২০১১ আসরের ঠিক আগ দিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনি ও ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট বিশ্বকাপ পরিকল্পনা ঠিক করতে এক জরুরি সভায় বসলেন। যাতে দল ভালোভাবে ওয়ানডেতে জয়ের কৌশল ঠিক করতে পারে। ওই ঘটনার পর যুবরাজ সিং ভারতের হৃদয় বা আত্মা হয়ে ওঠেন। ঘরের মাঠে ভারতের শিরোপা জয়ের আসরে শেষ পর্যন্ত সেরা খেলোয়াড়দের ট্রফিটাও গিয়েছিল যুবির হাতেই।
বলতে গেলে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট যুগে ধোনির সভা ওয়ানডে ক্রিকেটের বিবর্তনে অন্যান্য দলগুলোর জন্য একটা মাপকাঠি ছিল। যার অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল যুবরাজের পারফরম্যান্স। বাংলাদেশের জন্য যে ভূমিকায় আরও অনেকটা এগিয়ে সাকিব আল হাসান। গত দুই দশকের মধ্যে যথাসম্ভব (উৎকৃষ্ট) ক্রিকেটের জন্য টাইগারদের তথা আমাদের সেরা ক্রিকেটার সাকিবকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে।
প্রথম কয়েকবছরে দল ও দেশের স্বার্থের বিপরীতে ‘আপত্তিকর’ পদক্ষেপের জন্য বা আপত্তিকর আচরণবিধি এবং দেশের চেয়ে আইপিএলকে অগ্রাধিকার দেয়ার উন্মাদীয় অভিযোগের কারণে বহুবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সাকিবকে। যদিও সেসব সাকিব মোকাবেলা করেছেন নীরবে এবং মানসিকভাবে যথাসম্ভব শান্ত থেকে। এটাই আধুনিক দিনের ক্রিকেট, যা তাকে হয়তো ধারাবাহিক ও বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্রিকেটারদের একজন করে তুলেছে।
খেলাধুলার জগতে সম্মানিত কন্ঠস্বরগুলোর মধ্যে একজন মার্ক নিকোলাস, যিনি ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচের সময় সাকিবকে ‘ন্যুনতম অলরাউন্ডার’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। আপনি এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? যার সম্পর্কে ওই কথা বলা হয়েছে, তিনি এখনো আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে একনম্বরে বসে আছেন। বাকিদের থেকে যোজন যোজন এগিয়েই।
এটাকে আপনি বিশ্বের অজ্ঞতা বা নিকোলাসের অচৈতন্য বলতে পারেন। আবার বলতে পারেন, সাকিব বাংলাদেশের হয়ে খেলেন বা তার টপ-স্টাইলের অভাব আছে! কিন্তু এই বিশ্বকাপে সম্ভবত একটা জিনিস নিশ্চিত করে ফেলেছেন সাকিব আল হাসান, ২১ শতকের সেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডারের আলোচনার যোগ্য তিনি।
বিশ্বকাপে যা করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের বিশ্বসেরা সেরা ক্রিকেটার, বহুদিন তেমনটা দেখা যায়নি। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান ৬০৬ রান করে আপাতত শীর্ষে সাকিব। আর কেন সেরা অলরাউন্ডার? সেটাও প্রমাণ করেছেন। এক বিশ্বকাপে এর আগে কোনো ক্রিকেটার পাঁচশ, ছয়শ বা তার বেশি রান ও ১০ বা তার চেয়ে বেশি উইকেট নিতে পারেননি। সাকিবের নামের পাশে ৮ ম্যাচে ১১ উইকেট। একবার নিয়েছেন ৫ উইকেটও।
