পানি পানি পানি বলে আর্তনাদ করেও মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা পানি পায়নি শিশু রাজন। এই রমজান মাসেই নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে ১৩ বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে। পানির পরিবর্তে তাকে শরীরের ঘাম খেতে বলেছিলো খুনি কামরুল।
এমন ঘটনা সিলেটের মাটিতে এবং তা পবিত্র রমজান মাসেই ঘটেছে। ঈদের আগে আগে এরকম নির্মমতা সিলেটের মানুষের কাছে রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো এক ঘটনা। কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে চান না যে কামরুলদের মতো পিশাচ হৃদয়ের এক মানুষের বসবাস তাদের শহরে।
সিলেটের অনেকেই একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেছেন। তাদের কথা: এমন দু-একটা নরপশুর জন্য নষ্ট হতে পারে না পূণ্যভূমির আজীবনের কোমলতা। পূণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত এই জনপদের মানুষ সবসময়ই খোদাভীরু। ধর্মপরায়ণ।
তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি খাওয়ানো ছোট একটা বিষয়। রমজান মাসে একে অপরের খোঁজখবর নেওয়া, বাড়িতে বাড়িতে দাওয়াত এবং ইফতার পাঠানো বরং নিয়মিত শিক্ষা। যে শিক্ষা রাজনের বয়সেই পেয়ে যায় সিলেটের অধিকাংশ শিশু। কামরুলই এর ব্যতিক্রম- বলেন সিলেটের মানুষজন।
সিলেটে রমজান মাসে খাবার দোকান বা হোটেল খোলা রাখা মোটামুটি অপরাধের পর্যায়ে। তবে লুকিয়ে চুপিসাড়ে খাবার বিক্রি যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। ইফতারে সিলেটে কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রচলিত। এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় হলো আখনি, যা সিলেটের বাইরে তেহারি নামে পরিচিত। অবশ্য রমজান ছাড়াও কুলখানি বা অন্য বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় সিলেটিদের প্রিয় এই খাবার।
ইফতার বিষয়ে আরেকটি অন্যরকম বিষয় শুধু সিলেটেই দেখা মেলে। সেটি হলো মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানো, যা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘ফুরির বাড়িত ইফতার পাঠানি’ বলা হয়। রমজানের ৩০ দিনের যেকোনো একদিন বেশ ঘটা করেই তা আয়োজন করা হয়। বিয়ের পর প্রথম রমজানতো অবশ্যই; এরপরও অনেক বছর ধরেই তা নিয়মিত করা হয়।
মেয়ের বাবা বেঁচে না থাকলে বেশিরভাগ সময় ভাইদেরই এই আয়োজন সম্পন্ন করতে হয়। এটা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের এক ধরণের হক বলেই বিশ্বাস সিলেটে। স্বামীসহ মেয়ে যদি প্রবাসেও থাকে তবে দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনকেই অনেক সময় এই আয়োজনের দায়িত্ব নিতে হয়। এক কথায় পবিত্র এই মাসের ত্রিশটি দিন এক ধরণের সম্প্রীতির বন্ধন গাঢ় করে দেয়।
ইফতার পাঠানো শেষ হলেই শুরু হয় ঈদের প্রস্তুতি। ঈদ উপলক্ষে অনেক প্রবাসী পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে দেশে আসেন। তারা যেমন ঈদকে টার্গেট করে দেশে আসেন; তাদেরও টার্গেট করে ব্যবসাও চাঙ্গা করেন ব্যবসায়ীরা। মার্কেটে মার্কেটে বাড়তি আয়োজন এবং সাজ-সজ্জাও হয় ঈদে।
ঈদের আগের রাতে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় মায়েদের ঈদের নাস্তা বানানোর উৎসব। এগুলো ছেলেবেলায় দেখা। সিলেটের ঈদে প্রায় সব বাড়িতেই হয় এমন দু’একটি কমন খাবারের আইটেম রয়েছে। ‘হলুদ পিঠা’ এর অন্যতম। এলাকাভেদে অবশ্য এই পিঠার ভিন্ন নাম রয়েছে। কোথাও বলা হয় গোল বড়া, কোথাও নুন বড়া বা কোথাও গল্লাস।
গ্লাস দিয়ে গোল করে কাটা হয় বলেই এমন অদ্ভুত নাম চালের গুড়ি আর লবণের মিশ্রণে তেলে ভাজা এই খাবার। সিলেটের ঈদের খাবারের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় হলো নারিকেল পাকোয়ান। নারিকেল দুধ আর ময়দার তৈরি এই খাবারে নকশাও দেওয়া হয়। এছাড়াও নারিকেল পুডিং, ডোবা সন্দেশ, পোস্তদানা, নারিকেল বরফি এবং পপ অন্যতম কমন ঈদ খাবার।
এসবতো শুধুই মধ্য আর উচ্চবিত্তের ঈদ। যেখানে ঈদ মানেই আনন্দ উদযাপন। কিন্তু এখনও সিলেটের বিভিন্ন গ্রামে একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ রয়েছে; যাদের সবার মতো ঈদ করার সৌভাগ্য হয় না। ওই প্রবাসীদের পাঠানো যাকাতের টাকার জন্য অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন তারা। তাদের কখনো ঈদের চাঁদ দেখা হয়; আবার কখনো হয় না।
তবুও ঈদ আসে, আসবে বারে বারে। হাসাবে আবার কাঁদাবেও। ঈদ মোবারক।