মাছ ছাড়াও বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও সাগরতলে বহু মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে এই সম্পদকে আহরণ করা যাচ্ছে না। ফলে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্পদের পরিমাণ ও এর ব্যবহারও জানা যাচ্ছে না। তাই এই সম্পদ আহরণে মহাপরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন।
সোমবার বিশ্ব সমুদ্র দিবসের আলোচনায় এমন বক্তব্য তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাগর সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ‘সেভ আওয়ার সি’ আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনাটি পরিচালনা করেন, ‘সেভ আওয়ার সি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী আনোয়ার হোসেন।
প্রতি বছর ৮ জুন বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালিত হয়। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে দিবসটি পালনের প্রস্তাব করেছিল কানাডা। ২০০৪ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটি সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
এবারে দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘টেকসই সমুদ্রের জন্য উদ্ভাবন’। অর্থাৎ উদ্ভাবনী কর্ম উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ করা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জীববৈচিত্র্য বিভাগের সদস্য ও ‘সেভ আওয়ার সি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, সাগরের সাথে সহবস্থান করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। এই জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবন। উপকূলে দ্বীপ সুরক্ষায় বাঁধ দেয়া কার্যকর কোন সমাধান নয়। বরং ওই সব অঞ্চলে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান, মাছ থেকে শুরু করে জীবন ধারণের অন্যান্য উপকরণ উদ্ভাবন করতে হবে। সমুদ্রকে ঠেকাতে বাঁধ তৈরিতে যত অর্থ ব্যয় হয়, তার চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয় হবে এসব উদ্ভাবনে।
এসডিজির ১৪ নম্বর লক্ষ্যতে সাগর ও সমুদ্র অর্থনীতির কথা বলা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও সাগরতলে বহু সম্পদ আছে। তবে পরিবেশের তোয়াক্কা না করেই এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্র বন্দর, বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য, কক্সবাজার সৈকতের অপরিকল্পিত হোটেল মোটেল নির্মাণ করায় সমুদ্রের অভ্যন্তরণে ও সমুদ্র সংলগ্ন এলাকার জীব বৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে।
চট্টগ্রাম মৎস অফিসের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন বলেন, সরকার বিভিন্ন এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করলেও এর দেখভাল হচ্ছে না। ২০২৫ সালের মধ্যে সাগর ও তৎসংলগ্ন ১০ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত অঞ্চল করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১ শতাংশ করা হয়েছে। তবে মাছের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ এলাকা সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে সামুদ্রিক সম্পদ শুধু মাছ নয়, এর বাইরেও আরো অনেক সম্পদ আছে।
এসব সম্পদ কোথায়, কী পরিমাণে আছে এবং এগুলোর ব্যবহারই বা কিভাবে হবে, সে লক্ষ্যে গবেষণার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ওসানোগ্রাফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (কক্সবাজার) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. শরিফ।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, এসডিজিতে লাইফ বিলো ওয়াটারের কথা বলা হলেও আমরা জানি না সমুদ্রের নীচের পরিস্থিতি কী। এজন্য দরকার প্রয়োজনীয় জাহাজ, সরঞ্জাম, গবেষণা, দক্ষ লোকবল ও ডুবুরি।
কিন্তু এসবের কিছুই এখনো করা হয়নি উল্লেখ করে আলোচকরা বলেন, সমুদ্রতলের পরিবেশ কতটা ভালো তা নিশ্চিত করে প্রবাল। কিন্তু সেন্টামার্টিন ও আশপাশের এলাকার প্রবালের অবস্থা ভালো নেই। অতিরিক্ত পর্যটকদের চাপ, প্রতিদিন বড় বড় জাহার নোঙ্গর করায় এখনকার পরিবেশ, প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব) ফোরকান আহমদ বলেন, সেন্টামার্টিনকে সুরক্ষায় পর্যটক যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় স্থানীয় অধিবাসীদের কাজে লাগাতে হবে।
তিনি জানান, সেন্টমার্টিনসহ কক্সবাজারের উন্নয়নে ৬৯০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে চিহ্নিত করে দিয়েছে সরকার। সাগরের কাছিম, লাল কাঁকড়া, সাগর লতা সংরক্ষণে চারটি জোন ভাগ করা হয়েছে। এসব জোনে বাঁশের বেড়া দেয়া হলেও সম্প্রতি আম্পানে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মেরিন ড্রাইভের পূর্বপাশ বরাবর ১ লাখ গাছ রোপণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিন আক্তার বলেন, অধিকহারে ও অপরিকল্পিত মাছ ধরার ফলে সমুদ্রের মৎস সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে। এটা রোধ করতে হবে। পাশাপাশি সমুদ্র তরঙ্গ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কৌশল রপ্ত করার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।