রেকর্ড আছে আরও। বিশ্বকাপের একই ম্যাচে ব্যাট হাতে ৫০’র বেশি রান ও পাঁচ উইকেট নেয়া দ্বিতীয় খেলোয়াড় তিনি। এই পথে সাকিব ছুঁয়ে ফেলেন সদ্য অবসরে যাওয়া ভারতীয় বিশ্বকাপজয়ী তারকা যুবরাজ সিংকে। অসামান্য আরেকটি রেকর্ড গড়েছেন এমন, তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে যুবরাজ ও কপিলের পর এক বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেটের কীর্তি গড়েছেন।
বাংলাদেশ তো বটেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের পারফরম্যান্সের ধারে কাছেও নেই কেউ। যখনই ব্যাট হাতে নেমেছেন, রান পেয়েছেন। দুটি সেঞ্চুরি। পাঁচটা হাফ সেঞ্চুরি। জীবনের সেরা ফর্ম দেখিয়েছেন বাঁহাতি অলরাউন্ডার।
চলতি বিশ্বকাপে এক নায়কের নাম সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ও বলা যায়! এই আসরে সবমিলিয়ে প্রায় এক ডজন বিরল রেকর্ডের মালিক হয়েছেন সাকিব।
সাকিব হলেন তৃতীয় ক্রিকেটার, যার একটি বিশ্বকাপে ৬০০’র বেশি রান রয়েছে। এর আগে এই রেকর্ড ছিল কেবল শচীন টেন্ডুলকার (২০০৩) ও ম্যাথু হেইডেনের (২০০৭)। শচীনের পরে তিনিই হলেন দ্বিতীয় ক্রিকেটার, যিনি একটি বিশ্বকাপে ৭টি অর্ধশতক পেরোনো ইনিংস খেলেছেন। কুমার সাঙ্গাকারার পর সাকিবই একমাত্র ক্রিকেটার, যার বিশ্বকাপে ১২টি অর্ধশতক পেরোনো ইনিংস আছে।
যদিও এরকম দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি।
২০৬ ওয়ানডে ম্যাচে ৩৭.৮৬ গড়ে ৬,৩২৩ রান পরিসংখ্যানগতভাবে সাকিবকে একজন ভালো ব্যাটসম্যান বানিয়েছে। মনে রাখবেন, তিনি ভারতের বীরেন্দ্র শেবাগ ও যুবরাজ সিংয়ের চেয়ে বেশি গড়ের ব্যাটসম্যান। সেইসঙ্গে গত এক দশকে বলে হাতেও তার প্রভাব স্পষ্ট, যিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অস্ত্র। স্পিনে তুলেছেন ২৬০ উইকেট, যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শীর্ষে মাশরাফী ৫টি বেশি নিয়ে।
১৯৯৯ সাল থেকে ধরলে, এই সময়ে প্রতি ম্যাচে বল-ব্যাটের সঙ্গে সাকিবের চেয়ে বেশি কেউই জড়িত ছিল না (৮৬.৩ শতাংশ, যা অবশ্যই ব্যাটিং এবং বোলিং উভয়ই অন্তর্ভুক্ত) এবং তার অভিষেকের পর থেকে একমাত্র লাসিথ মালিঙ্গাই কেবল সাকিবের চেয়ে বেশি উইকেট নিতে পেরেছেন।
গত একযুগে পূর্ণ আধিপত্যর যা মূল কথা তা হল, সাকিব যখন তার ব্যাটের মুক্ত প্রবাহে এই বিশ্বকাপে আসল কথা বলছেন– তখন তর্ক দেখা দেয় যে, আসলে কী তিনি ২১ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার? এরপর জ্যাক ক্যালিস, শেন ওয়াটসন, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস এবং শহীদ আফ্রিদিরা কী করবেন?
