জীবনানন্দ দাস তখন তার নিজ সৃষ্ট নির্জন কোণে মহাসমারোহে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাচ্ছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে যথারীতি নিমগ্ন নিজস্ব নির্জনতায়। বুদ্ধদেব বসু তো রীতিমত ‘The era of Rabindranath is over’ ঘোষণা দিয়ে রণাঙ্গনে নেমেছেন নতুন কাব্য ভাষা নির্মাণ সাধনায়। ঠিক তখন বুদ্ধদেব বসুর পরামর্শে গদ্যছন্দ তুনে জুঁড়ে শব্দসর ছুঁড়ছেন অনতিদীর্ঘ কবি জীবনধারী সমর সেন। রবীন্দ্রনাথ তখন তার কাছে জোল মনে হয়, ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না ‘দুধ ও তামাকে সমান আগ্রহী এই কবিকে।’ উর্বশীর কাছে সমরের সদর্প আহ্বান এভাবে, ‘তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে/দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো।’ প্রবল বিরোধিতা সত্বেও বুদ্ধদেব বসু এক পর্যায়ে মেনে নিতে বাধ্য হন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আধুনিক বাঙালি কবির প্রচেষ্টায় অনিবার্য।’ মেনে নিয়েই আবার বলেন সমর এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম, এই নবীন কবি রবীন্দ্রনাথে যেন কোন অবলম্বন খুঁজে পাননি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে থেকে সমর তৈরি করছেন নতুন পথ। সমর সেনের কথা এতটা বলবার কারণ বহুল প্রচলিত যে, সমর যেখানে থেমে গেছেন সেখান থেকে সুভাষের শুরু। এখানে সুভাষের জন্য স্বীকৃতির জায়গাটা হলো তার পথচলার শুরুটা নতুন পথে। আর সমর সেনের অমর মেধার সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়েও বলতে হয়- ‘সুভাষ তার মতো’ সে অর্থে বাংলা কবিতায় তার কোন পূর্বসূরি নেই। তিনি নিজ পায়ে পথচলা ‘পদাতিক’ যিনি বাংলা কাব্য ভূবনে নির্মাণ করেছেণ নতুন পথ।
আমাদের কয়েক প্রজন্মের কাছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার কবিতার মতোই ‘মিছিলের মুখ।’ কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষ মানেই
‘স্ট্রাইক। স্ট্রাইক।
পথে পথে আজ হোক মোকাবিলা, দেখি কার কত শক্তি।’
কাক রঙা ঝাঁকড়া চুলের সুভাষ তখন আমাদের কাছে সাহসের আরেক নাম। আমাদের হৃদয়ে সে চুলে কখনও সাদার ছোপ লাগেনি। লাগবে কী করে? তিনি তো আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।’ তিনি চির বসন্তের কবি। ভগিনী স্থানীয় একজনের সম্মান রক্ষার্থে মাস্তানদের সাথে ঘুসোঘুসিতে সামনের দাঁত ভাঙ্গা ভাঙ্গনের বার্তাবাহক এক কবি। তিনি ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যিনি ভূমি, ভাষা, ভবিষ্যৎ এর কথা বলতে এসেছেন সেই সঙ্গে ভালবাসার কথাও। পণ করেছেন তাড়িয়ে দেবেন আরেক ‘ভ’ অর্থাৎ ভয়কে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। ভবানীপুর মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিক। ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্সসহ বিএ। চেষ্টা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এর বেশি অগ্রসর হয়নি তার পড়াশোনা । ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল এ যোগ দেন। সমর সেন এর কাছ থেকে পাওয়া ‘হ্যান্ডবুক অব মার্কসসিজমের’ মাধ্যমে মার্কসবাদে দীক্ষা। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ ১৯৪০ সালে। কবির বয়স তখন একুশ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কাব্যোলোচনার শুরুতে সামনে রাখতে হবে তার শুরুর সময়ের ছবি। সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে জর্জরিত পৃথিবীতে ত্রিশের দশকের রাজনৈতিক ব্যারোমিটারের পারদ রেখার ঘন ঘন উত্থান-পতনের। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হিটলারের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার, চীনে জাপানের হামলা, স্পেনে ফ্যাসিজম-কমিউনিজম দ্বন্দ্ব, মিউনিখ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্রের বার্তা যেমন প্রভাব ফেলেছে তার রচনায়। তেমনি দেশের অভ্যন্তরে বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যাকলাপ, বামপন্থী দল-উপদল, গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযান, সুভাষ বসুর উত্থান, অর্থনৈতিক মন্দা, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তাকে প্রভাবিত করেছে সমান। সরাসরি প্রভাবিত করেছে তার পদাতিক পর্যায়ের ১৯৪০-৫০ এর কালে প্রকাশিত পদাতিক, অগ্নিকোণ, চিরকুট তিনটি কাব্যগ্রন্থকে। কোন সন্দেহ নেই ‘পদাতিক’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে একুশের এ যুবক কবি নাম লিখিয়েছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে অমরত্বের পাতায়, এতটাই ব্যতিক্রম তার ভাষা। তার শব্দেরা তার নিজের, নির্মেদ কবিতার শরীর, প্রকাশ সরাসরি, স্পষ্ট। নিজে যে জ্বলন্ত সময়ের প্রতিনিধি তাকে অস্বীকারের কোন চেষ্টা করেননি। প্রথম থেকেই তো তিনি মানুষের মিছিলের এক কমরেড। তিনি তো মানুষের কথা বলবেনই। তবে এও সত্যি ইতিহাস নির্ধারিত সীমাবদ্ধতা তার কবি হয়ে উঠার পথে কোন বাঁধা দেয়নি। তার ভাষায়, ‘শ্রমিক আন্দোলন করতে করতেই আমার চারপাশের জীবন আমাকে লেখার দিকে ঠেলে দিল।’ একুশ বছরের এক তরুণ, সরলবিশ্বাস, পবিত্র আবেগ, বজ্র কঠিন প্রতিবাদী সঙ্কল্প নিয়ে বাংলা কবিতার আকাশে চল্লিশের দশকে নিয়ে উদয় হলেন যে কাব্যগ্রন্থে তার নাম -‘পদাতিক।’ বুদ্ধদেব বসু লিখতে বাধ্য হলেন, ‘অভিনন্দন তাকে আমরা জানাবো, কিন্তু তা শুধু এ কারণে নয় যে, তিনি এখন কবিকনিষ্ঠ। কিংবা নিছক এ কারণেও নয় যে তার কবিতা অভিনব। যদিও তার অভিনবত্ব পদে পদে চমক লাগায়। প্রথমতঃ তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙ্গালী কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্য জীবন আরম্ভ করলেন না। কোন অস্পষ্ট মধুর সৌরভ তার রচনায় নেই যা সমর সেনের প্রথম কবিতাগুলোতে লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত: কলাকৌশলে তার দখল এতই অসামান্য যে কাব্যরচনায় তার চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষনীয় আছে বলে মনে করি’। পদাতিক যে ভিন্নধর্মী এক কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বাংলা কবিতার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছিল একথা না মানলে ইতিহাসের অপলাপই করা হবে। প্রশ্ন পদাতিকের কবি কি কালোর্ত্তীর্ণ হতে পেরেছেন? উত্তরেও প্রশ্ন করা যায় কেন নয়? পদাতিকের সঙ্গে আজকের প্রজন্মের দুরত্ব সাত দশকেরও বেশি তার পরও ভাষা ও প্রকরনগত অনন্যতা নিযে আজও পদাতিক তার পথে হেঁটে চলেছে সসন্মানে । বুদ্ধিবিজড়িত সপ্রতিভ কবিতাভাষা, বিশ্বাস আর বিদ্রুপের তীব্র ঝাঁকুনি, ছন্দের বিস্ময়কর কাজ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তারুণ্যে ভরপুর, চিৎকৃত উচ্ছ্বাসে উদ্বেল পদাতিকের সবগুলো কবিতাই যে কালোত্তীর্ণ এ দাবি করছি না। মেনে নিচ্ছি ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সকালের গান’ এর ‘কমরেড আজ নবযুগ আনবে না?’ নির্দিষ্ট আর্দশের আহ্বান। কমরেড ছেড়ে দিন, ‘আজ নবযুগ আনবে না?’ কি সবার অন্তরের চাওয়া নয় সমষ্টির কাছে? একুশের এক তরুণ যার আছে নিজস্ব বিশ্বাস তার কাছে প্রত্যাশার একটা সীমারেখা থাকা উচিত। অথবা আসুন “প্রস্তাব ১৯৪০“ কবিতাটিতে যেখানে কামানের শব্দের বিপরীতে এ কবির সরল ধিক্কারে চিৎকার, ‘চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাবো কান।” ‘নির্বাচনিক’ কবিতায় বাক্যবন্ধনীতে (অহো! সম্প্রতি মাঘের দ্বন্ধে ছত্রভঙ্গ দক্ষিণের সেনা/ সদলে বসন্ত তাও পদত্যাগপত্র পাঠাবেনা?)। মানছি পদাতিকের রাজনৈতিক কবিতা উচ্চকিত কিন্তু “বধু” কবিতাটি? তৃতীয় সুরের ছোঁয়ায় অনন্য। পদাতিকের নাম কবিতাটি কি আমরা আলাদা করে বিবেচনায় নেব না যেখানে তিনি বলেন,
‘উদাসীন ঈশ্বর কেঁপে উঠবে না কি
আমাদের পদাতিক পদক্ষেপে?’
দাবিসমালোচক অমলেন্দু বিশ্বাস এর সতর্কতার দাবি মেনেও বলা যায় সুভাষের ভাগ্যে সুইনবার্নে বা জেমস বেইলীর পরিণতি জোটেনি। তিনি হারিয়ে যাননি, শংকার কোন কারণ ছিল না। পদাতিক পর্যায়ের অন্য দুটি কাব্যগ্রন্থ চিরকুট এবং অগ্নিকোণ পদাতিকের মতো আদৃত না হলেও মানতেই হয় গ্রন্থদুটি পদাতিক কবির যাত্রাকে পূর্ণতা দিয়েছিল। চিরকুটের শুরুতেই কবি বলেছেন, ‘সেদিনের শাণিত ধার হারিয়েছি।’ কিন্তু যা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন তা হলো কবিতার স্বল্পভাষ ‘মন্ত্রগুপ্তি’। গঠনমূলক আয়তন নির্মাণ এবং কবিতা যাপনে মানুষের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। স্তম্ভিত বেদনার ছবি, আলতো আশার আলো নান্দনিকতা নিয়ে ধরা দিয়েছে চিরকুটের ‘স্বাগত’, ‘বর্ষশেষ’ প্রভৃতি কবিতায়। অনেকের মতে “স্বাগত“ কবির সেরা কবিতা। অন্তত দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী কবিতা তো বটেই। যেখানে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় শ্মশানে থেকে মৃতপ্রায় জনস্রোত শোনে,/ মাঠের ফসল দিন গোনে।’। ‘এই আশ্বিনেতে’ চমকে দেয়া বেদনার অচেনা সুরে তিনি বলেন,
‘গ্রাম করে খাঁ খাঁ-
শোকাচ্ছন্ন পড়ে থাকে
ভগ্নদূত শাঁখা!’
চিরকুটে যেখানে পদাতিকের সুর, সেখানে অগ্নিকোণে আমরা পাই অন্য এক সুভাষ, এখানে সমর সেনের মতো গদ্য ছন্দ আর সুকান্তের মতো সহজ সাধারণ স্তবক বিন্যাসের চেষ্টা লক্ষ্যণীয়, ‘সীমান্তের চিঠি’ কবিতাটি উল্লেখের দাবি রাখে।
‘তোমাকে ভুলিনি আমি
তুমি যেন ভুলোনা আমায়।
তোমার সহস্র চোখ
চেয়ে আছে তারায়।
পর্বত দাঁড়ায় পাশে
অগ্নিবর্ণ বনের সবুজ
– এখানে প্রস্তুত আমি
প্রতিশ্রুত আমার পৌরুষ।’
‘ঝড় আসছে’ কবিতার উচ্চারণ জানিয়ে দিচ্ছিল সহজ শব্দ তার কত বেশী করায়ত্ত। এ পর্বেই তো তিনি কবি কিশোর সুকান্তের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল হয়ে লিখেছেন
‘সুকান্ত, তোমার সেই আততায়ীকে
পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিয়ে
তোমাকে বাঁচাব।’ (উজ্জীবন)
পদাতিক পর্বের কবিতাগুলো পড়লে এটা মানতে হয়, হয়ত প্রতিটি কবিতা নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয় কিন্তু বেশ কিছু কবিতা মানুষের চিরকালীন সুরে পরিণত হয়েছে। তার বিদ্রোহ লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রামে। ১৯৫৭ তে প্রকাশ তার কাব্য গ্রন্থ “ফুল ফুটুক।” এখান থেকেই নতুন মাত্রা পেল তার কবিতা। ততদিনে এক চরম নান্দনিক সত্যের ঘড়বসতি তার বিশ্বাসে তা হল, সেই শিল্পই খাটি শিল্প যার দর্পনে জীবন প্রতিফলিত। সেটাই খাঁটি শিল্প যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যে ধারণা দেয় না। ততদিনে গড়ে নিয়েছেন নিজস্ব ভাষারীতি যেখানে তিনি কবিতার, গদ্যের আর কথা বলবার ভাষার ভিন্নতা স্বীকার করেন না। তার ভাষা তখন বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র, গভীর এবং অনাড়ম্বর। ‘কটা দিন’ কবিতায় আঁকা অন্ধকারের এক আশ্চর্য ছবি বোধকরি উদাহরণ হিসেবে যথেষ্ট,
