কিশোর দাকে নিয়ে বলার মত দুঃসাহস আমার নেই। তবে তাঁর সাথে দীর্ঘ দিনের পরিচয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছি ব্যক্তি এন্ড্রু কিশোর ও শিল্পী এন্ডু কিশোরকে। দেখেছি, তিনি মানুষ হিসেবে কতো অমায়িক ছিলেন। উনি এত বড় মাপের একজন শিল্পী ছিলেন অথচ তাঁর পুরো ক্যারিয়ারে তাঁকে নিয়ে কোন কথা উঠেনি, কোনো প্রশ্ন উঠেনি। মানুষের এত হৃদয়ের কাছাকাছি তিনি ছিলেন, স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক ছিল সবার সাথে। তাঁর পরিচিত গণ্ডির মধ্যে কারো কোন সমস্যায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন নিজে থেকেই। কোন ধরনের সমস্যায় পড়লে তার কাছে সুপরামর্শ পাওয়া যেত। তাঁর মত এত অনবদ্য মানুষ সত্যিই কম দেখেছি। তাঁর শিল্পীজীবন নিয়ে যদি বলি, তাহলে বলা যায় তিনি সব দিক দিয়েই ছিলেন একজন সফল শিল্পী। সফল এই কারণে বলছি যে তিনি শুধু জনপ্রিয়তা কিংবা অর্থবিত্ত করেছেন এজন্য না, সংগীত নিয়ে তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টি ছিল, সংগীতের প্রতি এতো অনুগত ছিলেন তিনি তা বলে বোঝানো যাবে না।
শিল্পী জীবনে তিনি গান নিয়ে কতোটা অনুগত ছিলেন তার একটা প্রমাণ দেই। নব্বইয়ের শুরুর দিকের কথা। তিনি তখন পুরোপুরি চলচ্চিত্রের গানে সুপারহিট। তার গান মানে চারদিকে হইচই পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। সেসময় আমরা কয়েকজন ধরলাম যে, কিশোরদা চলো আমরা তোমার অডিও অ্যালবাম করব। ক্যাসেটে। রাজী হলেন আমাদের কথায়।তখন আমাদের দেশের বিখ্যাত সুরকার প্রণব ঘোষ, ওনার সুরে আমরা গান করার পরিকল্পনা করলাম। আমরা মিউজিক তৈরি করে ফেলেছি সবকিছু প্রস্তুত, তেমনি ভয়েস রেকর্ড করার এক সন্ধ্যায় তিনি স্টুডিওতে এলেন। ভয়েস রুমে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘বাবু একটু গভীরভাবে চিন্তা করত, আমি এন্ড্রু কিশোর। চলচ্চিত্রের জন্য গান করি। সেখানে মানুষ আমার গান পছন্দ করে, তারা আমাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। কিন্তু এই অডিও বাজারে আমার গানগুলো কি মানুষ শুনবে?’ আমি বললাম দাদা এটা তুমি কী বলো, তোমার গান লোকে শুনবে না? বললেন না না বাবু এটা আলাদা একটা মার্কেট, বুঝে শুনে কাজ করার ব্যাপার আছে। ক্যাসেট মার্কেটটা অন্য ব্যাপার, এখানের শ্রোতা অন্য, আমি কি ক্যাসেট মার্কেটের জন্য গাইতে পারব? আমি গানগুলোই বা কীভাবে গাইবো, বাবু?’ আমিও একটু মজা করে বললাম এসব কী বলছো দাদা, কীভাবে গান গাইবো মানে? ফিল্মে যেভাবে মাইক্রোফোন নিয়ে গাও সেভাবে গাইবা। আমার কথা শুনে দাদা আবার বললেন, ‘সেটা ঠিক বলেছিস। কিছু না ভেবে গেয়ে দেই। সেটাই বরং ভালো।’ গান নিয়ে তাঁর চিন্তা ভাবনার জায়গাটা বুঝানোর জন্য ঘটনাটা বললাম। আসলে শ্রোতাদের তিনি সবচেয়ে প্রায়োরিটিতে রাখতেন, শ্রোতার সাথে কখনো কম্প্রোমাইজে যেতেন না। একটা গানের জন্য হয়তো সুরকার গীতিকার কিংবা মিউজিশিয়ানদের সাথে কম্প্রোমাইজ করছেন, কিন্তু শ্রোতার সাথে না। তারপর সত্যি সত্যি এন্ড্রু দার ওই অ্যালবামটাও সারাদেশে সাড়া ফেলেছিল।
রেকর্ডিং এর ব্যাপার নিয়ে যদি বলি, এন্ড্রু দা আগাগোড়াই একজন খুঁতখুঁতে মানুষ ছিলেন। আমার খুব ভালো লাগতো যে তিনি আমার মিক্সমাস্টারিং এ স্বাধীনতা দিতেন। বলতেন ‘না বাবু, এখানে আমার কিছু বলার নেই। এই ওস্তাদি তোর।’ কিন্তু কোনো গানে দাদা ভয়েস দেয়ার পর উনার মন মতন না হলে বিপদ হতো। সবাই যখন বলতো যে অমুক লাইনটা ঠিক আছে, মিউজিক ডিরেক্টরও বলতেন কিংবা আমিও বলতাম যে দাদা বাদ দাও, এই লাইনটা খুবই ভাল হয়েছে। কিন্তু তিনি বলতেন ‘বাবু, এই লাইনটা আবার গাই চল। এই বলে তিনি যখন আবার ওই লাইনটা গাইতেন, পরে দেখতাম আরে সত্যিই তো, বিউটিফুল একটা নোটে দারুণ ছোঁয়া দিয়ে চলে আসছেন। এই যে নিজের পরিশীলতার জায়গাটা অসাধারণ ছিলো তাঁর।নিজের চর্চা করে করে এমন একটা জায়গায় তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, সে নিজের গানের ব্যাপারে বুঝতেন কোথায় একটু কম দিলেন, বা বেশি। তাঁর এই পরিমিতিবোধ বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করেছে।
কমিটমেন্টের জায়গাতেও কিশোরদা ছিলেন পারফেক্ট একজন মানুষ। যদি কথা দিতেন স্টুডিওতে দশটায় আসবেন, তাহলে আমরা দেখেছি পৌনে দশটায় এসে তিনি হাজির। আমার সবচেয়ে যে বিষয়টি ভালো লাগতো দাদার, তিনি স্টুডিও টাকে কর্মস্থলই মনে করতেন। সারা জীবন তাঁর প্রার্থনালয় ছিল স্টুডিও। ‘কাজ না থাকলেও একবার ঘুরে যাব স্টুডিও’- এটা ছিল তাঁর মজ্জায়।
আমরা যখন চ্যানেল আইতে স্টুডিও নির্মাণ করলাম, বিগত ৫ বছর কিশোর দা আমাদের এখানে সমস্ত কাজ করেছেন। চ্যানেল আইয়ের এই স্টুডিওকে আমরা বলি, আই স্টুডিও। মাঝখানে কিশোর দার মাথায় আসলো, আমার পরীক্ষা নিবেন। একদিন এসে বললেন ‘বাবু, তোকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে।’ বললাম এই বয়সে আবার কিসের পরীক্ষা দিব দাদা? বললেন সিরিয়াসলি পরীক্ষা দিতে হবে কিন্তু। তারপর তাঁর গাওয়া কালজয়ী দশটা গান বেছে আনলেন। বললেন, দেখ বাবু এই গানগুলোর সাউন্ড সেই আশির দশকের। এ শব্দগুলো এখন আর আমার ভালো লাগছে না, আমার মনে হচ্ছে এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা হয়তো আমার গান শুনবে না! বললাম দাদা এগুলিতো ইতোমধ্যে ছেলেপেলেরা শুনে ফেলেছে! বললেন, ‘না না বাবু। এগুলো শুনবে না, এখন কত আধুনিক শব্দ এগুলো রেখে কেন নয়েজ আছে এমন গান শুনবে! আর আমি তো এত মেধাবী শিল্পীও না যে আশির দশকে যে ভোকাল দিয়েছি এই সময়ে তা দিয়ে আবার নতুন করে গান রেকর্ড করবো!’ আমি বললাম তাহলে কী করতে চাইছো? বললেন ‘আমার কণ্ঠ ঠিক রেখে শুধু শব্দে পরিবর্তন করতে হবে।’ এরপর আমরা দুজন লাগলাম বাছাই করা কালজয়ী দশটা গানের পেছনে ! গানগুলোর নতুন করে শব্দ তৈরি করে শেষ করতে প্রায় দুই বছর লেগে যায়। আশির দশকে গাওয়া ওনার কণ্ঠে কোন ধরনের হাত না দিয়ে শুধু নতুন করে শব্দ যোগ করেছি। এটাকে টেকনিক্যালি বলে-ফ্রিকোয়েন্সি এডেড ল্যাঙ্গুয়েজ। মৌলিকতা সম্পূর্ণ রেখে শুধু শব্দ (মিউজিক) নতুন করে যোগ করা। মানে গানটা প্লে দিলে শ্রোতার কানে যেন কোনো নয়েজ না যায়। ওই দশটা গান এর কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। কথার কথা বলি, উনার ওই দশটা গানের জন্য হয়তো আমাকে ১০ টাকা দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু গানগুলো শোনার পর তিনি আমাকে ২০ টাকা দিয়ে দিলেন! এতো উদার মানুষ ছিলেন তিনি। সবকিছু নিয়ে স্বচ্ছ থাকতে পছন্দ করতেন।