উদাহরণস্বরূপ, ১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্যারিয়ারে ৪৪.৩৬ গড়ে রান করেছেন ক্যালিস। এমনকি যদি আপনি ৩১.৭৯ গড়ে ওয়ানডেতে তার পাওয়া ২৭৩ উইকেট হিসেবে নাও নেন, তবুও ১১,৫৭৯ রান তাকে সেরা ব্যাটসম্যানদের কাতারে সামনের দিকেই রাখবে। ক্যালিসের সাড়ে এগারো হাজারের বেশি রানের মধ্য আবার ৮,০৩৬ রানই দলের জয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে জয়ের এই পরিসংখ্যানে সাকিবের গড়ও খারাপ নয়- ক্যালিসের ৫১.১৮ গড়ের বিপরীতে ৫২.৪৫ গড়ে বরং এগিয়েই। কিন্তু এর প্রভাব কী?
ক্যালিসের ক্রিকেটের শুরুটা সাউথ আফ্রিকার বিতর্কের আবহে এবং প্রথমদিকে ব্যাটিং অর্ডারে তার জন্য সামান্য সমর্থন ছিল। যদিও পরে আফ্রিকান দেশটি এবি ডি ভিলিয়ার্স, গ্রায়েম স্মিথ এবং ডেল স্টেইনের মতো খেলোয়াড়দের পেয়েছিল। তবে ক্যালিস চিরকালের আঠা হিসাবে রয়েছেন, যিনি অন্যান্য ক্যারিশম্যাটিক ক্রিকেটারদের প্রকাশিত হওয়ার লাইসেন্স দিয়েছেন।
ক্যালিসের মতো করে ধরলে সাকিবের ব্যাপারে বলা যায়, তিনি ছাড়া বাংলাদেশ দলের হয়ে তামিম ইকবাল, মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা এবং মুশফিকুর রহিম তুলনামূলক দক্ষতার সাথে খেলেছেন এবং এই তিনজন বাদে অন্য কেউই ততটা দায়বদ্ধতা অর্জন করতে পারেনি।
বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে জিতে মানুষের হৃদয় জিতেছে বাংলাদেশ। তবে টপ টিমগুলোর বিপক্ষে শুরুতে টাইগারদের জয় নিয়মিত ছিল না। জয়গুলোর বেশিরভাগই অপেক্ষাকৃত ‘ছোট’ দলের বিপক্ষে। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় তখন ক্যালিসের চেয়ে সাকিবের কাঁধে চাপ তুলনামূলক কম ছিল। তবে পরিস্থিতি এখন বদলেছে।
এই প্রসঙ্গে থাকবেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ও শেন ওয়াটসনও। দুজনের নামের পাশেই বিতর্ক শব্দটা আছে। পরিমাণটা সাইমন্ডসের গায়েই বেশি। প্রথমদিকে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন তিনি, যেখানে তার গড় ৪৪.৫২। পরে তিন ও চারনম্বরে ব্যাট করে আরও ভালো করেছেন, সেখানে তার গড় ৪৫.২৫। তবে ওপেন থেকে শুরু করে নানা জায়গায় ব্যাট করা ওয়াটসনের গড় ৩৫.৯২।
বোলিং সাইমন্ডসকে নিচে রাখে, যদিও তাতে তার নিজের কোনো দোষ নেই। ক্যালিস এবং সাকিবের মতো ক্যারিয়ারের বড় অংশে গ্যাংস্টার বোলারদের মতোই সুযোগ ছিল তার এবং ওয়াটসনের। কিন্তু সেটা দীর্ঘ সময়জুড়ে হয়নি, তার দলে প্রচুর বিকল্প থাকার কারণে। পুরো দলটাই যে ভরা ছিল মেগাস্টারে।
একইভাবে, অলরাউন্ডার প্রতিযোগিদের মধ্যে আরেক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী শহিদ আফ্রিদি। ৩৯৮ ওয়ানডে ম্যাচে ৩৯৫ উইকেটের সঙ্গে ৮,০৬৪ রান। আফ্রিদি তার প্রজন্মের একজন সুপারস্টার ছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের কার্যকর পরিবর্তনে ফ্যাশনেবল ভাব তৈরির বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন তিনি। সর্বোপরি যা তাকেও এ পথে অমরত্বের দাবিদার করে তুলেছে।
