সরকারের শরিক জাসদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কিছু মন্তব্যে রাজনীতির অঙ্গনে এখন আলোচনার ঝড়। শুধু জাসদ কিংবা আওয়ামী লীগের মধ্যেই যে আলোচনা চলছে এমন নয়। অন্য দলগুলোর মধ্যেও আলোচনার বিষয় সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য।
তবে, হঠাৎ করে দলের সাধারণ সম্পাদক কেন সরকারের অন্যতম শরিক জাসদকে নিয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠলেন? সেটা খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সৈয়দ আশরাফ ‘হুজুগে’ কথা বলার লোক নন। তিনি যখন কিছু বলেন, তখন বুঝতে হবে দলের উচ্চ পর্যায়ে কোন না কোন আলোচনা চলছে।
কী সেই সম্ভাব্য আলোচনা? আওয়ামী লীগ এবং জাসদতো অবশ্যই, ১৪ দলীয় জোটের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। এমনকি বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নীতি-নির্ধারকরাও বিষয়টি বুঝে উঠার চেষ্টা করছেন। বিএনপির একাধিক নেতাও চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, তারা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্তব্যের নেপথ্য বার্তা বুঝে তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করবেন।
সমালোচনায় ক্ষুব্ধ জাসদ
অবশ্য, সৈয়দ আশরাফের মন্তব্যে সাধারণভাবেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। জাসদ রাজনীতির প্রাণপুরুষ কর্নেল তাহেরের ছোটভাই অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন মঙ্গলবার এক সমাবেশে সৈয়দ আশরাফকে ‘থামাতে’ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, আপনি আপনার এই মন্ত্রীকে থামান। সংকটের এই সময়ে তিনি যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন, যে অনৈক্যের সৃষ্টি করছেন, অবিলম্বে তাঁর মুখ বন্ধ করুন।
‘আর সৈয়দ আশরাফকে বলব, আপনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দিকে মনোযোগ দিন। আপনি কীভাবে মন্ত্রিত্ব চালান আমরা জানি, দেশবাসী জানে,’ বলেও মন্তব্য করেন আনোয়ার হোসেন।
দল বিভক্ত হলেও জোটের ঐক্য নিয়ে উদ্বেগ
সমাবেশে জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাজ করছি, প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে তথ্যমন্ত্রী (জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু) যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখন এই ধরনের কাদা-ছোড়াছুড়ি ঐক্য বিনষ্ট করবে; মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে দুর্বল করবে।
নিজেদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও জাসদের অন্য অংশের নেতারাও সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। ওই অংশের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেছেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে তারা বিস্মিত।
নিজেরা দলের ঐক্য ধরে রাখতে না পারলেও জাসদের দুই অংশই সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে ১৪ দলের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে মন্তব্য করে ঐক্য অটুট রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শরিক অন্য দলগুলোও একইরকম মন্তব্য করেছে।
জাতীয় পার্টির হাততালি
তবে, সরকারের শরিক জাতীয় পার্টি সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে জাতীয় সংসদে বলেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী জাসদকে সরকার তথ্যমন্ত্রী করেছে।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, আমরা ছাত্রলীগ করতাম। একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এক বিছানা থেকে উঠে এসে উনি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। গুণে গুণে আমাদের ২০ লাখ লোককে হত্যা করল। সেদিন গণবাহিনী গঠন করে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা না করলে দেশের দুর্দিন হতো না। বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় জাতীয় নেতাকে আমরা হারাতাম না। সে জন্য জাতি আজ পর্যন্ত ভুগছে।’
তিনি বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফ যথার্থ বলেছেন। এই ইনু সাহেবরা জাসদ করে… টেলিভিশনে আপনাকে (ডেপুটি স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে) এবং সরকারি দলকে বেশি দেখায়…. কারণ হলো, তথ্যমন্ত্রী জাসদ। সংসদে ঢুকে এসব করছে।’
জাসদ প্রসঙ্গে যা বললেন খালেদা জিয়া
মঙ্গলবার বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ-এ্যাব-এর ইফতার অনুষ্ঠানে জাসদ নিয়ে কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও।
স্বাধীনতার পর দলটির ভূমিকা টেনে তিনি বলেন, ‘এই দলের (জাসদ) লোকজন তখন আওয়ামী লীগের লোকজনকে খুন করত, গুম করত। তাদের নেতার সম্পর্কে কী খারাপ ভাষায় বক্তব্য দিত, খারাপ ভাষা ব্যবহার করত, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করত।’
কী বলেছিলেন সৈয়দ আশরাফ
সোমবার ছাত্রলীগের এক বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাসদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক–বাহকেরা শতভাগ ভণ্ড মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের একটা অংশ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নিয়ে আসে। এর ধারক-বাহকেরা দেশটাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। পরে জাসদ নামে নতুন দল গঠন করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে সৈয়দ আশরাফ বলেন, তারা সফল মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই দেশকে ছিন্ন-ভিন্ন করার চেষ্টা করেছিল। তারা যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সমস্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করত, তাহলে আজ বাংলাদেশ ভিন্ন বাংলাদেশ হতে পারত।
এমনকি ইতিহাস জেনে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ওই হঠকারীদের (জাসদকে) এড়িয়ে চলার পরামর্শও দেন তিনি। জাসদের বর্তমান অবস্থাকে দৈন্যদশা হিসেবে উল্লেখ করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, তারা অতি বিপ্লবী ছিল। তারা অনেক প্রতিক্রিয়াশীলও ছিল। একসময় তারা হারিয়ে গেল এবং এখন আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করছে।