তাঁর কিছুদিন পরে দাদাকে আবার ধরলাম, যে দাদা তোমাকে গাইতে হবে আবার। বললেন কী বলিস, ‘আমি আবার গাইব?’ আমি বললাম হ্যাঁ অবশ্যই গা্ন গাইতে হবে তোমাকে। তুমি ফিল্মের গান গাইবে এবং আরো কিছু গান করতে হবে। তখন আমরা নতুন করে আই স্টুডিওতে রেকর্ডিং করলাম। এরমধ্যে একটি গান ছিল হুমায়ুন ফরিদী যখন মারা যান, তার স্মৃতি নিয়ে লেখা প্রাক্তন জেনারেল জিয়া সাহেবের লেখা। যিনি তৎকালীন বিআরটিসির চেয়ারম্যান ছিলেন। গানটির শিরোনাম ছিলো ‘একটি গোলাপ হাতে নিয়ে’। খুব দারুণ ছিল গানটা। চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানেও গেছে গানটি। তারপর আমরা একসাথে কাজ করি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা অপ্রকাশিত ‘রুমাল’ নামের গানটি নিয়ে। এটা নিয়ে স্টোরিটাও কিশোর দা চ্যানেল আইয়ের একটি প্রোগ্রামে সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছেন।
আমরা যেমন সংগীত এর পেছনের মানুষ, কিন্তু শিল্পীর তো সে সুযোগ নেই। তাকে সামনের সারিতে থাকতে হয়। কিন্তু কিশোর দা নিজেকে পেছনের সারিতে রাখতে স্বস্তি বোধ করতেন। সাংঘাতিক রকমের পেছনে থাকতে ভালোবাসতেন তিনি। টেলিভিশনে তাঁকে প্রায় দেখাই যেত না বলা যায়। আমরা ‘ইত্যাদি’ এবং কিছু মেজর প্রোগ্রামে ওনাকে প্রায় জোর করে নিয়ে আনতাম। সেসব প্রোগ্রামে তিনি বাধ্য হয়ে আসলেও কিন্তু কখনো কথা বলতেন না। শুধু গানটাই গাইতেন। কথা বলেছেন খুব অল্প অনুষ্ঠানে, বিরল সেটা। কিন্তু কিশোরদাকে নিয়ে আমরা গত বছর রোজার ঈদে চ্যানেল আইতে একটি প্রোগ্রাম করেছি। যে অনুষ্ঠানে দাদাকে দিয়ে কথা বলতে পেরিয়েছিলাম! অনুষ্ঠানে তাঁকে কথা বলানোটা সহজ কাজ ছিলো না। এটার পেছনেও দারুণ কিছু গল্প আছে।
গত বছর রোজার ঈদ টার্গেট করে সাগর ভাই (ফরিদুর রেজা সাগর) বললেন, যে করেই হোক এন্ড্রু কিশোরকে দিয়ে যেনো একটা প্রোগ্রাম এবার ঈদে যায়। আমিতো জানি টেলিভিশনে কিশোরদার অনিহার কথা, তবুও বারবার দাদাকে বলি অনুষ্ঠান করতে। কয়েকবার বলেছি, কিন্তু স্বভাবতই তিনি রাজি হচ্ছেন না। তখন আমি বৌদির শরণাপন্ন হলাম। ফোন করে বৌদিকে বললাম যে দাদা তো মানছে না, কিন্তু এই অনুষ্ঠানে তাঁকে আমার লাগবেই, আমার দিকটা চিন্তা করো। পরেরদিন দাদা এসে আমাকে বললেন ‘তুই তোর বৌদিকে ফোন করেছিলি, না?’ বললাম, ‘কোন প্রবলেম?’ হেসে দিয়ে বললেন, ‘প্রবলেম কি আর! বল, তুই কী করতে চাচ্ছিস?’ আমি বললাম দাদা তোমার পাঁচটি গান নিয়ে আমরা একটি প্রোগ্রাম করতে চাই। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রোগ্রামটি করতে রাজি হলেন! সেই প্রোগ্রাম রেকর্ড করার দিনেও আরেক গল্প!
