বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমের একটি খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিপন্নতায় সু চি মর্মাহত, তিনি ভেঙে পড়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক উপদেষ্টার বরাতে ওই সংবাদটি পড়ে অনেকেই হেসে ফেলতে পারেন বা মনে হতে পারে যে, ‘শান্তির দূত’ বোধ হয় কেবলই জানলেন যে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চলছে।
১৮ অক্টোবর রোহিঙ্গা বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীও অং সান সু চি একজন সংবেদনশীল মানুষ বলে অভিহিত করেন। বলেন, তিনি সারাজীবন সামরিকতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন। যদিও এরপরে আল জাজিরা টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাখাইনের রোহিঙ্গা সংকটের জন্য সু চিকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, সু চি যদি রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন থামাতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত।
বস্তুত মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি কখনোই তার বক্তব্যে এটা স্বীকার করেননি যে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণগত্যা ও জেনোসাইড চলছে এবং সেখানে এথনিং ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূলের অভিযানও তিনি এড়িয়ে যান। ফলে তিনি ‘মর্মাহত’ বলে যে খবর এসেছে তাতে এরকমটি আশা করার কোনো কারণ নেই যে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কালই হয়ে যাচ্ছে। কেননা এখনও প্রতিনিয়ত রাখাইনে বর্বরতার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সু চি’র সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিলে মিয়ানমার আবারও সেনা অভ্যুত্থানের মুখে পড়তে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কেননা রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেনাবাহিনী এবং কট্টর বৌদ্ধদের ক্ষেপাতে চান না সু চি।
কথায় বলে ঠ্যালার নাম বাবাজি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর এখনও সেরকম কোনো ঠ্যালা দেয়া সম্ভব না হলেও সম্প্রতি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা মিয়ানমারের জন্য ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা বাতিল করেছে। এতে বলা হয়, রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া মিয়ানমারের উন্নয়ন বিষয়ক ওই ঋণের পুন র্মূল্যায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈষম্যহীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমান সুযোগে বিশ্বাসী সংস্থা হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং তাদের জোর করে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় বিশ্বব্যাংক উদ্বিগ্ন।
তবে অবরোধের শিকার হওয়া মিয়ানমারের জন্য নতুন কিছু নয়। চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৮৯ সাল থেকে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মার্কিন প্রশাসন। অবশেষে গত বছরের অক্টোবরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। মনে রাখা দরকার, ওই মাসেই রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নতুন করে গণহত্যা শুরু করে মিয়ামনার সরকার। ফলে বিশ্বব্যাংকের এই ঋণসহায়তা বাতিলকে মিয়ানমার কতটা আমলে নেবে তা বলা মুশকিল।
তারপরও জাতিসংঘসহ বিশ্ব জনমত যেভাবে মিয়ানমারের বিপক্ষে গেছে এবং সারা বিশ্বেই শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি যেভাবে ধিকৃত হচ্ছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ড এবং কথাবার্তায় এখন অনেকেই মনে করছেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার হয়তো কিছুটা নমনীয় হচ্ছে।
১৪ অক্টোবর কক্সবাজারে এক প্রেস বিফ্রিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে নমনীয় হওয়া ছাড়া মিয়ানমারের আর কোনো উপায় থাকবে না। ১২ অক্টোবর রাতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে সু চি বলেন, রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সাথে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। যদিও তিনি ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি।
এর দুদিন পর ১৪ অক্টোবর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়, রাখাইনে গণহত্যার বিষয়ে তারা অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছে। এজন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সেনা কর্তৃপক্ষ। বলা হয়, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আয়ে উইনের নেতৃত্বে গঠিত এই তদন্ত কমিটির সদস্যরা খতিয়ে দেখবেন, রাখাইনে সেনা সদস্যরা সামরিক ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ বা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না। বস্তুত এটিও হাস্যকর ব্যাপার। কেননা, এ কথা এখন আর কারো অজানা নেই যে, মিয়ানমারের সেনা প্রধান নিজেই রোহিঙ্গা নিধনের মূল উস্কানিদাতা। সুতরাং সেখানে সেনা সদস্যদের জন্য কী আচরণবিধি থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। সেনা প্রধানের কট্টর অবস্থানের মধ্যে সেনাবাহিনী আসলে কী তদন্ত করবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
তবে আশার কথা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের দাবি ক্রমেই প্রবল হচ্ছে।১৩৭তম আইপিইউ সম্মেলনে ‘ইমার্জেন্সি আইটেম’ হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়। জাতিসংঘের চেয়েও বয়সে প্রবীণ বিশ্বের ১৭৩ টি দেশের ৬৫০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল এই সংসদীয় ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুটি গৃহীত হওয়ার ঘটনা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমতের প্রতিফলন বলেই বিবেচনা করা যায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের এমপিরাও। তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের নিপীড়নকে জাতিগত নিধন (এথনিক ক্লিনজিং) আখ্যা দিয়ে প্রস্তাব পাস করেন।
তবে এসব প্রস্তাব পাস কিংবা বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তা স্থগিতও শেষমেষ মিয়ানমারকে কতটা নমনীয় করবে বা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাদের উদ্যোগী হতে বাধ্য করবে তা বলা কঠিন। কেননা, রাখাইনের যে অঞ্চলে নিধন চলছে সেখানে মিয়ানমারের বড় ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বজনমতকে যে তারা খুব একটা পাত্তা দেয় না, তাও তারা এরইমধ্যে প্রমাণ বুঝিয়ে দিয়েছে।
অনেকে মনে করেন, আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব। বাংলাদেশ সফরে এসে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদিও এই মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো মিয়ানমার এখনও রাখাইনে নিধন চালাচ্ছে। প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিগগিরই পুরো রাখাইন রোহিঙ্গাশূন্য হবে তাতে সন্দেহ কম। আর যদি তাই হয়, তাহলে এর প্রধান ভিকটিম হবে বাংলাদেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)