চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সরকারি টাকা লোপাটের এই মহামারি রুখবে কে?

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সেট পর্দার দাম পড়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, কলেজের সরঞ্জাম কেনাকাটায় প্রায় ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে বালিশ, চাদর, কম্বল, লেপ কেনা ও ভবনে মালামাল ওঠানোর খবরও দেশজুড়ে আলোচিত হল।

থেমে নেই এসব লাগামহীন লুটপাটের ধারাবাহিকতা। নদী একটা, এলাকাও একটা কিন্তু তার তীর সংরক্ষণ ব্যয় তিন ধরনের। আর এই ব্যয় ব্যবধান ৯ থেকে ১৫ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটারে। প্রতিটি সাইনবোর্ড বানাতে ব্যয় সাড়ে ৫ লাখ টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি ১১৮ কোটি ৩০ লাখ ২৪ হাজার টাকা ব্যয়ে তীর সংরক্ষণের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।

প্রকল্পটি হলো নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সন্দ্বীপ চ্যানেলের ভাঙন থেকে মুসাপুর ক্লোজার, রেগুলেটর এবং সংলগ্ন এলাকা রক্ষার জন্য মুসাপুর রেগুলেটরের ডাইভারশন চ্যানেল ও সন্দ্বীপ চ্যানেলের বাম তীর প্রতিরক্ষা। এখানে ৪.৪ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ১.৩ কিলোমিটার রোড নির্মাণ ও কার্পেটিং খরচ ৩ কোটি ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা।

প্রকল্পের পাঁচটি সাইনবোর্ড তৈরিতে ব্যয় হবে সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। সিল ও স্ট্যাম্প খাতে ব্যয় ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পিইসির ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, গড়ে প্রতি কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে ব্যয় হবে ২২ কোটি ৯৩ লাখ ২ হাজার টাকা।

একই নদীর একই এলাকায় তীর সংরক্ষণে ব্যয় হচ্ছে তিন ধরনের। মুসাপুর রেগুলেটরের ডাইভারশন চ্যানেলের ভাটিতে ১.৩ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ২২ কোটি ৮১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এখানে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। আর একই চ্যানেলের উজান তীরে ৬০০ মিটার বা আধা কিলোমিটারের একটু বেশির জন্য ব্যয় ১১ কোটি ২২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। অন্য দিকে চ্যানেলের ভাটির বাম তীরে আড়াই কিলোমিটারের জন্য খরচ ৬৬ কোটি ৮৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা।  এখানে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ২৬ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার টাকা।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের এমন হরিলুট কেন ঘটছে দেশে? একটি টিনের দাম ধরা হচ্ছে বাজার মূল্যের তুলনায় ১০০ গুণেরও বেশি। বিশ্বে হয়তো এই টিনটিই সবচেয়ে বেশি দামে কেনা হল। খাগড়াছড়ির ৬-আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এর কিছু ঘর মেরামতের কাজে এমন অস্বাভাবিক দামে টিন কেনা হয়েছে। এতে মাত্র দুই বান টিনের দাম দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে চলছে মাথানষ্ট হওয়ার মত অস্বাভাবিক বিল ভাউচার। রাজধানীর যানজট নিরসনে ফার্মগেট থেকে সাতরাস্তা মোড় পর্যন্ত নতুন করে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে মজার বিষয় হল ফ্লাইওভারটি নির্মাণের জন্য এখানে বরাদ্দ ধরা হয়েছে মাত্র এক লাখ টাকা।

রাজউকের চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের বাজেটে এ বরাদ্দ রাখা হয়। প্রকল্পটিকে ‘অপরিকল্পিত’ ও এই বরাদ্দকে ‘উদ্ভট বরাদ্দ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, এই পরিমাণ বরাদ্দ দিয়ে ফ্লাইওভার দূরের কথা, পরিকল্পনা পর্যায়ে যে বৈঠকগুলো হয়, সেখানেই এই অর্থ ফুরিয়ে যাবে। এই ফ্লাইওভার ও বরাদ্দ সম্পর্কে কী ব্যাখ্যা দেবে রাজউক?

নির্বিঘ্নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঈদের আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটি ও শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছে একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী। বরাদ্দের এমন পুকুর চুরিতে সারাদেশই কি উত্তাল হয়ে উঠতে চলছেনা? উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মহামারিতে দিনের পর দিন ফুলেফেঁপে বড়লোক হয়ে উঠছে লুটপাটকারীরা। এক অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে চলেছে স্বদেশ। রাজধানী হয়ে উঠেছে মৃত্যুকূপ। ঢাকা হতে ঘুরে এলে কারও জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করাচ্ছে ডাক্তাররা। এই মশক নিধনের টাকাও লোপাট হয়ে গেছে লুটেরা সিন্ডিকেটে।

এমন উদ্ভট বরাদ্দ, অস্বাভাবিক বরাদ্দ ও মাথানষ্টের বরাদ্দ পৃথিবীর আর কোথায় আছে? প্রতিটা বরাদ্দকে ঘিরেই যেন সক্রিয় থাকে সিন্ডিকেট৷ ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে কাগজে কলমে প্রকল্প শুরু হয়েছে ১৪ মাস আগে, কিন্ত প্রকল্পের কোনো কাজই শুরু হয়নি। এমন কি প্রকল্পের এলাকাও নির্বাচন করা হয়নি। এরই মধ্যে ৫৭ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। মোটা অংকের এ টাকায় প্রকল্পের কর্মকর্তারা বিদেশে একাধিক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। আড়াই কোটি টাকায় পাঁচটি গাড়ি কিনেছেন এবং প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকায় আরও পাঁচটি গাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। বন ব্যবস্থাপনা ও বনাঞ্চলনির্ভর পেশাজীবীদের অন্যত্র জীবিকার সংস্থান এবং বসবাসের সমন্বয় করার জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এ প্রকল্প চালু করা হয়েছিল গত বছর জুলাইয়ে।

এ প্রকল্পের আওতায় ৬০০ গ্রামের ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে গাছ লাগানো এবং ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প শুরুর ১৪ মাস চলে গেলেও কর্মএলাকা নির্ধারণই সম্ভব হয়নি। প্রকল্প কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে ৫৭ কোটি টাকা ব্যয় করলেও প্রকল্পের কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা বলতে পারেননি৷ এই ৫৭ কোটি টাকার কি ব্যাখ্যা দেবে প্রকল্প কর্মকর্তারা?

দেশে উন্নয়ন নিয়ে যারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন তাদেরকে প্রশ্ন উন্নয়নটা কার হচ্ছে? হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বাড়ছে ধনের বৈষম্য। প্রকল্পের নামে লুন্ঠণের সুযোগে ঘটছে দুর্নীতির মহোৎসব। ৫০০০ টাকা মূল্যের বই সরকারি টাকায় কেনা হল ৮৫০০০ টাকায়। দুর্নীতি ও কমিশনের দায়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ গেল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে ছাত্রনেতাদের কমিশন নিয়ে দরকষাকষির অডিও ফাঁস হল। বাংলাদেশ কি তবে দুর্নীতির অভয়ারণ্য হয়ে উঠতে চলল?

সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল কথাটা সংক্রামক ব্যাধির মত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারি টাকায় ইবাদত বন্দেগীও কেনা হচ্ছে। সরকারি খরচে হজ করে অনেকেই আলহাজ বনে যাচ্ছেন। সরকারি টাকা লোপাটের এই মহামারি রুখবে কে?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)