ওই অনুষ্ঠানটি যখন চ্যানেল আইয়ের চার নম্বর স্টুডিওতে রেকর্ড হচ্ছিল, উনি তখন কাজ বন্ধ করে দিয়ে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কফি খাওয়ার কথা বলে আমার রুমে চলে আসেন। এসে আমাকে বললেন, ‘বাবু আমি তো এরকম প্রোগ্রামে কথা বলতে ইউজডটু না, তুই তো জানিস। জাস্ট আফসানা মিমিকে (অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক) বল গানগুলোই যেন রাখা হয়, আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।’ আমি বললাম ঠিক আছে দাদা। এটা হবে, কিন্তু তুমি আগে কফি খাও। তো আই স্টুডিওর রুমে বসে কফি খেতে খেতে তিনি টেলিভিশন দেখছিলেন। তখন চ্যানেল আইয়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘খাঁচা’ ছবিটি চলছিলো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কাহিনী নিয়ে নির্মিত ওই ছবিটা দেখে তিনি মুহূর্তে খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমাকে বললেন- ‘দেশভাগের যে ক্রাইসিস ‘খাঁচা’ সিনেমায় আসছে, এটা আমি আমার বাবার মুখে শুনেছি। সেই দৃশ্য যেন আমি প্রায়ই দেখতে পাই।’ দেখি সত্যি সত্যি কিশোরদা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছেন। কাঁদো কাঁদো চোখে আমাকে বললেন, ‘বাবু আমাকে আরেকটা কফি খাওয়া।’ তো এই পরিস্থিতির মধ্যেই আমি কিশোরদাকে না জানিয়ে সৈয়দ আব্দুল হাদী ভাইকে ফোন দিলাম, কিশোরদাকে নিয়ে ওই মুহূর্তে ঝামেলাকর পরিস্থিতির কথা বললাম। সব শুনে কিছুক্ষণ পর হাদী ভাই কিশোর দাকে ফোন দিলেন, বললেন-‘সিনেমা দেখে চোখে জল আনার দরকার কি! এরকম ছবি আমাদের আরো হবে। বেঁচে থাকতে হবে, আমাদের গান গাইতে হবে, আমাদের দর্শন, পর্যবেক্ষণ সব নিয়ে কথা বলে যেতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যাও, এখন বাবুর কাজটা শেষ করো। সে আবার আমার এখানে আসার কথা।’ ফোন রেখে কিশোরদা আমাকে বললেন, ‘কিরে তুই কি গুরুকে ফোনে এসব বলেছিস?’ হ্যাঁ, সেদিন সত্যি সত্যি ওই অনুষ্ঠানে কিশোর দা অনেক কথা বলেছিলেন। এবং এই কথাগুলো যে শেষবারের মতো হবে, তা কে জানতো!
কিশোরদার মত মানুষ পৃথিবীতে একবারই জন্ম নেন। আমার সৌভাগ্য এমন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি, জানার সুযোগ পেয়েছি। এত বড় শিল্পী হয়েও এত বিনয়ী মানুষ সত্যিই আর দেখিনি। সাংঘাতিক বন্ধুসুলভ একজন মানুষ ছিলেন কিশোর দা। ভাই ও বন্ধুর মতো তিনি যেভাবে আগলে রেখেছেন; তাঁর মৃত্যুতে কিছুটা হলেও আমি অভিভাবক হারা হয়েছি। হয়তো আমিও খুব তাড়াতাড়ি চলে যাব, কিন্তু যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিশোরদার সঙ্গে স্মৃতিগুলো মনে থাকবে।
লেখক: চিফ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, চ্যানেল আই