সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ে, সাংবাদিকতা করে আমি কি ভুল করেছি? এমন প্রশ্ন পড়াশুনাকালীন একবারও আমার মাথায় আসেনি, এখনো আসে না, কোনদিন আসবেওনা। আমি ‘বাই চান্স’ এখানে ভর্তি হইনি, আমি ভালোলাগা থেকে এসেছিলাম। ভাগ্যিস এসেছিলাম, না হলে জীবন এত রঙিন, এত বৈচিত্র্যময় দেখা হত না। ক্লাসে আমার কোন শিক্ষক বা ক্লাসরুমের বাইরে বন্ধু, বড় ভাই-আপু এমন কোন বার্তা আমাকে দেননি যাতে মনে হতে পারে, সাংবাদিকতায় পড়ে কিংবা সাংবাদিকতায় এসে আমি ভুল করেছিলাম। সাংবাদিকতা বিভাগ বরং আমাকে নাটোরের বনলতা সেনের মতো শান্তি দিয়েছিল। হাজার বছর হেঁটে ক্লান্ত পথিক আমি মরুভূমির বুকে যেন পানির দেখা পেয়েছিলাম! হলে কিংবা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক বা পেশাগত কারণে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো নানাবিধ কষ্টের মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু বিভাগ কিংবা আমার কর্ম আমাকে ভরসা দিয়েছে প্রতিনিয়ত। জীবনে বাবা-মা, ভাই-বোন, ভাবী, স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের অবদানের সাথে কোনো কিছু তুলনীয় নয় সত্য। পরিবারের পরেই আমাকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী লালন-পালন করেছে আমার বিভাগ এবং সাংবাদিকতা পেশা।
আমার বর্তমান পরিচয় আমি ‘শিক্ষক’, কিন্তু এখনও আমি ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দিতে ভালোবাসি, যদিও এটা ঠিক নয়; কারণ আমি এ পেশায় আর পুরোপুরি নেই। সাংবাদিকতা পার্টটাইম করার মতো কোন কাজ না। প্রফেশনালি যে ফুলটাইম দিয়ে কাজ করবেন এবং এর বিনিময়ে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি/বেতন পাবেন তাকেই সাংবাদিক বলা উচিত। যারা নাগরিক সাংবাদিকতা করবেন, তাদের বলা হবে ‘নাগরিক সাংবাদিক’। যারা কলাম লিখবেন, তারা হবেন কলামিস্ট, যিনি সাংবাদিকতার কাজে লাগবে এমন ছবি তুলবেন তাদেরকে বলা হবে ফটোসাংবাদিক। কলাম লেখা আর সাংবাদিকতা করা এক জিনিস নয়। আজকাল তো, ছাপাখানায় কাজ করা লোকও নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন। ঠগ, বাটপারে ভরে গেছে সমাজ। সাংবাদিকতার নামে কেউ মফস্বলে বাটপারি করে, কেউ করে রাজধানীতে। এরপরও সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজের জন্য এমন কিছু কাজ করা যায়, যা অন্য পেশা দিয়ে হবে না। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে কী মজা, তা একমাত্র সাংবাদিকরাই জানবে।
আমি বিশ্বাস করি, সাংবাদিকতা শিক্ষকতার মতই মহান একটা পেশা, একটা কাজ। ক্লাসে একজন শিক্ষকের লেকচার থেকে একটি ভালো প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় কিংবা একটা মতামত কলাম কিংবা একটি ছবি, একটি ক্যাপশন কোন কোন ক্ষেত্রে সমাজ-সংসারে হাজার গুণ বেশী প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে; তবে ভালো শিক্ষকের লেকচার, আচরণ, চলনবলন, পোশাক, ভাষা, বচন সমাজে সুনামির মত ধীরে কিন্তু বিস্তৃত পরিধি নিয়ে আলোড়ন তুলে, পরিবর্তন আনে। তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদ, সময়ের উভয় প্রেক্ষাপটে, সমাজে নানা সংকটে, সম্ভাবনায় আওয়াজ তোলে, আলোড়ন সৃষ্টি করে সিস্টেমে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে একজন সৎ, দক্ষ সাংবাদিক অনেক বড় শিক্ষকের চেয়েও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
