শেষবার স্ত্রীর হাতে রান্না করা শুটকি মাছ খেয়ে বাসা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সুবীর নন্দী, বলেছিলেন ফিরে এসে আবার খাবেন। এরমধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে মৃত্যুসজ্জাসায় ছিলেন তিনি। এ সময় কারো সাথেই কথা বলতে পারেননি। মঙ্গলবার প্রয়াণ হলো তাঁর। আর স্বামীর সাথে শেষ সময়ের সেই সুখস্মৃতিটুকুন মনে করে রাজধানীর গ্রীন রোডের বাসায় গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছেন তাঁর স্ত্রী পূরবী নন্দী।
মৃত্যুর আগে প্রায় ২৩ দিন অসুস্থ হয়ে ঢাকা ও সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। অসুস্থতার আগে যখন তিনি বাসায় থাকতেন তার স্ত্রী পূরবী নন্দীকে প্রায় রাতে ডেকে বলতেন যে, এতো সাধের পৃথিবীটাও একদিন ছেড়ে হতে হবে!
স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে সুবীর নন্দী বলতেন, ‘ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়। আমি যখন থাকবো না, তখন জ্বেলে দিও সন্ধ্যা প্রদীপ। এই পৃথিবীটা কতোই সজীব!’
সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে মারা যান সুবীর নন্দী। তাঁর মৃত্যুর পর এদিন দুপুর বারোটার দিকে গ্রীনরোডের বাসায় গেলে দেখা যায় সুবীর নন্দীর পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে হাজির হয়েছেন খুরশিদ আলম, রফিকুল আলম, শুভ্র দেব, বাদশা বুলবুল, কবির বকুলসহ সংগীত জগতের আরো কিছু পরিচিত মুখ।
দুপুরে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপে শেষ কয়েকদিনের স্মৃতি জানান স্ত্রী পূরবী নন্দী। তিনি বলেন, ‘কার সুরে’ গানটা তার খুব প্রিয় ছিল। ওটাই আমাকে শুনাতো। উনি রাতে মাথা নিচু করে গাইতেন।
‘আমি পাশের রুম থেকে দরজার কোনে এসে উঁকি দিয়ে দেখতাম। শেষবার যখন বাসা থেকে বের হন সেদিন আমার রান্না শুটকি মাছ খেয়েছিলেন। বলেছিলেন, খুব স্বাদ হয়েছে। ফিরে এসে আবার খাবেন। কিন্তু উনি আর এলেন না। কখনও আসবেনও না।’
পূরবী নন্দী বলেন, আমেরিকায় তার চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কাগজপত্র সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উনি দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি। এটা শেষবার অসুস্থ হওয়ার আগের ঘটনা। উনি চেয়েছিলেন, সবসময় দেশেই থাকতে।
সুবীর নন্দীর চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি ছিল না উল্লেখ করে পূরবী নন্দী বলেন, সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসকরা সুবীর নন্দীকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েছেন যেটা বলে বোঝানো যাবেনা। তারা খুব আন্তরিক ছিলেন। এটা খুব বেশি দেখা যায় না।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে সুবীর নন্দীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। দেশনেত্রী হয়ে উনি মায়ের মতো পাশে থেকেছেন বলে মনে করেন সুবীর নন্দির স্ত্রী পূরবী নন্দী।
সুবীর নন্দীর মৃতদেহ এখন সিঙ্গাপুর। বুধবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছাবে এই কিংবদন্তি গায়কের নিথর দেহ। তার জামাতা রাজেশ শিকদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, সিঙ্গাপুরে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন। আগামীকাল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বাবাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দরে পৌঁছানোর কথা। এরপর আমরা সরাসরি গ্রীন রোডের বাসায় নিয়ে আসবো। এরপর নয়টার দিকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাবার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে।
রাজেশ জানান, সম্মলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সকাল ১১টায় সব শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সুবীর নন্দীর মরদেহ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরপর সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানে সৎকার পূর্ব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে।
এক নজরে সুবীর নন্দী:
সুবীর নন্দী, বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তি নাম। ১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নকালেই তিনি গান করতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানের ওস্তাদ ছিলেন বিদিত লাল দাস। সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে। দরদী কন্ঠের আধুনিক বাংলা গানের অবিস্মরণীয় এ কণ্ঠশিল্পী ৪৩ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গান গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য গান।
চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে। এরপর থেকে তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ ডিস্কো রেকর্ডিং এর ব্যানারে বাজারে আসে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে তিনি যুগোস্লাভিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেন, আমেরিকা, আরব আমিরাত, জাপান, নেপাল ও ভারতে সংগীত পরিবেশন করেছেন। চলচ্চিত্রের সংগীতে অবদানের জন্য তিনি চার বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন (মহানায়ক ১৯৮৪, শুভদা ১৯৮৬, শ্রাবণ মেঘের দিন হাজার ১৯৯৯, মেঘের পরে মেঘ ২০০৪)। এছাড়া চার বার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। শিল্পকলা- সংগীতে গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সুবীর নন্দীকে ২০১৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।