পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বিশ্বের নামিদামি আঁকিয়ের চিত্রশিল্পগুলোর সাথে প্রদর্শীত হয় বাংলাদেশের অখ্যাত এক গ্রাম্য শিল্পীর ছবি। সেই সময় চিত্রশিল্প বাংলাদেশে এতোটা প্রভাব বিস্তার করেনি, শিল্পবোদ্ধাও আজকের মত এতো ছিল না বিধায় আধুনিক সমাজে বিশ্বজয় করা নড়াইলের এক তরুণশিল্পীর কথাও কান এড়িয়ে যায় সকলের। একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার নাম ছড়িয়ে গেলেও নিজের দেশেই তিনি অনাবিষ্কৃত! কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর সেই শিল্পীর কথা আর অজানা থাকে না বাংলাদেশের মানুষের। ১৯৭৬ সালে তাই রাজধানী ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয় বিশ্বজয়ী প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে। যিনি জীবনের অর্ধেকটা সময়েই কাটিয়ে এসেছেন নড়াইলের এক গ্রামে, যদিও ইউরোপ, আমেরিকায় জীবন যাপনের সুযোগ ছিল এই মহান শিল্পীর।
যাই হোক, চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রথমবার নড়াইল থেকে ঢাকায় আসেন এস এম সুলতান, দেশের শিল্পসমাজে নতুন করে পরিচিতি পান তিনি। আর সেই সময় এই গুণী চিত্রশিল্পীর সাথে পরিচিত হন বাংলাদেশের ‘ছবির কবি’ খ্যাত পোট্রেট ছবির জনক নাসির আলী মামুন। ১৯৯৪ সালে এস এম সুলতানের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় কুড়ি বছর সুসম্পর্ক ছিল তার। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য নাসির আলী মামুন এস এম সুলতানের মৃত্যুদিনে স্মৃতিচারণ করেছেন কিছু অজানা বিষয়ের।
প্রথম মুখোমুখি হওয়া…
১৯৭৬ সালের যখন এস এম সুলতান যখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আমন্ত্রণে ছবি আঁকার প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় আসেন তখন আমার প্রথম পরিচয় তাঁর সাথে। এই প্রথম আমরা জানলাম বাংলাদেশে এস এম সুলতান নামের একজন আর্টিস্ট আছেন যাঁর আঁকা ছবি সমকালীন সময়ে পুরো ভারতবর্ষের আঁকা কোনো শিল্পীর সাথে মেলে না। শিল্প-সমাজে প্রশ্ন উঠলো ‘কে এই শিল্পী’। যদিও তাঁর বিকাশ ঘটে গেছে আরো বহু আগে, কিন্তু বাংলাদেশে চিত্র আলোচনা খুব বেশি দিন আগে শুরু না হওয়ায় তাঁকে আমাদের শিল্প সমাজ একটু দেরিতেই আবিষ্কার করে। একজন শিল্পীর আঁকা ছবিতে যে গভীরতা থাকে সেসব নিয়ে আলোচনা খুব একটা আগে হত না। শুধু রিপোর্টিংয়ের মত করে উল্লেখ করা থাকতো কোথায় কয়টা প্রদর্শনী এইসব। কিন্তু শিল্প হিসেবে আলোচনা করার যে গভীরতা থাকা দরকার, ছবির নান্দনিক বৈশিষ্ট্য ও মৌলিকতা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন সে সময়টায় তা ছিল না; এটা শুরু হয়েছে গত পনেরো বিশ বছর হলো। ফলে আমরা জানতামও না যে পঞ্চাশের দশকে পিকাসো, দালির মত জগৎখ্যাত চিত্রশিল্পীর সাথে প্রদর্শন হয়েছে আমাদের নড়াইলের এক তরুণ প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবির। এটা কিন্তু বিরাট ব্যাপার। বিশাল সম্মানেরও।
এমন মহান মানুষ ও শিল্পীর সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন প্রয়াত মতিউর রহমান। যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথমবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে এস এম সুলতানের চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তিনিই নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড় থেকে ঢাকায় এস এম সুলতানকে নিয়ে এসে চিত্রপ্রদর্শন করেন। ঢাকায় সুলতানের সাথে পরিচয়ের পর প্রচুর মিশেছি তাঁর সাথে। আমি বয়সে এত ছোট, কিন্তু তারপরেও তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমি তাঁকে রমনা পার্কে নিয়ে গিয়ে প্রচুর পোট্রেট তুলেছি।
দেশিয় চিত্রকলায় একাই শুরু একাই শেষ:
