ফুটবল খেলার উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। বিভিন্ন নামে এই খেলাটি প্রাচীন মিশর, পারস্য, ব্যবিলন, গ্রিস ও চীনে প্রচলিত ছিল। তবে আধুনিক ফুটবলের বিকাশ ঘটেছে ইংল্যান্ডে। মধ্যযুগের শেষের দিকে ইংরেজ ক্রীড়াবিদ জে.সি, থ্রিং এই খেলার প্রথম নিয়ম তৈরি করেন। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে আইন করা হয় যে, প্রত্যেক দলে গোলরক্ষকসহ ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকবে। এই আইন অনুসারে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মার্চ ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের মধ্যে প্রথম খেলা হয়। তবে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে নতুন নিয়মে আবার স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হয়। এটি ছিল ফিফা স্বীকৃত প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে ফুটবল খেলা দুই শতাধিক দেশের ২৫০ মিলিয়নেরও অধিক খেলোয়াড় খেলে থাকেন। এর ফলে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও প্রচলিত খেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ফুটবল।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই তৎকালীন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন তথা বাফুফে প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে তিনিই ছিলেন বাফুফের প্রথম সভাপতি। দুই বছর পর ১৯৭৪ সাল থেকেই এটি এএফসি ও ফিফার সদস্যপদ লাভ করে। বর্তমানে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। এই সংস্থাটিই বাংলাদেশের পুরুষ ও মহিলা জাতীয় দল এবং যুব দলের দেখভাল করে, সাথে দেশের ফুটবলের যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণও করে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ঢাকা ফুটবল লীগ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রিমিয়ার লীগ, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগ এবং বয়সভিত্তিক পাইওনিয়ার ফুটবল লীগ নামে কয়েকটি ধাপে ফুটবল লীগ চালু রয়েছে।
এছাড়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ন্ত্রণের জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ’। এটি ক্রীড়া ক্ষেত্রের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণকারী সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, যার রয়েছে প্রায় ৪৫টি স্বীকৃত ক্রীড়া ফেডারেশন বা সংস্থা। এসব পরিষদের কাজ হচ্ছে দেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রীড়াঙ্গনকে সমুন্নত রাখা এবং সুস্থ ও মাদকমুক্ত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ক্রীড়া কার্যক্রমের মান বৃদ্ধি ও প্রসারের সাথে ক্রীড়া অবকাঠামো উন্নয়নে ক্রীড়া ফেডারেশন গুলোকে যথাযথ অনুদান এবং উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
সারাবিশ্বের মত ফুটবল বাংলাদেশেও অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফুটবল যখন মাঠে গড়ায় তখন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা সমর্থকের নামে দেশের জনগণ দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করা অন্যান্য দেশের সমর্থকও রয়েছে ছোট পরিসরে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দক্ষ নেতৃত্ব ও পরিছন্ন পরিকল্পনার অভাবে ১৬ কোটির উপরে বসবাস করা মানুষের দেশ বাংলাদেশ ‘ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে’ ১৯৬ নম্বর অবস্থানে রয়েছে, যা অত্যান্ত লজ্জাকর।
অথচ মাত্র সাড়ে তিন লাখ মানুষের বসবাস করা আইসল্যান্ড এবার বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশ গ্রহণ করে চমক সৃষ্টি করছে। এই সাড়ে তিন লাখ মানুষের মধ্যে আবার অর্ধেকই নারী। আরো পরিস্কার করে বললে, মাত্র দেড় লাখ পুরুষ মানুষের বসবাস করা একটি দেশ বিশ্বকাপের মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, যা ঢাকা সিটির প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে বসবাস করা পুরুষের সমান!
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অসাংগঠনিক, অদক্ষতা আর অনাগ্রহের কারণে এত জনপ্রিয়তা থাকার পরেও বাংলাদেশ ফুটবল আজ বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের তলানীতে এসে ঠেকেছে। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠক নন। তারা খ্যাতিমান ফুটবলার, রাজনীতিবিদ অথবা ব্যবসায়ী। এ কারণে ফুটবল নিয়ে তাদের আকাশ-কুসুম পরিকল্পনাগুলো অর্থের অভাবে বার বার মুখ থুবরে পড়ছে! অর্থনৈতিক সংকটে ভোগা ফুটবল ফেডারেশন যদি তাদের ফুটবলার তৈরির কর্মসূচিগুলো এক কোটি লোকের বেশি বসবাস করা রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীক করে নিতো, আর মোট অংকের অর্থ ব্যয় করে জাতীয় দলের প্রশিক্ষক হিসেবে বিদেশী প্রভাবশালী প্রশিক্ষক আনা থেকে বিরত থাকতো, তাহলেই সম্ভব হতো দেশীয় ফুটবলকে উন্নত করা।
সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে বললে বিষয়টা এমন যে,
এক. ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১০টি করে ২০টি মাঠ তৈরি করা (স্টেডিয়াম নয়, ৩০/৪০ শতাংশ খেলা উপযোগী খালি জায়গা যা সিটি কর্পোরেশন সহজেই করে দিতে পারে।
দুই. ঢাকা পাইওনিয়ার ফুটবল লীগ থেকে একশত জন ফুটবলার নিয়ে ইউরোপের কোন দেশ থেকে অল্প বেতনে তৃতীয় শ্রেণীর প্রশিক্ষক দিয়ে বছরব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তাহলেই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা এবং দশ বছরের মধ্যে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী ফুটবল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবে এবং এতে কোন সন্দেহ নাই।
আর বর্তমানে যা হচ্ছে, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বিদেশী প্রভাবশালী প্রশিক্ষক এনে জাতীয় দলকে প্রশিক্ষণ দেয়াতে ফুটবলাররা ঐ প্রশিক্ষকের ফুটবলের ভাষাই বুঝতে পারছেন না। যেমন, অ আ না শিখিয়ে একটি বাচ্চাকে দশম শ্রেণির বই পড়তে দিলে যা হবে, তাই হচ্ছে জাতীয় দলের খেলোয়ারদের সাথে।
দীর্ঘদিন ইউরোপ ফুটবলের প্রভাবশালী দেশে বসবাস করে এবং ঢাকায় ‘‘জুরাইন ফুটবল একাডেমী” নামে পাইওনিয়ার ফুটবল লীগের একটি দল পরিচালনা করতে গিয়ে দুই অঞ্চলের ফুটবলের উন্নতির পাথর্ক্যটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ এবং অভিজ্ঞার আলোকে বিষয়টা বেশ ভালভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছি। বয়সভিত্তিক পাইওনিয়ার ফুটবল লীগ থেকেই ধাপে ধাপে দেশের মূলধার ফুটবলার তৈরি করতে হয়। এ বয়সী ফুটবলারদের ফিটনেস ঘাটতি সহ ফুটবল সেন্স বা ফুটবলের উপর সাধারণ জ্ঞান থাকে না বললেই চলে। এদিকে খেয়াল না দিয়ে শুধু শুধু বিদেশী প্রশিক্ষকের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই জাতীয় দলের ফলাফলে বার বার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অন্যতম একটি কর্মসূচি হলো সুস্থ ও মাদকমুক্ত জাতি গড়ে তোলা। অথচ একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যদিও সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি হওয়ারই সম্ভবনা বেশি। মাদকাসক্তি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হওয়ায় কঠোর আইন প্রয়োগ করেও মাদক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। তাই বাধ্য হয়েই ক্রসফায়ারের মাধ্যমে এর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ যদি তাদের অন্যতম কর্মসূচি “সুস্থ ও মাদকমুক্ত জাতি গড়ে তোলার” কার্যক্রমকে সঠিক পন্থায় পরিচালিত করতো, তাহলে জাতিকে আজ মাদকনিয়ন্ত্রণে ক্রসফায়ারের আশ্রয় নিতে হতো না।
সুশিক্ষার পাশাপাশি একমাত্র খেলাধুলাই পারে একটি জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতে। সমাজে খেলাধুলার প্রসার ঘটলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও জাতি মুক্তি পায়। ইউরোপের বিশাল কর্মক্ষেত্র তৈরিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে খেলাধুলাকে পেশাদায়িত্বের মধ্যে নিয়ে আসার কারণে। এক্ষেত্রে মিডিয়াও ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু ভিনদেশী নেইমার আর মেসির রঙ্গীন ছবিই নয়, পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে হ্যাটট্রিক করা ফুটবলারদের ছবিও প্রচার করুন। তাতে ওই ক্ষুদে খেলোয়াড়টি ও তার পরিবার উৎসাহিত হবে। আপনাদের নিঃস্বার্থ প্রচারণাই গড়ে তুলতে পারে একটি বেকারত্বহীন, মাদকমুক্ত ক্রীড়াপ্রেমী সোনার বাংলাদেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)