সাংবাদিকতার কোন কোন শিক্ষক সাংবাদিক ‘তৈরি’ করেন বলে একটা চাপা অহংকারে প্লাবিত হন বটে, বাস্তবতা হল ক্লাসরুমের সাংবাদিকতার লেসন আর বাস্তব জগতের সাংবাদিকতার মধ্যে আকাশসম তফাৎ রয়েছে। বাইরের জগত এতটাই শক্তিশালী যে, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ক্লাসরুমের শিক্ষকদের উপদেশ অনুযায়ী সাংবাদিকতা করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সাংবাদিকতা করে জীবিকা অর্জনের সুযোগ শিক্ষকরা দেন না, এটা তাদের কাজও না। সাংবাদিকের ‘চাকরি’ যারা দেন, অর্থাৎ মালিকদের এবং তাদের অনুগত সম্পাদকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বার্থ উদ্ধার করেই সাংবাদিকতার ‘চাকরি’ করতে হয়। বিদ্রোহ করে কেউ চাকরি হারাতে চান না; যদিওবা কেউ কেউ বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেন তার পরিণতি ভালো হয় না। তাই মালিক, সম্পাদক, সিনিয়র সহকর্মী, রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা টাকাওয়ালাদের সাথে আপোষ করে চলতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ‘সাংবাদিকতা’ আর অবশিষ্ট থাকে না, অস্তিত্ব ধরে রেখে সমাজে নানা প্রশ্ন তৈরি করে শুধু ‘চাকরি’। শুধু এই ‘চাকরি’ করার পরেও যারা সমাজে সাংবাদিক পরিচয়ে ক্রিয়াশীল তাদের অনেকেই আবার পেশাদারিত্ব বজায় রাখেন না।
‘সাংবাদিক’ হওয়া অনেক কঠিন কাজ, ফলে পেশাদারিত্ব বজায় রেখে সাংবাদিকতার নামে চাকরিটাও যদি আমরা করে যেতে পারতাম তাহলে আজ সমাজে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠত না। ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’র নামে যে সোনার হরিণের দিদার আমরা পেতে চাই, সেটি আসলে ‘সাংবাদিকতার স্বাধীনতা’ নয়। মালিক-সম্পাদকের স্বাধীনতা কিংবা সাংবাদিকের স্বাধীনতা, আর সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এক বিষয় নয়। সমাজ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য কিছু করতে চান, এমন সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত আপোষ আর অবদমনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আর যারা সাংবাদিকতার নামে ‘চাকরি’ করাটাকে মেনে নিয়ে সিস্টেমের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন তাদের মানসিক সংকট অনেক কম। অন্তত রাজধানী ঢাকায় শেষোক্ত টাইপের সাংবাদিকদের সংখ্যাই বেশী। আবার এমন ‘বড় সাংবাদিক’ দেশে আছেন বলে টেলিভিশন, রেডিও চ্যানেল, প্রিন্ট এবং অনলাইন সংবাদপত্রগুলো আত্মপ্রকাশ করতে পারছে এবং অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এই ‘বড় সাংবাদিক’দের সঙ্গে পুঁজিপতিদের মেলামেশা থেকেই জন্ম নিয়েছে অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জন্মসমূহ বৈধ না অবৈধ, সেদিকে আলাপ না নিয়ে যাওয়াই ভালো।
