বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ‘ময়ূরপঙ্খী’ ছিনতাই চেষ্টা মামলায় কমান্ডো অপারেশনে নিহত পলাশ আহমেদের সাবেক স্ত্রী চিত্রনায়িকা শামসুন নাহার সিমলাকে চট্টগ্রামের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে সিমলার কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও তদন্তাধীন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। যা তারা যাচাই বাছাই করবেন।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়ায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়ার কর্মস্থলে উপস্থিত হন তিনি। রাজেশ বড়ুয়া সকাল দশটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে চ্যানেল আই অনলাইনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সিএমপির পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়ার কথা হয়।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিহত পলাশের সাবেক স্ত্রী সিমলার নাম আলোচনায় ছিল। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। ঘটনার সময় সিমলা মুম্বাই থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। বৃহস্পতিবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। সিমলার সঙ্গে পলাশের সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই আমাদের জানিয়েছেন।
সিমলার কাছ থেকে কী কী তথ্য পেলেন, নতুন তথ্য তদন্তকে গতিশীল করবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বলেন, তদন্তের সূত্র ধরেই সিমলাকে ডাকা হয়েছিল, তদন্ত সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু তথ্য আমাদের জানা দরকার ছিল। তার মধ্যে পলাশের সঙ্গে কীভাবে তার পরিচয় হলো, বিয়ের বিষয়, ডিভোর্সের বিষয় ও ডিভোর্সের পরে এবং ঘটনার সময়গুলোতে তাদের মধ্যে কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিল কিনা এসব বিষয় সিমলার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে।
‘তদন্তাধীন বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য আমরা অন্যান্য স্বাক্ষীদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম সে ব্যাপারেও বেশ কিছু বিষয়ে সিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’-যোগ করেন রাজেশ বড়ুয়া।
তবে তদন্তের স্বার্থে সিমলার সঙ্গে সব কথোপকথন গণমাধ্যমে বলা যাবে না বলেও জানান তিনি।
রাজেশ বড়ুয়া বলেন, সিমলার কাছ থেকে আজকের তথ্যগুলো সঠিক কিনা এসব বিষয়গুলোও আমরা যাচাই বাছাই করবো। প্রয়োজন হলে আবার তাকে ডাকব।
জিজ্ঞাসাবাদে সিমলার ভাষ্য অনুযায়ী রাজেশ বড়ুয়া বলেন: সিমলা ২০১৮ সালে ৫ নভেম্বর পলাশকে ডির্ভোস দেয় আর তিনি মুম্বাই চলে যান ১৫ নভেম্বর। সুতরাং পরের সময়গুলো এবং বিমান ছিনতাইয়ের বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না সিমলা।
তবে সিমলা পুলিশকে জানিয়েছেন, পলাশ নামের ছেলেটি তার সঙ্গে মিথ্যা তথ্য আদান প্রদান করে তার সাথে প্রতারণা করেছেন। এরপর থেকে সিমলা ভেঙ্গে পড়েন।
সিমলার ভাষ্য মতে পলাশ মানসিক রোগী ছিল, আপনাদের তদন্ত কী বলছে? এ প্রশ্নের জবাবে রাজেশ বড়ুয়া বলেন, আমরা ময়না তদন্তের সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছি, মেডিকেল বোর্ডকেও বিষয়টি জানানো আছে। মেডিকেল রিপোর্টটি কিছু দিনের মধ্যে হাতে পাব। তখন আসলে বলা যাবে পলাশ মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন কিনা! সিমলার ভাষ্যই সবশেষ নয়।
বিমান ছিনতাই মামলায় এ পর্যন্ত মোট ৪২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিমানের ৭ জন ক্রু, এছাড়া ওই বিমানের ইঞ্জিনিয়ার, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের ম্যানেজার, স্টেশন কর্মকর্তা, বিমান বন্দরের কন্ট্রোল রুমের চার কর্মকর্তা ছাড়াও আছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।