‘জলায় এবার ভাল ধান হবে
বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে
এ বাড়ির বউ এল আলো হাতে
সারাটা উঠোন জুড়ে
অন্ধকার নাচাতে নাচাতে।
তার এই বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে তার বাকী জীবনের রচনায়। সঙ্গী ছিল আশ্চর্য সরল ভাষা যা একান্তই তার নিজের। তাইতো অনেকটা পথ পেরিয়ে ১৯৭৯ এ ‘একটু পা চালিয়ে ভাই‘ এ ‘ঝুলতে ঝুলতে’ নাম কবিতায় তিনি বলেন
‘আমার যে বন্ধুরা পৃথিবীকে বদলাবে বলে ছিল
ত্বরা সাইতে না পেরে
এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বদলে ফেলেছে।
আমি এক পায়ে এখনও পা-দানিতে ঝুলছি
মুঠো আলগা হয়ে এসেছে, আমার কপাল ভালো।
ঘাড় ফিরিয়ে
কিছুতেই পেছনে তাকাতে পারছি না।’
‘জল সইতে‘ যাচ্ছি শিরোনামে ও মেঘ/ও হাওয়া/ও রোদ/ও ছায়া/যাচ্ছি…। যার শেষ পুতুল/যাচ্ছি/শপথ/ যাচ্ছি/ও ছায়া/যাচ্ছি/ও মায়া আসছি।
সত্য বলতে ‘শপথ’ ছেড়ে ‘মায়ায়’ যাত্রার শুরুটা ৭০ দশকের শুরুতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করলেও সমর্থন করেনি নকশাল আন্দোলন। যে আন্দোলনের সেনাপতি পদে ছিল তার অনায়াস অধিকার। ১৯৭৭ এ জরুরী অবস্থাকে সমর্থন করে এসেছেন সমালোচনার কেন্দ্রে। পরিনতি ১৯৮১তে রণকৌশল ও রাজনৈতিক প্রশ্নে পার্টির সদস্য পদ ত্যাগ। নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে তার শিল্পর চেয়ে বড় হয়ে ওঠে আদর্শিক আনুগত্য। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কে কাকে নিতে পারেনি সুভাষকে পার্টি, না পার্টিকে সুভাষ? সে প্রশ্ন রাজনৈতিক। সে লম্বা গল্পে আপাতত না যাই। এও সত্যি আমাদের মতো অনেকেই যাদের সামনে সুভাষ ছিলেন গ্রীষ্মের খরতাপে বসন্তের নাম তাদেরও হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে হয়েছে তার সিদ্ধান্তে। মমতা ব্যানার্জীর মতো দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক কে দেয়া তার সান্নিধ্য বিতর্ককে করেছে ফেনায়িত। সমালোচনা যাই হোক শেষ পর্যন্ত জিতেছেন কিন্তু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর তার কবিতা। শুধু মৌলিক কবিতার কথাই বা কেন বলি। নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, বা হাফিজের মতো আরো অনেকের অনুবাদের জন্য সুভাষের কাছে আমাদের ঋণ কি শোধবার? সাহিত্যের কোথায় নেই সুভাষ সে প্রশ্নও করা যায়। তিনি ছিলেন তার মতো করেই ছিলেন।
সমসাময়িক অনেকের মতো বিষাদে সমর্পিত ছিলেন না কখনই। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন ‘হে বিষাদ, তুমি যাও/এখন আমার সময় নেই তুমি যাও।’ রাজনৈতিক ডামাডোলেও টান পড়েনি তার কবিতায় ।
যে বয়সে আর দশজন ইস্টনাম জপ করেন তিনি সে বয়েসে এসেও উচ্চারণ করেন
চোখের অত জল জমিয়ে রেখেছিলে কেন,
আমাকে ভাসাবে বলে।
তিনি পারেন, কারণ তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অনাগত আগামী যাকে মনে রাখবে চির বসন্তের স্বপ্ন দেখানো বিপ্লবের গায়েন বলে। মনে রাখতে বাধ্য।