ক্লাসরুমে ৫০ কিংবা ১০০ মিনিটের ক্লাসে অনেক কিছুই শেখানো যায় না। ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’ কথাটি এমনি এমনি আসেনি। তবে ভালো হতো যদি আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্ব পাঠশালা থেকে ইতিবাচক সব শিক্ষা নিতেন। সবাই না, কেউ কেউ আছেন নেন না। শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের এই দলটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই এস্টাবলিশমেন্ট এর সঙ্গে আঁতাত করে ‘সিস্টেম’ করতে শিখে যান। এদের কর্মকাণ্ডে অন্যরা অনেক আগেই জেনে যান যে, সাংবাদিকতা আর নৈতিকতা এখন সবসময় একসাথে চলে না। ক্লাসরুমে শিক্ষক হিসেবে আমরা যত জ্ঞানের কথাই বলি না কেন, শিক্ষার্থীদের অনেকে এক কান দিয়ে ঢুকায়, আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। অনেকে আছেন যারা আসলেই মুগ্ধ হয়ে শুনে এবং চর্চা করার চেষ্টা করে। অনেকে আছেন মুগ্ধ হওয়ার ভান করে মুখে এবং চোখে একটা নকল হাসি ধরে রাখেন। অনেকে আছেন, কোনো কিছুতেই মুগ্ধ হন না, মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা লাগে, যে ক্ষমতা এরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই হারিয়ে ফেলেন। অনেক শিক্ষক ‘জ্ঞান’ বিতরণ করতে হয়ত পারেন, কিন্তু দক্ষতার তালিম দিতে পারেন না। সব মিলেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, যে যেভাবে নেয়।
অনেকে বলবেন, নিশ্চিত জীবন পেয়ে, মাস শেষে নিয়মিত বেতন, বোনাস পেয়ে এমন বড় বড় কথা কতজনই বলে। আপনারা বিশ্বাস করুন আর না করুন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। হৃদয় দিয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ ও পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই আমি ভালোবেসেছিলাম। পেশাগত এবং ব্যক্তিগত কিছু কারণে আমি অন্য পেশা বেছে নিয়েছি সত্য, কিন্তু তাতে আমার কোন দায় নেই বলেই আমার বিশ্বাস। কম বয়সে নিজ কর্মগুণে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সাংবাদিক শরীফুল হাসান সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেন যে, তিনি আর সাংবাদিকতা পেশায় থাকছেন না, একটি বড় এনজিওতে চলে যাবেন। এমনিতে কত সাংবাদিক কত দিকে চলে যান, কেউ খবরও রাখে না। কিন্তু হাসান এমন সাংবাদিক ছিলেন না। শুধু ফেসবুকে লিখেই ব্যক্তি শরিফুল হাসান যেন একটি ‘গণমাধ্যম’ হয়ে উঠেছিলেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি একজন সমাজকর্মী হিসেবেও কাজ করে থাকেন তিনি। অনেক জনপ্রিয় সাংবাদিক শরিফুল হাসান। বস্তুনিষ্ঠতায় হয়ত নয়, কিন্তু পেশাদারিত্বে সাংবাদিক হাসানের পত্রিকা যে বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় সে কথা না বললেই নয়। রাজনীতি ও জনমানসে প্রভাব, নিয়মিত মজুরি, বোনাস, নানা সুযোগ-সুবিধা, পত্রিকার কাটতি সব মিলে এই পত্রিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল ও পেশাদার পত্রিকা। এত কিছুর পরও তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে একটি এনজিওতে যোগদান করতে চলেছেন। কারণও উল্লেখ করেছেন তিনি। হাজার হাজার মানুষ তার এই সিদ্ধান্তের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। সবচেয়ে বেশী মন খারাপ করেছে দুই ধরনের মানুষ। যারা সাংবাদিকতাকে আজীবনের পেশা হিসেবে বেছে নিতে নিজেদের প্রস্তুত করছিলেন এতদিন, তারা। আরেকদলে আছেন তারা, যারা নানা বিপদে-আপদে প্রকাশ্যে, গোপনে শরীফের সহযোগিতা পেয়েছেন। দেশের সবচেয়ে পেশাদার সংবাদ মাধ্যমগুলোর একটিতে এক যুগ ধরে কাজ করার পরে কেন একজন সাংবাদিক প্রফেশন ছেড়ে যান? এর