ধৈর্য, সহনশীলতা, তাকওয়া অর্জন সিয়াম সাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু এসবের বাইরেও রোজার বড় একটি উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে সহানুভূতি-সহমর্মিতার অনুপম শিক্ষা প্রদান করা। ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর যে নান্দনিক দর্শন রয়েছে, সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই মূলত এটি প্রতিচিত্রিত হয়ে থাকে। রমজান যেমন বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর রহমত বা দয়াকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি এক বান্দার প্রতি অপর বান্দার, এক মানুষের প্রতি অপর মানুষের অন্তরে মমত্ব, সহানুভূতি ও দয়ার উপলক্ষ সৃষ্টি করে। সংযম সাধনার এ মাসে ক্ষুধা ও পিপাসার প্রকৃত অনুভূতির মাধ্যমে বিত্তবান-সচ্ছল রোজাদার মানুষ দরিদ্র ও অভাবক্লিষ্ট মানুষের নিত্য অনাহার-অর্ধাহারে থাকার কষ্ট হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন। এ উপলব্ধির আবেশেই বিত্তশালী ব্যক্তি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা বোধ করেন।
রাসূলে কারীম (সা.) রমজানকে শাহরুল মুওয়াসাত তথা সহমর্মিতা-সহানুভূতির মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ সহমর্মিতার ক্ষেত্র শুধু আর্থিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পাশাপাশি অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে সর্বোত্তম বিনম্র আচরণ, সদুপদেশ প্রদান, তার জন্য প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা সবই সহমর্মিতার চর্চা ও বহিঃপ্রকাশের আওতাধীন। এ বিষয়টির অপরিহার্যতা ফুটে উঠেছে নু’মান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত সুন্দর একটি হাদিসে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ (একটি) দেহের মত।
যখন দেহের কোনো অঙ্গ পীড়িত হয়, তখন তার জন্য সারা দেহ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বোখারী : ৬০১১) আমি নিজকে যতটুকু ভালোবাসি। নিজ দেহের যত্ন যতটা নিই, পরিচর্যা করি, অবহেলা করি না— তেমনি অন্যের প্রতিও অবহেলা দেখানো যাবে না। মানুষের প্রতি দয়াশীল হতে হবে, মন উজাড় করে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। পরিপূর্ণ সহানুভূতি আর সুহৃদ্যতার দ্বারা মানবসেবায় এগিয়ে আসতে হবে।
মানবতার ধর্ম ইসলামের অনুসারী একজন মুসলিম ব্যক্তি যখন মানবসেবায় আত্মনিয়োজিত থাকেন, সে তখন তার প্রতিপালক কর্তৃক হেদায়াতের নুর বা আলোকবর্তিকা দ্বারা আবিষ্ট থাকে (সুরা যুমার, আয়াত নং- ২২)। শহরের অলি-গলি কিংবা রাস্তার ধুলোবালিতে জীবন পার করে দেওয়া অসংখ্য বস্তিবাসীর সন্তান কিংবা গৃহহীন মানুষগুলো অবহেলাপূর্ণ কী এক অনিশ্চিত গ্লানিকর সময় অতিবাহিত করে প্রত্যেহ, রমজান না এলে হয়তো তা বুঝা বড় দায় হয়ে যেত। মাহে রমজান এসে মুসলিম মিল্লাতের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। জাগ্রত করেছে মুমূর্ষ মানবিক ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে।
নতুন উন্নত পোশাক পরিধান যাদের কাছে অলিক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়, রমজানে বিত্তবান কর্তৃক সেই দরিদ্র্য শ্রেণীর মানুষদের নতুন জামা কাপড় প্রদান এক আনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যের অবতারণা ঘটায়। এই তো রমজান। এই ইসলাম। ইসলামের নিষ্কলুষ সৌন্দর্য এখানেই। যে সৌন্দর্য পবিত্র মাহে রমজানের সহমর্মিতার মোড়কে বিমূর্ত হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে, শত-সহস্রকাল ধরে। প্রতি বছর বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন কর্তৃক দুঃস্থ-অভাবীদের নিমিত্তে ইফতার ভোজনের যে সমৃদ্ধ আয়োজন আমরা অবলোকন করি, বলা চলে তা রমজানের সহমর্মিতার প্রশিক্ষনেরই বাস্তবচিত্র। আত্মিক তৃপ্তি প্রশান্তি মুলত এ সহমর্মিতা প্রকাশেই নিহিত। নবী করিম (সা.) যেমনটি বলেছেন, ‘আত্মার অভাবমুক্তিই হচ্ছে আসল অভাবমুক্তি।’ (বুখারি শরীফ)
উপলব্ধি এটুকু, মাহে রমজানের সহমর্মিতার এই শুভ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আমরা যদি বছরব্যপী অনুশীলন করি, তবেই মানবসমাজ দেখবে না কোনো রকম অসাম্য ও শ্রেণী বৈষম্য, দূরীভূত হবে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান সুকঠিন দারিদ্র্যতা, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে আমূল শান্তিময় পরিবেশে টইটুম্বুর হবে ধরিত্রী সন্দেহ নেই।
লেখক: মুফতি আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা