বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের মূল প্লাটফর্মে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। তবে সমাজে সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে বেড়ে উঠতে হলে নিজেদের কেউ সামজিক হতে হবে, ঘোচাতে হবে সমাজের সঙ্গে দূরত্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য বিশেষ স্কুল তৈরির মাধ্যমে তাদের শিক্ষা ও সামাজিকতা বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। সরকারের বাজেটে তাদের জন্য যে খাত রয়েছে সেটাও বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়াও পারস্পারিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, মমত্ববোধের সমাজের মানুষের সঙ্গে একটা সেতু বন্ধন তৈরি করতে হবে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে তারকা চিহ্নিত এক প্রশ্নের জবাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য তাদের যেসব ট্রেডে ৫০ দিনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে পুনর্বাসনের জন্য তাদের ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সমাজের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের দূরত্ব ঘোচাতে হলে আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে যা আমরা নেই নি। সমাজের মানুষের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের যে তাচ্ছিল্য মনোভাব রয়েছে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। সঠিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানে এনে অর্থনৈতিক সক্ষমতাও অর্জন করাতে হবে। এছাড়াও বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে সেটাও তুলনামূলক কম, বরাদ্দটাকেও বৃদ্ধি করতে হবে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রধান ডা. মোহিত কামাল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের মানুষের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের দূরত্ব ঘোচান সম্ভব। বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সমাজের কিভাবে মেলামেশা করাসহ বিভিন্ন আচার ব্যবহার শেখানো হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ইতিমধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। বর্তমান সরকার যেভাবে নারী শিক্ষাকে অগ্রগতি দিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলে তারা সমাজের অন্যান্যদের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
ডা. মোহিত কামালের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বর্তমান সরকার সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নে যে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে ঠিক সে ভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজে স্থান দিতে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই উল্লেখ করে ড. তানিয়া বলেন: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্র তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের গ্রহন করবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে সেই সনদ দিয়ে কর্মক্ষেত্রেও নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
‘প্রাকৃতিক বিষয়ে আমাদের কারো হাত নেই, একটা তৃতীয় লিঙ্গের শিশু জন্মানোর পর সমাজ তাকে গ্রহন করে না সব দায়ভার গিয়ে পরে পরিবারের কাছে।কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের গ্রহন করতে পারবে।’
তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের চিন্তা করতে হবে।পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রয়াসেই তাদের সঙ্গে দুরত্ব ঘোচান সম্ভব।
এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গ শিশু জন্মানোর পর রাষ্টের ভূমিকা কি থাকবে সেটা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
কতটা সামাজিক হতে পারবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা:
সমাজে সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে বেড়ে উঠতে হলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিজেদেরও সমাজে সামাজিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। জানতে হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা।
বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক আনিসুল ইসলাম হিরু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমরা যারা সমাজের মধ্যে রয়েছি, আমাদের উচিত হবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য জায়গা করে দেওয়া।
আমরা যদি তাদের জায়গা না দেই তাহলে সামাজিকভাবে কিংবা অর্থনৈতিকভাবে কখনোই উন্নত হতে পারবে না।
সমাজের অন্যান্য মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হলে কিছু শিক্ষার বিষয়ও রয়েছে বলে মনে করেন হিরু।
তিনি বলেন: সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে আমরা সবসময়ই তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সেমিনারের ব্যবস্থা করি, এতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারে।
সাধারণ মানুষ ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অভিযোগের পাহাড় দুদিক থেকেই সমান জানিয়ে মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী এইচ এ ববি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা যেভাবে চলে সেটা হলো তাদের গুরু পরম্পরা জীবনযাপন, আর অন্যরা চলে সামাজিক জীবনে, কিন্তু সরাসরি কিংবা অসরাসরি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সমাজেরই একটা অংশ।
আমরা যারা সমাজে বাস করি তারা ভুলে যাই যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সমাজেরই অংশ। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও মনে করে তারা সমাজ বহি:ভূত।
রাষ্ট্রের উচিত হবে সমাজের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, মমত্ববোধ, বিশ্বাস দিয়ে একটা সমতার বন্ধন তৈরি করা।
মানবাধিকার কর্মী ববি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে অনেক শিল্পী, লেখক, মেকাপ আর্টিস্ট, হস্তশিল্প, রাধুনি ও কোরিওগ্রাফার রয়েছে। তাদের মধ্যে শুধু নেই মা, তারা মা হতে পারে না, এইটুকু ছাড়া অনেক গুণের গুণেই তারা গুণান্বিত।
সরকার যদি সত্যিকার সমাজের মূলস্তরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আনতে উদ্যোগ নেয় তাহলে প্রথমে তাদের নথিভুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের প্রত্যেককে আইডি কার্ড করে দিতে হবে।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে সরকারের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে জানিয়ে সম্পর্কের নয়াসেতু সংগঠনের সভাপতি জয়া শিকদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমাদের সঠিক লিঙ্গীয় পরিচয় নেই, সমাজে আমরা তাচ্ছিল্যের শিকার। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের পরিচয় ‘টান্সজেন্ডার, আমরা দেশে সেটাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি না। সমাজে ভূমিকা রাখতে লিঙ্গীয় পরিচয় দরকার। সরকার যদি আমাদের মানুষ হিসেবে দেখে তাহলে আমরা সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারব।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের দৃষ্টান্ত জামালপুর জেলা:
জামালপুর জেলার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ‘সিঁড়ি সমাজ-কল্যাণ সংস্থা’সংগঠনটি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তারা মানুষের সঙ্গে ঘুচিয়েছে দুরত্বও।
নিজেদের কষ্টের উপার্জিত টাকা দিয়ে সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজে জেলা প্রশাসক সহ সবাইকেই পাশে পাচ্ছে সংগঠনটি। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীর্তাত মানুষের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করাসহ সম্প্রতি ঈদুল আযহায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট থেকে পাওয়া কোরবানির পশুর মাংস দরিদ্র ও দুঃস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছে তারা।
সমাজের মানুষের সঙ্গে কতোটুকু দুরত্ব ঘুচিয়েছে জানতে চাইলে জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: তৃতীয় লিঙ্গ মানুষ বলে আমরা কখনোই তাদের দূরে সরিয়ে রাখি নি, যেটা আমাদের সমাজের অনেকেই করে। লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হওয়ায় তারা যে মানুষ না সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
তাদের অন্য সব মানুষদের মতোই সমাজে হাসি খুশী ভাবে জীবনযাপনের অধিকার আছে। তাই আমরা সব সময়ই ‘সিঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা’কে সহায়তা করছি।
আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরীর নেতৃত্বে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা জামালপুর জেলায় সামজিক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তাদের আর সামজিকভাবে দূরে সরিয়ে রাখার কোন কারণ নেই।