১৯৭১ সালের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রটি বিশ্বের দরবারে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাঙালীরা কেউ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেউ পালিয়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছিল। কেউ দেশের মাটিতে জীবন মৃত্যুর চরম হুমকিতে বসবাস করে যাচ্ছিল। কেউ আবার পাক বাহিনীর সহায়ক হয়ে শান্তি কমিটি, আলবদর বাহিনী, মুজাহিদ বাহিনী প্রভৃতির সদস্য হয়েছিল সাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। পাক হানাদাররা মুসলিম ধর্মাবলম্বী তাই তাদের এ পক্ষাবলম্বন। যুদ্ধে দেশ স্বাধীন না হলে মুক্তিযোদ্ধারা ‘বীর’ বিশেষণ না পেয়ে পেত বিচ্ছিন্নতাবাদী ও দেশদ্রোহী বিশেষণ। স্বাধীনতার পরে যেভাবে বিচার হলো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পাকিস্তান পন্থীদের, আগে বিচার হতো বিচ্ছিন্নতাবাদ ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের। পৃথিবীর সকল দেশেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তরা নিন্দিত, পরিত্যাজ্য ও বিচারের মুখোমুখি হয়। যে পাকিস্তানীরা দু’লাখ বাঙালী নারীর ইজ্জত লুন্ঠন করেছে। তাদেরকে ‘গণীমত’ এর মাল বিশেষণ দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে ধর্ষণ করেছে। সবশেষে তাদের হত্যা করে বেআব্রু অবস্থায় রাস্তায় ফেলে তাদের মৃত শরীরটাকে পরিণত করেছে শেয়াল কুকুরের খাবারে। ত্রিশ লাখ বাঙালীর তরতাজা জীবনও কেড়ে নিয়েছে তারা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছে কত বাঙালীর বসতভিটা।
সেই পাকিস্তানের পক্ষ যারা নিয়েছিল, তারাও তা করেছিল সাম্প্রদায়িক কারণে। রাজাকার, আল বদর, আল শামস নামধারী ওই সাম্প্রদায়িকরা আবার নিজ ধর্মের নারীদের বেছে বেছে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে পাঠিয়েছে পাক সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য। কারণ এসব নারী ও তার স্বজনরা সাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কারণ তারা চেয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্বের অখণ্ড পাকিস্তান আর তারা চেয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ নামীয় পৃথক রাষ্ট্র। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল এসব পাকপন্থীরা বাংলাদেশেই থেকে গেল। কিন্তু তাদের বিশ্বস্ততা ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের দিকেই। এসব মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বাদীরা মনে করতো তারা মুসলমান পাকিস্তানীরাও মুসলমান, তাই তারা মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। কিন্তু নিজদেশের স্বাধীনতা কামী মুসলমানদের তারা ভাই ভাবতে পারল না। মেয়েদেরকে ভাবতে পারলনা বোন। ভাবতে পারলে কোন মুসলমানের মেয়েকে তারা ধর্ষণের শিকার হতে ক্যাম্পে পাঠাতে পারতো না। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সময় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে রেখে গেল একটি সাম্প্রদায়িক ইস্যু। ভারত আখ্যায়িত হলো চরম সাম্প্রদায়িক উচ্চারণ ‘হিন্দুস্থান’ হিসেবে।
এই সাম্প্রদায়িক আবহে গড়ে ওঠা পরিস্থিতির নানা ধারাবাহিকতায় অসাম্প্রদায়িক দাবিদার রাজনীতিকেও বারবার সাম্প্রদায়িকতার কাছে নতি স্বীকার যেন নিয়তি হয়ে উঠেছে। এবিষয়ে শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কংগ্রেসী বন্ধুরা যত হিন্দু হলেন, আমি ততই মুসলমান হলাম।’ তেমনই পরবর্তীতে দেখা গেছে মুসলমানরাও যতবেশী মুসলমান হয়েছে হিন্দুরাও ততবেশি হিন্দু হয়েছে। এমনই এক সাম্প্রদায়িক বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ভারত বর্ষের রাজনীতি। ভারতের বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি গুজরাটে মুসলিম নিধন করে হয়ে গেলেন হিন্দু ভারতের প্রধান মন্ত্রী। হিন্দুত্ববাদই তার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের প্রধানতম অস্ত্র।
