‘সর্বত্রই অপরাধীদের বিচরণ, পরিস্থিতি এখন বেপরোয়া।’ গাড়িবোমায় নিহত হওয়ার কিছুক্ষণ আগে মালটার জনপ্রিয় সাংবাদিক ড্যাফনি কারুয়ানা গালিজিয়া সর্বশেষ ব্লগপোস্টে এমনটি লিখেছিলেন।
গত সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে নিজের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ লেখা পোস্ট করে তিনটার দিকে বাসা থেকে নিজের গাড়িতে করে বের হন ড্যাফনি। এর কিছুক্ষণ পর গাড়িটি বিদনিজা এলাকায় আসলে হঠাৎ বিস্ফোরণ হয়।
বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিলো যে পিউগেট ১০৮ মডেলের গাড়িটির বিভিন্ন খন্ডিত অংশ ২২ মিটার দূর পর্যন্ত চলে যায়। পুলিশের তরফে এই সংবাদ স্বীকার করার আগে মালটার প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মাসকাট জানান: প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে গাড়ি বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন স্বনামধন্য সাংবাদিক। পরে প্রধানমন্ত্রী একে ‘হত্যাকাণ্ড’ অভিহিত করে একে মালটার স্বাধীন মত প্রকাশে উপর আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করা দুর্নীতির ফাঁস হওয়া নথি পানামা পেপারস নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন মালটার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাফনি কারুয়ানা গালিজিয়া। রাজনীতি বিষয়ক ওয়েবসাইট পলিটিকো’র মতে, মালটার রাজনৈতিক মঞ্চের আড়ালে থাকা দুর্নীতি উন্মোচন করে চলতি বছরে গোটা ইউরোপে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ড্যাফনি। মালটার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা ফাঁস করায় ওই ওয়েবসাইট তাকে ‘মূর্তিমান উইকিলিকস’ বলে অভিহিত করে।
ড্যাফনি কারুয়ানা গালিজিয়ার সর্বশেষ পোস্টে কী ছিল
নিজের সর্বশেষ পোস্টে তিনি লিখেন: ‘‘অপরাধী স্কেমব্রি আজ কোর্টে এসে দাবি করে সে দোষী নয়। কেইথ স্কেমব্রি হলেন প্রধানমন্ত্রীর চিফ অব স্টাফ। বিরোধী দলীয় নেতা সিমোন বাসাত্তিলের বিরুদ্ধে তিনি মানহানির দায়ে মামলা করেছেন। সিমোন সকালে কোর্টে দাড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অপরাধী স্কেমব্রিও সাক্ষ্য দিয়েছেন।
স্কেমব্রি দাবি করেন, তিনি দুর্নীতিগ্রস্থ নন, যদিও ২০১৩ সালে লেবার পার্টি নির্বাচনে জয়ের মাত্র কয়েকদিন পর পানামায় একটি গোপন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে মন্ত্রী কোনরাড মিজি এবং এগরান্টের সাথে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। নিউজিল্যান্ডে একটি টপসিক্রেট ট্রাস্ট্রের অধীনে, তাদেরকে গ্রাহক করতে পারে এমন একটি শ্যাডো ব্যাংকের খোঁজ করতে থাকেন বিশ্বজুড়ে। পরবর্তীতে নিজেদের আড়াল করে মালটায় একটি শ্যাডো ব্যাংক (নিয়ন্ত্রকের তত্ত্বাবধানের বাইরে আর্থিক মধ্যস্থতাকারী) প্রতিষ্ঠা করে তারা এই সমস্যার সমাধান করেন।
স্কেমব্রি বলেন, তার সরকারি বেতন তার জন্য অতি সামান্য। কারণ তার কোম্পানি এবং শেয়ার থেকেই তার আয় হয়। কিন্তু মালটায় তার ব্যক্তিগত ব্যবসার লাভের জন্য যেভাবে তিনি তার সরকারি প্রভাব ব্যবহার করেন তা সম্পূর্ণ একটি আলাদা দুর্নীতি/ব্যবসায় প্রভাবের ইস্যু এবং তার স্বপক্ষে এটা কোন যুক্তি নয়।
তিনি আরও বলেছেন, চিকিৎসাধীন অবস্থার কারণে তিনি গত ২ বছরের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জবাব দিতে সক্ষম নন- কিন্তু তা দুই বছরের বিষয় না। এটা কি এমন চিকিৎসাধীন অবস্থা, যখন প্রধানমন্ত্রীর চিফ অব স্টাফ মাসব্যাপি অদৃশ্য থাকেন?
আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি, খুঁজে দেখো এবং এ বিষয়ে রিপোর্ট করো। তুমি এখন সর্বত্রই অপরাধীদের দেখবে। পরিস্থিতি এখন বেপরোয়া।”
কেন তিনি হত্যার শিকার?
কারুয়ানা গালিজিয়া ভেবেছিলেন মালটার বিষয়ে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তার শত্রুদের জন্যও তাকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিলে। হয়তো তাকে নীরব করে দিতে চাওয়ার মতো ভয়ও কেউ পেয়েছিল। মালটার রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য করে আগেও লিখেছেন তিনি।
তিনি বিশ্বাস করতেন, মালটা অপরাধীদের স্বার্থের দ্বারা আটকে গেছে। একে একটি মাফিয়া দ্বীপরাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে অপরাধীরা। দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ব্যবসার নামে অর্থ পাচার, ঘুষ এবং বিচার ব্যবস্থায় ত্রুটি নিয়ে রিপোর্ট করতেন তিনি।
গত বছরে ধরে তিনি যাদের নিয়ে লেখালেখি করেছেন তাদের মধ্যে মন্ত্রী, নবনির্বাচিত বিরোধীদলীয় নেতা, মাদক পাচারকারী এবং অনুমোদন ছাড়া প্রাইভেট চিড়িয়াখানা নির্মাণের দায়ে অভিযুক্ত একজন মিলিওনিয়ার রয়েছেন।
এই নির্ভীক সাংবাদিকের স্টাইল ছিলো ভয়হীন, রসাত্মক এবং বিদ্রুপপূর্ণ। তার অনেক পোস্টই ক্ষমতাসীনদের জন্য ছিল বিব্রতকর। সরলভাবে সত্য তুলে ধরার জন্য তিনি ছিলেন মালটার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংবাদিক।
মালটার এই সাহসী সাংবাদিকের ব্লগ ‘রানিং কমেন্টারি’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেশের রাজনৈতিক মহলেও তার প্রবল প্রভাব রয়েছে। মূলত তার লেখনীর চাপেই নির্ধারিত সময়ের ৪ মাস আগে মালটায় নির্বাচন করতে বাধ্য হয় সরকার।
প্রধানমন্ত্রী ও তার স্ত্রী পানামা পেপারস দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি করেন গালিজিয়া। অবশ্য সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেন মাসকাট ও তার সহধর্মিনী। নির্বাচনেও অনায়াসে জিতে যান মাসকাট।
হত্যাকারীদের রক্ষায় ১০ কোটি টাকার ‘প্রস্তাব’
ড্যাফনির হত্যাকারীদের রক্ষা করতে এক মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ১০ কোটি টাকার ‘প্রস্তাব’ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার তিন ছেলে। ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মাসকাটের পদত্যাগ চেয়েছেন তারা। মায়ের খুনীদের বাঁচাতে মালটার নেতারা আমাদের উপরে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করেছে বলেও অভিযোগ তাদের।