মেঘের বয়স এখন ১০ বছর। ৫ বছর বয়সে বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তাকে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়েছিলো সে কথা হয়তো ওর মনেও নেই। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার সাংবাদিকদের কণ্ঠগুলোও এখন বজ্রকণ্ঠ হয় কেবল ১১ ফেব্রুয়ারি এলে।
বিচারহীনতার হতাশায় ২০১২ সালের বিক্ষোভ ৫ বছরের মাথায় আজ ছাই চাপা আগুন। এতোদিনেও চাঞ্চল্যকর ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ধীরগতি, অভিযোগপত্র দিতে টালবাহানায় সরকার-প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা। তাদের কয়েকজন মনে করেন খুনিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। কারণ বাংলাদেশের আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনী চাইলে দোষীরা আইনের আওতায় আসে এই দৃষ্টান্ত নতুন নয়। অথচ অদৃশ্য কোনো কারণে সাগর-রুনি হত্যা রহস্য চাপা দেয়া হচ্ছে।
তবে আশা ছাড়তে নারাজ এমন সাংবাদিক নেতারা বলছেন দেরীতে হলেও একদিন দেশের মানুষ সাগর-রুনি হত্যার বিচার দেখবে।
মন্থরগতির তদন্ত এবং চার্জশিটে বিলম্বে প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন,‘সাগর-রুনি হত্যার আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিকরা এখন হতাশ। ৪৬ বার সময় নিয়েও চার্জশিট দাখিল করা হয়নি। এসব থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে সরকার-প্রশাসন এই খুনের বিচার নিয়ে আন্তরিক নয়। আইন-শৃংঙ্খলাবাহিনী আন্তরিক হলে রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। একটিমাত্র আন্দোলনে সাংবাদিক সমাজ এক হয়েছিলো। কিন্তু তারপরও কাঙ্খিত ফল না পেয়ে সবাই হতাশ।’
নানা বিভক্তির পরও ঐক্যবদ্ধভাবে সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে চাপ অব্যাহত রাখতে চায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী ছাড়াও আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সর্বশেষ গণস্বাক্ষর কর্মসূচী শুরু করেছিলো ডিআরইউ।
এই গণস্বাক্ষর কী প্রভাব রাখবে এমন প্রশ্নে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা জানান, কেবল গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে ডিআরইউ আন্দোলন সীমাবদ্ধ নয়। সাগর-রুনির জন্য এখনো সাংবাদিক সমাজ অবিভক্ত নয় বলেও জানান তিনি।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন,‘গণস্বাক্ষর কর্মসূচির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা প্রকাশ পাবে ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে। সাংবাদিক-জনতা মিলে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচি দেবো। আমাদের মধ্যে কোনো বিভক্তি নেই। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচার চাই আমরা সবাই। আমাদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম থেকে কলম বিরতি পালন করেছি, দাঁড়িয়েছি জাতীয় সংসদ ভবন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সামনে।’
তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘চার্জশিট দেয়ার নামে দফায় দফায় সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। তারপরও বিচার নিয়ে আমরা আশাবাদী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যার বিচার যদি এতোবছর পর করা যায় তাহলে একদিন সাগর-রুনি হত্যার বিচারও দেখবে বাংলাদেশ।’
ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ-আন্দোলন এখন শুধু ফেব্রুয়ারির ১১ তে এসে আটকে গেছে, তা মানতে নারাজ ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক মোরছালিন নোমানি।
পেশাদার সাংবাদিকদের বৃহত্তম সংগঠনের এই নেতা বলেন,‘ সাগর ও রুনি, তারা দু’জনই আমাদের সংগঠন ও কাছের মানুষ ছিলেন। তাদের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ডিআরইউ আন্দোলনের মধ্যেই আছে। তবে বিচার না পাওয়ার ব্যাথা ক্ষোভ আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের প্রতিবাদ তাই ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীক নয়। ৫ টি বছরে বিচারের দাবিতে এমন কোনো কর্মসূচি নেই যা আমরা পালন করিনি। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।’
কিন্তু সাংবাদিকদের এসব প্রতিবাদ,সভা-সমাবেশ সরকার-প্রশাসনের টনক নড়াতে পারেনি বলেই মনে করেন কয়েকজন সাংবাদিক নেতা। কেউ কেউ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আন্দোলন থেকে ব্যক্তিগত সুবিধাও আদায় করেছে বলে রয়েছে অভিযোগ তাদের।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের মহাসচিব এম. আবদুল্লাহ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,‘ গত ৮ বছরে ২৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো দৈনিক সমকালের শিমুল। তার হত্যাকারী আটক হলেও রিমান্ডে নেয়া হয়নি।’
সাগর-রুনির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন,‘ তারা খুন হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টায় প্রকৃত খুনিদের আটকের প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হলো না। কারণ খুনিরা প্রভাবশালী। তাই এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া ৪৮ ঘণ্টার এতোগুলো বছর পর বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তার কাছে নাকি এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো তথ্যই নেই।
সব সরকারের আমলে অন্যান্য সব হত্যার বিচার হলেও সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়না। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছিলাম।’
কিন্তু সেখান থেকে সরকার ঘনিষ্ঠ অংশ সরে গেছে দাবি করে তিনি বলেন,‘এখন তারা সরকারের ছায়ায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়ে গুটিয়ে গেছেন। দরকষাকষিতে মেতে তারা পদ বাগিয়েছেন। তারা এতো নিচে নামবেন বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।’
এমন পরিস্থিতিতে গোটা সাংবাদিক সমাজেরই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার। তিনি বলেন,‘যে লক্ষণ দেখছি তাতে স্পষ্ট যে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারে প্রশাসনের কোনো ইচ্ছা নেই। যতদিন চাপ দিতে পেরেছি কোনো মতে একটা বক্তব্য এসেছে। তবে তারা আদৌ তা চাপ হিসেবে নেননি তা এখন বোঝা যাচ্ছে। সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেও যখন কোনো ফল পেলাম না তখন পুলিশ ও প্রভাবশালী সব মহল ধরেই নিয়েছে সাংবাদিকদের সঙ্গে যে কোনো অন্যায় করে পাড় পাওয়া যাবে। সরকার-প্রশাসনের নির্বিকার থাকাটা আমাদের শঙ্কিত করছে। বর্তমান সরকার এই শঙ্কা দূর করবে এটাই একমাত্র চাওয়া এখন।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সরওয়ার ওরফে সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। পরের দিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই)। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কিন্তু গত পাঁচ বছরেও পুলিশ মামলার তদন্তে কেনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি। অপরাধীদের চিহ্নিত বা আটকও করতে পারেনি৷ গতকাল ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলার তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও তদন্তকারী সংস্থা র্যাব তা দিতে ব্যর্থ হয়। আর এ কারণে আদালত তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদকে ২১ মার্চ তলব করেছেন।
সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ( সিপিজে) এর তথ্যমতে বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮টি। এর মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১টির। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যার বিচার এড়ানো দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম।