একটা পালকি এগোচ্ছে ঘাসের উচ্চতায় দুলে দুলে বেহারাদের কাঁধে। এর সমান্তরালে দৌড়োচ্ছে কিশোর ছেলে। পালকি ঘিরে রাখা কাপড় সরিয়ে তাকাচ্ছে নববধূ কিশোরী। হঠাৎ পালকি থেকে নেমে কিশোরীর দৌড় দৌড় দৌড়, কিশোরের সাথে। কিশোরীর এই দৌড় মনে করায় মা তাকে কিছুক্ষণ আগে মুখে ভাত তুলে দিয়ে সসঙ্কোচে বলেছেন স্বামী হাত ধরবে, গা ছুঁবে- সমস্ত যেন সে করতে দেয় তাকে। এই দৃশ্য চমৎকার, মায়েরা এভাবে বলে কয়ে দেওয়ার যে সহজ-স্বাভাবিকতা আমাদের সমাজে, এই বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষত, এই দৃশ্যে তা লক্ষ্যনীয়।
তখন মনে পড়ে, লক্ষ্মী নামের মেয়েটার হিন্দুয়ানী নাম মুছে শ্বশুরবাড়িতে তাকে আয়েশা ডাকা হবে, বৌ দেখতে এসেই এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বরপক্ষ! যদিও এই নামের রাজনীতি কিংবা বাল্যবিবাহ সিনেমার কাহিনি এ দু’টোর একটাও নয়।
নির্মাতা বিজন ইমতিয়াজ পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির প্রজার দেশে’ এগোয় মূল গল্পের দিকে, যে গল্প অস্তিত্ব, যাপন, বেঁচে থাকার মধ্যে স্থির হয়ে বসে আছে। নির্মাণের ভাষা দিয়ে কি সমাজের রাজনীতিকে টেক্কা দেওয়া যায়? হ্যাঁ যায়। এই চলচ্চিত্রকে ঘিরে সিনেমার রাজনীতি নিয়েও কথা বলা চলে বটে! যখন গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক বেশ্যা ফাতেমাকে চিনতে পেরে, অনেক বছর আগের সেই ‘কাস্টমার’ এর মতো আচরণ করে। যখন দর্শকের কাছে তার যৌনাকাঙ্খাই প্রধান হয়ে উঠছে এমনকি ফাতেমার কাছেও তাই। ঠিক তখন সে যৌনাকাঙ্খাকে পাশ কাটিয়ে ধর্মকে, সমাজের তথাকথিত নিয়ম-নীতিকে প্রাধাণ্য দিয়ে বসে। ফাতেমাকে ঘিরে সালিশ ডাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় রাতের আঁধারে। কাহিনির মোড় এখানে দারুণ চমকে দিয়ে ঘুরে গেলে মনে পড়ে এই সেই লোক যে তিনবার জামাল বা তার পিতার নামের আগে নিজ থেকেই ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি বসিয়েছে। আজকের সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই ‘মোহাম্মদ’ বসানোর পরিস্থিতিকে তাই অগ্রাহ্য করা যায় না কিছুতেই। তখন মনে হয় এই ব্যক্তি যৌনাকাঙ্খাকে বাদ দিয়ে সমাজে একই বেশ্যার সাথে পাশাপাশি আছে এ ঘটনাকে প্রাধাণ্য দিবে সেটাই স্বাভাবিক। কিংবা এই প্রশ্নও উঠে যে আজকে সমাজের চরিত্র কি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে? যেখানে সাধারণের মনে ব্যক্তির চেয়ে ধর্মের প্রকোপ অধিক।
এবং এই মুহূর্তে আরেকটা চরিত্রও লক্ষ্যনীয় যা বিপরীত। হুজুরের চরিত্র। এই হুজুর সমাজের মডারেটেড মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে গ্রামের একজন ‘হুজুর’ হয়েও এই প্রতিনিধিত্ব তাকে দিয়ে করাচ্ছেন নির্মাতা। এক্ষেত্রে সিনেমার রাজনীতি এখানে যে আমাদের সমাজে, যে সমাজে আমরা চলি-ফিরি-খাই-দাই, সেখানে অধিকাংশ হুজুর এমন নন- আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই সেটা বিচার করি নিশ্চয়। কিন্তু নির্মাতা এই চলচ্চিত্রে এমন বিপরীতধর্মী হুজুরের আবির্ভাব ঘটান, শক্তিশালী এক চরিত্রেই। যে চরিত্রকে আমরা চলচ্চিত্রের শেষে অগ্রণী ভূমিকায় দেখি।
