বেশ কদিন ধরে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এক মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে দেশে। পুলিশের অনুসন্ধান ও আইনের বিচারে সত্য প্রকাশিত হোক একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে। এটাই কাম্য। এ ঘটনার রেশ ধরে পারিবারিকভাবে সন্তানের দায়িত্ব পালন নিয়ে পিতামাতা ও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আসলে সময়ের সাথে সাথে পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ম কানুন, রীতিনীতি অনুযায়ী সন্তান লালন-পালনের চিন্তাভাবনা ও পাল্টে যাচ্ছে ক্রমশ।
আজকাল আধুনিকতা ও স্বাধীনতার নামে স্কুল কলেজগামী ছেলেমেয়েরা যে ধরনের চলাফেরা করে তা সমাজের জন্য যে কল্যাণকর নয় তার প্রমাণ কিশোর গ্যাং, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার কিংবা জনপ্রিয়তার লোভের টিকটক কর্মকাণ্ড। প্রযুক্তির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে এটা যেমন সত্যি, তেমনিভাবে নিয়মনীতি মেনে পরিশীলিতভাবে জীবন পরিচালনা করাটাই হলো আধুনিকতা। এ বোধটা সন্তানকে দিতে হবে পরিবার থেকে।
বর্তমান সময়ে দেখা যায় ব্যস্ত জীবনের দোহাই দিয়ে বাবা মা সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারে না। সন্তানরা পরিবার, আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককভাবে বড় হয়। তাদের সঙ্গী হয় মোবাইল আর ইন্টারনেটের জগত। কোনো বাচ্চা ব্যস্ত হয় গেমস নিয়ে, কোনো বাচ্চা বন্ধুত্বের নামে সম্পর্ক গড়ে তুলে আবেগের বশে বিপথে চলে। আবার কেউ ফ্যান্টাসিতে করছে টিকটক কিংবা গ্রুপ ম্যাসেজিংয়ে কোনো বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় কিশোর গ্যাং। পরিবারের পারস্পরিক বন্ধনের দূরত্ব কোনো দিন যন্ত্র দিয়ে ঘুচানো যায় না এটা বুঝতে হবে পরিবার ও সমাজকে।
সন্তান যখন বিপথে যায় তখন মনে হয় তার হাতে আদর ভালোবাসার নামে দামী মোবাইল তুলে দিয়ে কতটা ভুল করেছে। তাই সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেবার সাথে সাথে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। তা না হলে প্রতিটি মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যম, টিকটক বা কিশোর গ্যাংয়ের আতংকে ভুগতে হবে পরিবার ও সমাজকে।
একটা অস্থির সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণসমাজ। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ প্রভাব ফেলে তাদের মাঝে। অনেকে বন্ধুদের সমতালে চলতে গিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটাতে সহজ রাস্তা হিসাবে বেছে নেয় অনৈতিক কার্যক্রমকে। আবার এলাকায় প্রভাব খাটাতে হয়ে যায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
অন্যদিকে ইন্টারনেটের ব্যবহার করে অচেনা জগতে হারিয়ে গিয়ে বন্ধুত্বের নামে ভুল পথে চলে। আর সে ভুল পরিবেশে ডুবে থাকে রাত দিন। যার ফলে কাছের মানুষের চেয়ে সে অচেনা জগতের মানুষকে অনেক বেশি আপন মনে করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে আমার-আপনার সন্তানরা।
প্রতিটি পরিবার আজকাল চিন্তিত তাদের সন্তানদের আচার-আচরণ নিয়ে। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যায়, বাচ্চারা আনন্দ করার চেয়ে ব্যস্ত থাকে মোবাইল নিয়ে। টিকটকের অমুক ভাই, তমুক ভাই হয় তাদের আলোচনা বিষয়। দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। কারণ এখন আর স্কুল-কলেজ, পাড়া-মহল্লায় সেভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠান আয়োজন হয় না। বইয়ের মুখস্থ বিদ্যার বাইরে যে একটা জগত আছে তার চর্চা আজকাল তেমনভাবে হয় না।
সন্তান কেন কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে, সে কেন টিকটক করে তা নিয়ে সবার আগে চিন্তা করতে হবে পরিবারকে। একটা দামি মোবাইল সন্তানকে ভালোবেসে উপহার দেবার আগে; তাকে বুঝাতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার একটা মাত্রা থাকে বয়সের ব্যবধানে। সবার জন্য সব কিছু প্রযোজ্য নয়।ঠিক একইভাবে সন্তানের বন্ধু হয়ে খোঁজ রাখতে হবে তার চেনা জানার জগতকে। সে মিথ্যা বললে কেন বলছে তা জানতে হবে।
কথায় আছে, ‘শাসন করা তারেই সাজে, সোহাগ করে যে’। অতিমাত্রায় শাসন করলে সন্তানের সাথে যেমন দূরত্ব বাড়ে, তেমনিভাবে অতিরিক্ত ভালোবাসাতে ও সে প্রশ্রয় পেয়ে যায়। আর এর ফলে সন্তান নিজের মত যা খুশি করার সুযোগ নিয়ে দূরে সরে যায় বাবা মা হতে। সুতরাং সন্তানের প্রতি নিজের দায়িত্বটাকে যথাযথ পালনের চেষ্টা করতে হবে সবার আগে। ব্যস্ততার অজুহাতে সন্তানকে যন্ত্র নির্ভর জীবন দিলে তা কোনোদিনই হিতকর হবে না।
আজকের তরুণ সমাজ আগামীর ভবিষ্যৎ। তাদের জীবন থেকে ভুলগুলো শুধরে দিতে হলে বাবা মাকেই সবার আগে বন্ধু হতে হবে। তাদের চলাফেরায় বাস্তব চিত্রকে বুঝাতে হবে। উঠতি বয়সের ফ্যান্টাসি জীবনে যে বির্পযয় ডেকে আনে তা শেখাতে হবে সঠিক সময়ে। তা না হলে এ সমাজে কিশোর গ্যাং, টিকটক প্রবনতা কমবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)