জিজ্ঞাসাবাদে বিমানের পাইলট-ক্রু’রা জানিয়েছিলেন, উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খীর যাত্রী পলাশ আহমেদ আসন পরিবর্তন করলে তাকে নিষেধ করেছিলেন একজন কেবিন ক্রু। আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে সঙ্গে থাকা পিস্তল বের করেন পলাশ। এ সময় পলাশ কয়েক দফা বিমানে অস্থিরভাবে পায়চারি করেন। তখন ককপিটের সামনে বসা ছিলেন পাইলট ও ফার্স্ট অফিসার। পলাশ পাইলটের সঙ্গে বারবার কথা বলতে চেয়েছিলেন। তবে কেবিন ক্রু’রা তার মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। কেবিন ক্রু শফিকা নাসিম একটি গোপন কোড ব্যবহার করে বিষয়টি পাইলটকে জানিয়ে দেন। পাইলট ও ফার্স্ট অফিসার লাইভ স্ক্রিন অন করে সেখানে পলাশের গতিবিধি দেখতে পান।
পরে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন পলাশ। ওই দাবি নিয়েই এক হাতে পিস্তল এবং আরেক হাতে বিস্ফোরক সদৃশ বস্তু নিয়ে অসংলগ্ন আচরণ শুরু করেন পলাশ। যাত্রীদের রক্ষায় পাইলট এবং ক্রু’রা নানাভাবে কালক্ষেপণের কৌশল নেন।
এ ঘটনায় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের প্রযুক্তি সহকারি দেবব্রত সরকার বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। যাতে পলাশ আহমেদসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়াকে। তবে কেন এই ছিনতাই চেষ্টা করা হয়েছে সেটা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বের হয়ে এসে সিমলা সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি গত ২৫ আগস্ট ভারতের মুম্বাই থেকে ঢাকায় আসেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাকে চট্টগ্রামে এসে বক্তব্য দেওয়ার কথা জানান।
কী কী বিষয় নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে?- এমন প্রশ্নের জবাবে সিমলা বলেন, পুলিশ মূলত পলাশের সঙ্গে তার পরিচয় ও বিয়ে সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তিনি আরো জানান, বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনার আগে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাই তিনি সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানেন না। কেননা, বিচ্ছেদের পর থেকে পলাশের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিলো না বলেও জানান তিনি।
পলাশ মানসিকভাবে ‘ডিসটার্বড’ ছিলেন বলেও মন্তব্য করেন সিমলা। বলেন, তার কিছু কিছু আচরণের কারণে তিনি বিরক্ত ছিলেন বলেই তাকে আর ভালো লাগেনি। সে কারণেই তিনি পলাশকে তালাক দিয়ে দেন।
ঘটনার পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি মুম্বাই থেকে ভিডিও বার্তায় সিমলা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পলাশের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি পরিচালক রশিদ পলাশের ‘নাইওর’ ছবি করেছিলাম। সেদিন পরিচালক রশিদ পলাশের জন্মদিন ছিল। আমাকে সেখানে ইনভাইট করেছিলেন তিনি। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই পলাশের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
সিমলা বলেন, এরপর ২০১৮ সালের ৩ মার্চ আমরা বিয়ে করি। ওই বছরেরই নভেম্বরে আমাদের ডিভোর্স হয়েছে। পলাশকে ডিভোর্স দেয়ার তথ্য জানিয়ে নায়িকা সিমলা আরও বলেন, ডিভোর্স দেয়ার কারণ ছিল। মূল কারণ হচ্ছে- মানসিক সমস্যা।
তিনি বলেন, পেশা হিসেবে আমি যেটা জানতাম-জানি সেটা হলো পরিচালক রশিদের ‘কবর’ ছবিতে প্রযোজক হিসেবে ছিলেন পলাশ। আমি তাকে একজন প্রযোজক হিসেবেই চিনি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শাহজালাল আর্ন্তাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫টা ১৩ মিনিটে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের বিমান বিজি-১৪৭ উড্ডয়নের ১৫ মিনিট পর পলাশ আহমেদ বোমাসদৃশ বস্তু ও অস্ত্র দেখিয়ে বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। ৫টা ৪১ মিনিটে বিমানটি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। প্লেনের ‘ইমারজেন্সি ডোর’ দিয়ে যাত্রী ও কেবিন ক্রুদের দ্রুত বের করে আনা হয়। পরে যৌথবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিমের অভিযানে মারা যান পলাশ আহমেদ।