তো এই হুজুর মানুষ রকেটে চড়ে চাঁদে গেছে তার খোঁজ রাখেন এবং সেটা বিশ্বাসও করেন। শুধু তাই নয়, জামালকে কিংবা শিশুদের জানাতেও কুন্ঠা বোধ করেন না। মানুষকে কোরানের আয়াত বুঝতে অন্য সব বই পড়তে হবে এরকম বিশ্বাসও তিনি মুসলমান গ্রামবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। কোরানের আয়াত ব্যাখ্যা করে জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশ ভ্রমণের কথাও বলেন তিনি। এমনকি যে রাতে ফাতেমাকে শাস্তি দিতে সবাই একমত সে রাতেও তিনি বলেন ফাতেমার যুক্তি শোনা প্রয়োজন কারণ ইসলামও এমনটা বলে, অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন পরিস্থিতিতে কোন অন্যায় করছেন তা বুঝতে হবে।
সমস্ত দিক বিবেচনায় এ চরিত্র মডারেটেড মুসলমানের আদর্শ রূপ, যে রূপ সমাজে উপস্থিত থাকলে তথাকথিত জঙ্গিবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে ইসলামের একটা সহজ-সুন্দর রূপ প্রতীয়মান। এখন আসা যাক কেন বলা হল এই চরিত্র শক্তিশালী এবং প্রভাববিস্তারকারীও। শেষ অবধি যখন এ চরিত্রের হাত ধরে জামাল স্কুলে প্রবেশ করে উজ্জ্বল সকালে, যে স্কুল জামালের কাছে আগ্রহের শিখরে ছিল। তখন মডারেটেড মুসলমানের হাত ধরে নতুন সকাল শুরুর একটা চিত্র আমাদের সামনে থাকে যেহেতু মায়ের উপস্থিতি সেই দৃশ্যে চোখে পড়ে না। সিনেমার রাজনীতির কথাতেই যেহেতু ছিলাম তাই এই সমাজে বসে সেই দৃশ্য কিংবা নির্মাতার ভাবনা কতটা অগ্রসরতার দিকে নিয়ে গেল বা আদৌ নিয়ে গেল কি না তা ভাবাই যায় বটে!
এ পর্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র জামালকে। জামাল স্বভাবে দুরন্ত ও কৌতূহলী। লক্ষ্মীর সাথে তার অন্তরঙ্গতা যে লক্ষ্মীর বিয়ের পরেও টিকে থাকে এ বন্ধুত্ব পরবর্তীতে প্রকাশিত হলে লক্ষ্মীর সাথে তার সম্পর্কের গল্প নির্মাতা কেন প্রথমে বলে গেলেন সে দিক খুঁজে পাওয়া যায়। জামালের সাথে নারীর সম্পর্ক ভরসার, উচ্ছ্বাসের, অভিমানের। কিশোর জামালের সাথে মা ফাতেমার সম্পর্ক প্রথম দর্শকের সামনে আসে আলো-ছায়াতে, গাছকে ঘিরে, শুকনো পাতা এবং কিশোরের দস্যিপনার মাঝে। ফাতেমার জগত-সংসারে একমাত্র পুরুষ তখন জামাল! জামালের সাথেই ফাতেমার যাবতীয় স্নেহ-ভালোবাসা-রাগ-অভিমান-দ্বন্দ্ব সমস্ত। এমনকি দেখা যায় জামালেরও তাই, অন্তত লক্ষ্মী চলে যাওয়ার পরে। এই সম্পর্ককে নির্মাতা দারুণভাবে তুলে ধরেছেন, মা আর ছেলের চেয়েও অধিক অসমবয়সী পরস্পরনির্ভর নারী আর পুরুষের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে!
গল্প বলে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু কিছু মুহূর্ত নির্মাণে সিনেমার গতি ঝুলে পড়ার আশঙ্কা ছিল। যেমন – জামালের প্রথম স্কুলে ভর্তি হতে যাওয়ার দৃশ্যটি। এছাড়া হুজুরের প্রথম উপস্থিতিতে মেকআপ করা হয়েছে বোঝা যাওয়াতে বিষয়টা চোখে লাগছিল। তবে গল্পের ভিতর গল্প থাকার ব্যাপারটা দারুণ, যা এই চলচ্চিত্রে ছিল! এখানে কেবল জামালের গল্প ছিল না, ছিল লক্ষ্মী, ফাতেমা, হুজুরের গল্প। এমনকি লক্ষ্মীর বড় বোনের যে গল্প আমাদের জানা হয় না সেই গল্পটাও কিন্তু বলে যাওয়া এক গল্পই। চলচ্চিত্রে এইভাবে গল্পদের জমাট বাঁধার বিষয়টা বেশ ভালো।
চলচ্চিত্রের কারিগরী দিক নিয়ে কথা বললে সিনেমাটোগ্রাফির কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। বিশেষত রাতের দৃশ্যগুলোতে যখন হুজুরের দাওয়ায় জামাল আর তার মা বসে কথা বলছেন, কিংবা জামালের সাথে স্কুলের বেঞ্চে কথা বলছেন হুজুর– এ দৃশ্যতে আলো-ছায়া দারুণ এক আবহ তৈরি করে। গাছের নিচে মাটিতে টুকরো টুকরো ছায়ার মাঝে মা-ছেলের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসের দৃশ্যও মূলত আলো-ছায়ার জন্যই টানে বেশি!
চলচ্চিত্র: মাটির প্রজার দেশে
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: বিজন ইমতিয়াজ
প্রযোজক: আরিফুর রহমান
প্রযোজনা: গুপি বাঘা প্রোডাকশন্স