উত্তরও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, জীবন ধারণের মত ‘দরকারি’ অর্থ তিনি পত্রিকা থেকে পাচ্ছিলেন না। অনেকে তার কারণ মেনে নিলেও, প্রফেশন ছেড়ে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না। অনেকে আবার তার ‘আর্থিক’ কারণ প্রদর্শনের সমালোচনাও করছেন। বলছেন, পেশার প্রতি ‘সম্মান’ প্রদর্শন করে আর্থিক কারণটা গোপন রাখতে পারতেন। অনেকে এটাও বলেছেন, এত বড় পত্রিকায় নিয়মিত ‘ভালো অংকের’ মজুরি পেয়েও যদি কেউ ঢাকায় সংসার চালাতে না পারেন তাহলে ভাবতে হবে, পেশার প্রতি তার ‘ভালোবাসা’ নেই। সব আলোচনা-সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছেন, মেধা অনুযায়ী প্রাপ্য মজুরি না পেলে, অন্য পেশায় চলে যাওয়ার অধিকার তার আছে।
মেধা অনুযায়ী প্রাপ্য বেতন বা মজুরি এবং সম্মান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। সাংবাদিকতা ছেড়ে যাওয়াদের মধ্যে আমিও একজন। আমি একটি বেসরকারি বার্তাসংস্থায় কাজ করতাম। জীবনের একটা সময় পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, বেশ ভালো আছি। আরেকটা পর্যায়ে মনে হয়েছে, এ পেশায় আমি আমার প্রাপ্য সম্মান এবং বেতন/মজুরি পাচ্ছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে, ভালো ভালো প্রতিবেদন করে, দিনরাত পরিশ্রম করে আমি যে মজুরি পাই, একজন অদক্ষ, কম শিক্ষিত রিপোর্টারও আমার সমান কিংবা বেশী মজুরি পান। এমনকি অফিসের বসের কাছে আমার থেকে বেশী খাতির পান। আমাকে নির্দিষ্ট মজুরি দিয়ে চলতে হয়, তাই ভালো পোশাক, গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করার সাওয়ালই উঠে না। দারোয়ান দেখে, আমি প্রতিদিন লোকাল বাসে অফিসের সামনে নামি অথবা হেঁটে আসি। দারোয়ান আমাকে সালাম দেওয়া দূরের কথা, উঠে দাঁড়ায়ও না। কিন্তু আরেকজন রিপোর্টার যে কি না ঠিকমত বিএ পাশও করেনি, তার অনেক ‘সম্মান’। অফিসে গাড়ি নিয়ে আসে, দারোয়ান উঠতে বসতে সালাম দেয়। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হল, দেখলাম যাদের কাছে কাজ শিখছিলাম আমি, অর্থাৎ অফিসের সিনিয়র সাংবাদিকদেরকে তাদের ২০/৩০ বছরের পাওনা বুঝিয়ে না দিয়েই বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। অফিসে প্রমোশন এর কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এমন অবস্থায় আমি পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও আমি সাংবাদিক হিসেবে বড় কিছু ছিলাম না। তবে কাজ করেছি বড় জায়গায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি প্রেস টিমে কাজ করেছি প্রায় তিন বছর। তবে এখানে যতখানি সাংবাদিকতার, চার চেয়ে অনেক বেশী দায়িত্বশীলতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেশে-বিদেশে কাজ করতে গিয়ে এমন সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা বাংলাদেশের খুব মানুষের ভাগ্যে জুটে। অনেকে আমাকে এখনও বলেন, এত গ্লামার, ক্ষমতা ছেড়ে কেন আমি ‘শিক্ষক’ হলাম? আমার এক স্যার বলেছিলেন, ‘শিক্ষকতা পেশা হল পুকুরের মত নিস্তরঙ্গ, সহজে এখানে ঢেউ উঠে না, তুমি উত্তাল জগতের মানুষ, কেন এই নিস্তরঙ্গ পুকুরে আসতে চাও?’ আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, শিক্ষকতা পেশায় বেতন কম হলেও আমার ভবিষ্যৎ উন্নতির সুযোগ থাকবে। নিজের কিছু করার পাশাপাশি সমাজের জন্যও কিছু করতে পারব। সমাজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারছি না, আমি ব্যর্থ হয়েছি এ পেশায় প্রাপ্য সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে। কাগজে, কলমে আমার মিনিমাম যোগ্যতা আছে, আমি এপ্লাই করব।’ তখন সরকারি চাকরিতে বেতন খুব কম ছিল। শুরুতে সব মিলে ১৯/২০ হাজার টাকা। শেখ হাসিনা সরকার সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়িয়েছেন ভালোই।
যদি সাংবাদিকতা পেশায় মেধা অনুযায়ী নিয়মিত প্রাপ্য মজুরি/বেতন দেয়া হয়, যদি সব সংবাদপত্রে একজন রিপোর্টার বা সাব-এডিটরকে নির্দিষ্ট সময় পরে সব পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হয় তাহলে সাংবাদিকদের অনেকে পেশা ছেড়ে চলে যেতেন বলে আমার মনে হয় না। সরকার ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা করে ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় বাস্তবায়ন করতে পারে না, বলা উচিত আন্তরিক না। পত্রিকার মালিকরাও করেন না, সিনিয়র সাংবাদিকরাও ঝামেলা এড়াতে এগুলো নিয়ে অফিসে কথা বলেন না, অনেক সম্পাদকের কাজই থাকে মালিকের মনের মত করে চলা। ফলে ওয়েজবোর্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি ঘোষণা হয়েই থাকে। সব মিলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জগতে ভয়াবহ অরাজকতা আছে। একটি এনজিওতে দিনে দুই/তিনটা প্রেস রিলিজ লিখে, পেপার কাটিং করে, মাঝে মাঝে প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করে একজন পিআরও যে বেতন পান, একজন সাংবাদিক প্রতিদিন প্রায় ১৬/১৭ ঘণ্টা পরিশ্রম করে তার অর্ধেকও পান না। কয়েকটি পত্রিকা, চ্যানেল বাদে অনেকগুলোতে নিয়মিত বেতনই হয় না, কিস্তিতে বেতন নিতে হয় সাংবাদিকদের।
ঢাকার সাংবাদিকদের এই অবস্থা, তাহলে ভাবুন মফস্বলে যারা সাংবাদিক পরিচয়ে কাজ করেন তাদের কী অবস্থা! ফলে প্রাপ্য মজুরি না পেয়ে অনেকে অসাধু উপায় অবলম্বন করে সাংবাদিক পরিচয়ের বদলে তস্কর পরিচয় অর্জন করে পেশা ও সম্প্রদায়ের মলিন মুখে চুনকালি লেপন করে যাত্রাকে অশুভ করে দেন। অনেকে আছেন আবার, যারা ভালো মজুরি পেয়েও লোভের সন্তান হয়ে বড় হতে থাকেন। এরা সমাজের বড় বড় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে মিশে, দালাল সেজে স্বীয় মজুরির বাইরে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হন। আমাদের কাছে এই অর্থ-বিত্ত বিপুল হলেও, আসলে এগুলো কিছু কালো টাকার মালিকের উচ্ছিষ্ট। সামান্য কয়েকজন দুর্নীতিবাজ বাদ দিলে এখনও এ পেশায় সৎ এবং প্রাপ্য মজুরি-সম্মান থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাই সিংহভাগ। দেশে যদি ব্যাঙের ছাতার মত সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও চ্যানেল না থাকত, তাহলে অনেক সংকট থেকে বাঁচা যেত। এত সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক আমাদের দরকার নেই। তবে হ্যাঁ, বাস্তবসম্মত ওয়েজবোর্ড মেনে চলতে পারলে, সবগুলোকেই ওয়েলকাম। এত সংকটের পরেও যারা বাংলাদেশে সততা, ব্যক্তিগত বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে সাংবাদিকতা করছেন তাদের সবাইকে আমার স্যালুট।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)