” গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের পুরনো বাণী সময়ের প্রবাহে আজ অনেকটাই বদলে গেছে। তাই সমাজেও আজকাল পশুর বিচরণ দেখা যায়। অবিকল মানুষের চেহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে পরিবারের ভিতরে, রাস্তায়, বাসে বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
পরিবারের পরেই ছেলে-মেয়েদের নিরাপদ স্থান বিদ্যালয়। শিক্ষক নামের মহান ব্যাক্তি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে সু-মানুষ করে গড়ে তুলবেন এমনটিই ছিল চিরাচারিত নিয়ম। কিন্তু শিক্ষক নিজেই যখন অমানুষ হয়ে পড়েন তখন আর কিভাবে সম্ভব তার দ্বারা মানুষ তৈরি করা।
সাম্প্রতিক কালের নুসরাত হত্যাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এমন অমানবিক-মরমান্তিক মৃত্যু! এর চাইতে পাশবিক আর নিকৃষ্ট কাজ আর কি হতে পারে। এমন হৃদয় বিদারক মৃত্যু কোন মানুষের পক্ষে ক্ষমা করা সম্ভব নয়। এমন নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর ঘটনা শিশুর বর্ণপরিচয় বইয়ের মধ্যেই কেবল মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
অ-তে অজগর “অজগরটি আসছে তেড়ে”!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)