নারীদের যৌন স্বাধীনতা জোরালো আঘাত হেনেছে সাউথ কোরিয়ার কঠোর রক্ষণশীল সমাজে। সেক্স বিষয়টি সমাজে আরও উন্মুক্ত হচ্ছে। শত বছর ধরে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় কঠোর লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করছে নারীরা। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান যাকে অভিহিত করেছে ‘যৌনতায় বিপ্লব’ বা এক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন।
এই পরিবর্তন দেশটিতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। গভীরভাবে রক্ষণশীল সমাজও শিথিলতা আনতে শুরু করেছে এক্ষেত্রে।
এই পরিবর্তনমুখী সমাজের অংশ লিন ইউ-হান। প্রতিটি সফল ‘ডেট’ শেষে টুইটারে এই বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সাউথ কোরিয়ার রক্ষণশীল প্রথা ত্যাগের জন্য অনুসারীদের আহ্বান জানান। আনন্দ উপভোগের কথা বলেন।
এক পোস্টে চিরাচরিত প্রথাকে প্রবলভাবে আঘাত করে তিনি লিখেন, “শারীরিক মিলনের জন্য কেন দায়িত্ববোধে জড়াতে হবে বা তেমনটি অনুভব করতে হবে?” তিনি লিখেন, “যদি তারা শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় পুরুষ হয় তাহলে চালিয়ে যাও।”
কোন বন্ধনে জড়ানোর চিন্তাকে উড়িয়ে দেন তিনি। এক পোস্টে বিছানায় অপারদর্শী পুরুষের ব্যাপারে নিজের ঘৃণাবোধও প্রকাশ করেন। “এখন থেকে দেখবো, মিলন উপভোগ্য না হলে, কখনোই আর দেখা করবো না।”
সেক্স বিষয়ক দীর্ঘদিনের ট্যাবু দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে দেশটিতে। অস্থায়ী সম্পর্ক আরও বাড়ছে। বিয়ের আগ্রহ কমছে। গর্ভনিরোধক চাওয়া রোগীর সংখ্যাও প্রবলভাবে বাড়তে দেখছে ডাক্তাররা।
“সেক্স বিষয়ে নারীদের প্রকাশ্যে কথা বলাটা এখনও অনেকেই খারাপ চোখে দেখে, যেখানে পুরুষরা সবসময় এনিয়েই কথা বলে।” সিউলের অভিজাত গ্যাংনামের বাসিন্দা লিন এক সাক্ষাৎকারে এমনটি বলেন। “আমি শুধু এই মনোভাব ভাঙ্গতে চাই।”
এই ৩৪ বছর বয়সী নারী ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার সম্পর্ক এবং সেক্স বিষয়ক চিন্তাগুলো জানাচ্ছেন। অন্যান্য তরুণীদের আরও স্বাধীন হতে উৎসাহিত করাই তার লক্ষ্য। তিনি বিশ্বাস করেন, সাউথ কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল হওয়া, তরুণদের মধ্যে বিয়ের গুরুত্ব কমে যাওয়া, অস্থায়ী সম্পর্ককে জায়গা করে দিচ্ছে।
সিউলের অনেকেই সেক্স নিয়ে আলোচনা করতে অস্বস্তিবোধ করে। কোরিয়ানরা এক্ষেত্রে বিভিন্ন শব্দের উল্লেখে ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করে। এমনকি ‘সেক্স’ শব্দটাই তারা ব্যবহার করে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ইন্টারনেট ব্যবস্থার অন্যতম হলেও, দেশটির সরকার নিয়মিতভাবে অনলাইন পর্নোগ্রাফি সেন্সর করে। জুয়া বা নর্থ কোরিয়ান প্রচারণা যেমন, তেমনই সেন্সর এক্ষেত্রেও।
‘সেক্স শপ’এর বিস্তার দেশটির উন্মুক্ত আচারের সবচেয়ে সুস্পষ্ট নিদর্শন। সাম্প্রতিক এই ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠেছে।
মূলত নারীদের ফোকাস করে ডোসানের সেক্স শপ ‘প্লিজার ল্যাব’ এর প্রতিষ্ঠাতা এউরা কোয়াক। পূর্বে নার্স হিসেবে কাজ করা কোয়াক নিয়মিতভাবে শিক্ষামূলক সেমিনারের আয়োজন করে। সেক্স টয় সংক্রান্ত বাজে মনোভাবের পরিবর্তন করতে চায় তারা।
“সেক্সের সময় নারীদের প্রধান ভূমিকা নেওয়া সাউথ কোরিয়ান সমাজে কঠিন।” কোয়াক বলেন, “পুরুষেরা সবসময় এক্ষেত্রে প্রধান হতে চায়। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের জন্য যৌনতা ছিলো না।”
“তৃপ্তি দেওয়া লজ্জার বিষয় নয়, কিন্তু কোরিয়ান সংস্কৃতিতে নারীরা তৃপ্তির বিষয়ে কথা বললে মানুষ তাদের বেশ্যা বলে।” কোয়াক বলেন।
দীর্ঘস্থায়ী রক্ষণশীল আচারের নিদর্শন দেখা যাবে সাউথ কোরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন ‘নাভার’এও। স্টোরটির নামের সার্চ রেজাল্ট ব্লক করে দিয়েছে তারা। এজন্য প্রতিটি আইটেমে এই নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দেওয়ার ব্যাখ্যা লেখা স্টিকার যুক্ত করেছেন কোয়ার্ক।