অসাম্প্রদায়িক নৈতিকতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগ পর্যন্ত আসতেও অনেকবার সাম্প্রদায়িক বাঁক বদল হয়েছে। শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। পরবর্তীতে দলটি সাম্প্রদায়িকতার কাছে নতি স্বীকার করে মুসলিম লীগে রূপান্তরিত হয়। এরপর মুসলিম লীগ হতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে আবার আওয়ামী মুসলিম লীগ হতে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। তাহলে দেখা গেল প্রথমে অসাম্প্রদায়িক পরে সাম্প্রদায়িক, পরে আধা সাম্প্রদায়িক ও পরে আবার অসাম্প্রদায়িকে ফিরে আসে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে এদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবেই গণ্য করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চরম অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ল দলটি। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও তার বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে গেলেন। ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরলেন। রাজনীতির নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে, ২০০৯ সালে ও ২০১৪ সালে তিনি সংসদ নেতা ও দেশের প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধারে দুইবারসহ তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটলো আবারও সাম্প্রদায়িকতার কাছে নতি স্বীকার। অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে তিনি সংবিধানে সংযোজন করলেন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। যেখানে ক্ষমতা সেখানেই সাম্প্রদায়িকতা। এর রহস্য কী? বিরোধী দলে থাকাকালে যতটা অসাম্প্রদায়িক হিসাবে থাকতে পারে সরকার দলে গেলে ততটা পারেনা। এই বাস্তবতা কেন হলো?
সাম্প্রদায়িক হুজুগ তুলে কি সত্যিই ভোটের পাল্লা ভারী করা যায়? যেমন নির্বাচন এলে কেউ বলে, ধানের শীষে ভোট না দিলে বিসমিল্লাহ উঠে যাবে। আবার কেউ বলে, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ নৌকার মালিক তুই আল্লাহ। হেফাজতে ইসলামের যে তের দফা দাবীনামা এটা কোন সাম্প্রদায়িক দলীয় সরকারের পক্ষেও মেনে চলা সম্ভব নয়। তবু বুঝি ভোটের পাল্লাকে ভারী করতেই হেফাজতের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা দৃশ্যমান হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে। কারণ এই তিনটি দলেরই ক্ষমতায় যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে ও আবারও যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা। বামপন্থী দলগুলো বামগত ভাবে ক্ষমতায় যেতে পারে এরকম পরিস্থিতি আজও গড়ে ওঠেনি। হয়তো এজন্যই তারা অসাম্প্রদায়িক থাকতে পারছে। তবে কি বামরাও ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ করবে? আসলে কী রয়েছে ক্ষমতায়?
কাদের মোল্লা, সালাহ উদ্দীন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মুজাহিদ গং যদি অন্য ধর্মাবলম্বী হতো তাহলে তাহলে নিশ্চয় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলে তুমুল বক্তৃতা ঝাড়ত অন্য ধর্মের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। পাকিস্তানও তখন আর তাদের জন্য মাতম করতো না। বিভিন্ন সরকারের আমলে স্ব স্ব পক্ষে বিপক্ষের শক্তিকে ঘায়েল করতে সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার হয়েছে প্রবলভাবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের পাগলা পীর এলাকা ও কক্সবাজারের রামুতে সাম্প্রদায়িক হামলায় আক্রান্ত হলো কতশত মানুষ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যাদের মধ্যে আজ মানবতা কাজ করছে তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু তখন এসব আক্রান্তদের প্রতি কোন মানবতা জাগেনি। কারণ তারা হিন্দু ও বৌদ্ধ বলে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনেকের মধ্যে বৌদ্ধবিরোধী সেন্টিমেন্টও গড়ে উঠেছে। তারা আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতিও গড়ে উঠেছিল। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা প্রদর্শনে তাদের সাহায্যার্তে দেশব্যাপী চাঁদাও তুলেছে কতশত মানুষ। কিন্তু এই রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হয়ে হিন্দু অথবা বৌদ্ধ হতো তখন কি জাগতো তাদের মানবতা? তবে কি আমাদের মানবতাও আজ সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়নি? এই সাম্প্রদায়িক মানবতার হট্টগোলে আসল মানবতার ভবিষ্যত কী? সেটাই আজ গভীরভাবে ভাববার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)