সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে মিয়ানমার।
এই সমঝোতা স্মারকে দু’পক্ষ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ‘স্বাধীন, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরির লক্ষ্যে সহযোগিতামূলক কাঠামো প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার’ করেছে।
এই স্মারক চুক্তিকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের বসবাস ও মানবিকতা বিষয়ক সমন্বয়ক নুট অস্টবি।
‘অনেকগুলো কাজ করতে হবে এখানে। একে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই,’ বলেন তিনি।
‘আমাদের যে শুধু ৭ লাখের মতো মানুষকে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে তা নয়, তাদের প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত অবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। এখানে সমাজে তাদের পরিচয়, নিরাপত্তা এবং পাশাপাশি কর্মসংস্থান, জীবিকা নির্বাহ, বাসস্থান ও অবকাঠামোর মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।’
বাংলাদেশের হিসাবে অবশ্য আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের কাছাকাছি।
গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ও নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের দাবি ছিল, পরিচয় সনাক্তকারী কাগজপত্র দেখিয়ে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেই তারা তাদের ফেরত নেবে। অথচ সেই কাগজপত্র অধিকাংশ রোহিঙ্গারই পাবার অধিকার ছিল না নিজ দেশে।
এটা ছাড়াও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভয়, আন্তর্জাতিক নজরদারি ছাড়া মিয়ানমারে ফিরে গেলে সেখানে তাদের জীবন আবারও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা ছাড়া দেশে ফিরতে নারাজ তারা।
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত বহু মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনইউচসিআর-এর তথ্য অনুসারে, ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সহিংসতায় হাজার খানেকের বেশি রোহিঙ্গা মারা গেছে। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি, সংখ্যাটি মাত্র ৪শ’।
তবে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সহায়তা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্তিয়েরস – এমএসএফ)-এর দাবি, ২৫ আগস্ট সহিংসতা ছড়ানোর পরবর্তী একমাসেই প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।
প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর জরিপ চালিয়ে এই আনুমানিক হিসেবের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে একে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধন কর্মসূচি’ বলে বর্ণনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।