“আমাদের মতো মানুষ ছাড়া, সেক্স বিষয়ে অন্যান্যদের অনুধাবনে পরিবর্তন আসেনি। এটা আমাদের অস্তিত্বের জন্য সমাজের অনুমোদনের বিষয় না; একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়।” তিনি বলেন, এধরণের ব্যবসা শুরু না হলে, ৫ বছর আগে যেখানে ছিলাম, সেখানেই থাকতে হতো।”
ধীরে ধীরে উত্থান
প্রধান মিডিয়াগুলোতে সম্পর্ককে এখনও ‘পবিত্র’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, কিছু ব্যতিক্রমী প্রোগ্রামও হয়। যা যৌনতার স্বাধীনতার বিষয়টিকে মানিয়ে নিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে। এক্ষেত্রে আদালতের একটি রায়ও অনুকূল ভূমিকা রেখেছে।
এমনই এক টেলিভিশন শো উইচ হান্ট। ২০১৩ সালে তা প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিলো। সেক্স এবং সম্পর্ক নিয়ে অকপট আলোচনার জন্য পরিচিত ছিলো অনুষ্ঠানটি। সেখানে মূলত অপটু পুরুষদের প্রেমে সফল হওয়ার শিক্ষা দেয়া হতো। এর চারজন উপস্থাপকই পুরুষ ছিলেন।
মার্চে ‘ক্র্যাঙ্কি মেন এন্ড ওমেন’ নামের একটি শো ‘প্রতিদিনের জীবনে জেন্ডারের গৎবাঁধা ধারণা নিয়ে সৎভাবে আলোচনার’ স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সম্প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি প্রখ্যাত নারীবাদীদের সমর্থন পায়।
২০১৫ সালে দেশটির শীর্ষ আদালত পরকীয়াকে নিষিদ্ধ করা ৬০ বছরের পুরোনো আইনকে অবৈধ বলে রায় দেয়। আইনে অপরাধটি শাস্তিযোগ্য ছিলো, সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড। এর আগেও আদালতটি তিনবার আইনটি রিভিও করলেও তা বহাল রেখেছিলো।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে নারীবাদের উত্থানে এই যৌন স্বাধীনতা এবং তৃতীয় লিঙ্গ বা সমকামী, উভয়কামীদের সমতার জন্য লড়াইও বাড়ে।
একটি ই-কমার্স কোম্পানিতে কাজ করেন কুসিয়া ডিয়ামান্ট। একাধারে তিনি সিউলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ড্র্যাগ কুইন (বিনোদন বা ফ্যাশনের জন্য পুরুষের নারী বেশে সাজা)।
তিনি বলেন, “আমাদের কমিউনিটি দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলো। একই সাথে বৃহত্তর সমাজের সাথে সেতুবন্ধন হতে চেয়েছিলো তা।”
২০১৫ সালে শুরু হওয়া ‘কোরিয়া কুইর কালচার ফেস্টিভাল’ (এলজিবিটি অধিকার বিষয়ক) সিউলের প্রাণকেন্দ্র সিটি হলের বাইরে এক প্লাজায় হয়ে আসছে। উৎসবটির প্রতি মনোযোগ বাড়ছে । বিক্ষোভকারীরা আরও সরব হচ্ছে।
‘সেক্সকে আরও উপভোগ্য ভাবতে সাহায্য করছি আমরা।’ কুসিয়া বলেন, “ আমাদের কোন অনুষ্ঠান হয় না, নেতাও নেই। আমাদের ভেতর থেকেই পরিবর্তন আসছে, যৌনতা ও লৈঙ্গিক বিষয়গুলো দেখছে, শিখছে। ড্র্যাগ পারফর্মেন্সের বিষয়গুলোও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।”
কিন্তু সাউথ কোরিয়ার বৃহৎ ও প্রভাবশালী খৃষ্টান সম্প্রদায় সাম্প্রতিক এই প্রবণতায় উদ্বিগ্ন। পাদ্রি সো ক্যাং-সাক সেক্স বিষয়ক উন্মুক্ত-অবাধ আচারের অসুবিধা নিয়ে প্রায়ই প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার এলজিবিটিআই-বিরোধিতাও প্রবল।
“সাউথ কোরিয়া প্রথাগত মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে আসছিলো, কিন্তু এটা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন।” তিনি বলেন, “যা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে।”
তিনি এর সঙ্গে সামার অব লাভের তুলনা করেন, যখন হাজারো হিপ্পিরা শান্তি ও মুক্ত ভালোবাসাকে সমর্থন জানাতো ১৯৬৭ সালে স্যান ফ্র্যান্সিসকোতে সমবেত হয়েছিলো।
সিউলের উপশহরে চার্চটিতে নিয়মিত আসা ৪০ হাজার মানুষকে এবিষয়ে বলেন তিনি। সায়ে ইডেন ধর্মসভায় যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘মানুষের ক্ষেত্রে যৌনতা প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে নৈতিকতা থাকা উচিত। এমনকি এখন যে বন্যার মতো নতুন উদারতা আমাদের দিকে ধেয়ে এসেছে, তরুণরা যারা অবাধ যৌনতায় জড়াচ্ছে, তারাও যদি গভীরভাবে নিজেদের দিকে তাকায়, তারা বলতে পারে না, যা তারা করছে তা বৈধ বা সঠিক কিনা। ’