পৃথিবীর বহু জায়গায় শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা ছবির প্রদর্শন হলেও, ঢাকায় প্রথমবার তাঁর চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন ভাস্কর মতিউর রহমান। আর এইসব নিয়েও কম রাজনীতি হয়নি। প্রদর্শনীর সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করলেও সন্দিহান ছিলেন, প্রদর্শনীটি শেষ পর্যন্ত হবে কি, হবে না এই বিষয়ে। কারণ অনেক বাধাবিপত্তি ছিল এস এম সুলতানের আঁকা ছবি নিয়ে। আর রাজধানী কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন এস এম সুলতান। এবং একই জিনিস তার মৃত্যুর পরেও জারি ছিল। কারণ, চিত্রকলার ইতিহাসে বাংলাদেশে এস এম সুলতান একাই শুরু একাই শেষ। তার মত কেউ ছিলও না, এখন পর্যন্ত কেউ নাই। নানা কারণেই তিনি রাজনীতির শিকার, বৈষম্যের শিকার, এমনকি তাকে শিল্প সৃষ্টি নিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই ৭৬ সালে যখন আমরা তাকে চিনি, তার আগেও কিন্তু এস এম সুলতানের চিত্র কোথাও কোথাও প্রদর্শন হয়েছে, কিন্তু এসবের খবর কোথাও প্রচার হতে দেয়া হয়নি। যশোর, নড়াইল ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় তার এক্সিবিশন করা হয়েছে, সেসব খবর আমরা পাইনি। এমনকি ঢাকাতেও প্রদর্শনী করার অনেক চেষ্টা করলেও তাকে তা করতে দেয়া হয়নি। তার অনেক বন্ধু বান্ধবও ঢাকায় এস এম সুলতানের চিত্র প্রদর্শনী করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ঢাকার কোথাও তাঁর ছবি প্রদর্শনী করার অনুমতি মেলেনি।
এরপর মতিউর রহমানের বাসায় কিছুদিন থাকার পর ইরানি দূতাবাসের একজন সাংস্কৃতিক মানুষ সোলেমানির চোখে পড়ে এস এম সুলতানের ছবি, তিনি মুগ্ধ হন ছবিগুলো দেখে, এবং এস এম সুলতানের জীবন যাপনও তার মনে ধরে। সুলতানকে তার বাসায় নিয়ে যান এবং তার ওখানেই রাখেন। কিন্তু কূটনৈতিক পাড়ায় হৈ চৈ পড়ে যায় যে, বিদেশী দূতাবাসে বাংলাদেশের একজন নাগরিককে আশ্রয় দেয়া যায় কি না। চারদিক থেকে নানান প্রশ্ন আসতে থাকে। এটা আসলে বাংলাদেশের তৎকালীন চিত্রকলার কিছু মানুষ এই পরিস্থিতি তৈরি করেন ঈর্ষান্বিত হয়ে। কারণ তারাতো সুলতানের চিত্রকর্ম দেখে রীতিমত ভীত হয়ে পড়েছিল। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়ায়। তারপর রাষ্ট্র সোলেমানিকে বলে দেয় যে, তোমার বাসায় এস এম সুলতানকে রাখা যাবে না। ফলে সোলেমানি বাধ্য হয় সুলতানকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দিতে। শেষ পর্যন্ত সোলেমানি অন্যত্র বাসা ভাড়া করে দেন সুলতানের জন্য, যাতে তিনি ছবি আঁকতে পারেন।
একজন বোহেমিয়ান এস এম সুলতান:
আপদমস্তক একজন বোহেমিয়ান মানুষ ছিলেন এস এম সুলতান। শহর তার খুব একটা পছন্দের ছিল না। তিনি গ্রামকে ভালোবাসতেন। তাই দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে মতিউর রহমান যখন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন, এবং কয়েকমাস তিনি ঢাকায় ছিলেনও। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা যায়, তিনি কাউকে না বলেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। সারাজীবনই তিনি এমন করেছেন। এইভাবেই তিনি জীবন যাপন করতেন। এর আগেও যখন তিনি কাশ্মিরে, ভারতের সিমলাসহ বিভিন্ন রাজ্যে তার ছবির প্রদর্শন হয়েছে, সব প্রদর্শনেই তিনি উপস্থিত থাকতেন। বেশির ভাগ সময়ই উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজের কাপড় চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে ছবি রেখেই কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। এটা তার রক্তের মধ্যে ছিল, সেই শৈশব থেকেই। বাংলাদেশে তার মতন বহিমিনিজম আর কারো মধ্যে ছিল না, অনেক বহিমিয়ান আছে কিন্তু এই ধরণের বহিমিয়ানিজম আর কারো মাঝে দেখিনি।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেয়া