তবে সাকিব এবং ক্যালিসের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করা হলে, দেখা যাবে আফ্রিদির মধ্যে কোনো দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা নেই- ব্যাটিংয়ে ২৩ ও বোলিংয়ে ৩৪ গড় তার দাবিকে দমন করার জন্য যথেষ্ট। বরং আবদুল রাজ্জাক তখনো সেই দলের সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন। যদিও তিনি নিজেকে আরও ভালো অলরাউন্ডার করতে যথেষ্ট সময় নেননি।
তাহলে কী সাকিব আল হাসান সবার উপরে? এই তালিকায় যে সোনালী নামগুলো আছে, তাতে সাকিবের আলো কোনো অংশেই হয়ত কম নয়। ক্যালিসের ভক্তরা এই ‘ওয়ান-কোর্স ঘোড়ার’র সঙ্গে তুলনা করাটা অনন্তকাল পর্যন্ত অবিশ্বাস করতে পারেন। তবে বাংলাদেশ সমর্থকরা সাকিবের ব্যাপারেই গোঁ ধরবেন নিশ্চিত।
বিশ্বকাপের সময়ও একই প্রশ্ন উঠেছে, সাকিব আল হাসান কি বিশ্বসেরা কিংবদন্তি অলরাউন্ডারদের তালিকায় ঢুকে গেছেন? অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার মাইক হাসির তার এক শব্দের উত্তরে বলেছেন, ‘অবশ্যই।’
সাকিবের মান কোথায় তার কিছুটা ছবি এক লেখায় দিয়েছেন ইএসপিএনের অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক মেলিন্দা ফারেল। ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের সমর্থক আর সাকিবের পারফরম্যান্সের পর তিনি লিখেছেন, ‘ইসিবি (ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড) এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করে। তারা উভয় পক্ষই দ্বি-পাক্ষিক সফরের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায় না বা তাত্ক্ষণিক পরিকল্পনায় অনেক সময় সিরিজ বাতিল করা হয়। এটা (বাংলাদেশ-পাকিস্তান) লর্ডসে তাদের প্রথম ওডিআই হতে পারে, তবে ২০১০ সাল থেকে তারা ইংল্যান্ডে দ্বি-পক্ষীয় সিরিজ খেলতে পারেনি এবং আরও বেশি হতাশাজনক যে তারা নিউ ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রামের অধীনে অন্তত ২০১৩ সাল পর্যন্ত সফর করবে না (অস্ট্রেলিয়ায়, এটি আরও খারাপ– ২০০৮ সাল থেকে তারা দ্বি-পক্ষীয় সিরিজ খেলেনি)। কিন্তু, তারা এই টুর্নামেন্টজুড়ে দেখিয়েছে, তারা বিস্ময়কর অতিথি, তাদের দলের প্রতিটি ম্যাচ খেলে একেকটি স্পন্দন এবং আত্মা আনয়ন করে। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের দারুণ পারফরম্যান্স প্রমাণ করে তারা ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় আরও বেশি খেলার সুযোগ পাওয়ার যোগ্য।’
সাকিব সর্বকালের সেরা কিনা এ নিয়ে হয়ত বিতর্ক অব্যাহত থাকবে এবং যুক্তি অনন্তকাল চলবে। তবে সময় বুঝতে পেরেছে যে, ২১ শতকে বেশ কয়েকটি নিরিখে সর্বশ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার হওয়ার দাবিদার সাকিবই। তিনি যখন ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন, তখন স্পষ্টভাবেই ক্রীড়াঙ্গনের সর্বকালের কিংবদন্তি হিসেবে তার প্রতি সম্মান জানাতে বাধ্য হবেন সকলে। তিনি কোন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বা তার প্রতিপক্ষ কে ছিল সেটা অবশ্যই কোনো ব্যাপার হবে না তখন। কারণ, ক্রিকেটে পরিসংখ্যানগত উত্তরাধিকার সূত্রতা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি।