চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সভ্যতা হাতছানি দিয়ে ডাকছে

“জানালা খুলে দাও দরজা খুলে দাও
কে দোলায় কালো কালো রঙিন পর্দা
পর্দা তুলে দাও দ্বন্দ্ব-সন্দেহ আর ভয়ের
ভূতটাকে রেখো না পাহাড়ায় আমার দরজায়।”
– কবি আহসান হাবীব

এইতো কিছুদিন আগেও দেখলাম (ঢাকা-বিরিশিরি) বাসের গায়ে আঁকা পর্দানশীন নারীর ছবি। যে কিনা পর্দা একটুখানি ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিচ্ছে। এমনটি কী নারীকে পিছিয়ে রাখার অভিসন্ধি? নাকি বাইরের আলোয় অবগাহনের প্রত্যাশা? কবি আহসান হাবীবের লেখা উল্লিখিত কবিতায় কুসংস্কারের সম্পূর্ণ অন্ধকারকে দূরীভূত করার কাঙ্ক্ষিত নির্দেশনা। যা হোক, সমাজের কালো পর্দা ভেদ করে মিসেস গুলতেকিন খান একাই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। সংগ্রাম হয়ত তাঁকে করতে হয়েছে পরিবারের দায় ভার বহন করতে যেয়ে। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে তাঁকে সামাজিক আন্দোলনে নামতে হয় নি।

ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পঁচিশ বছর বয়সে চল্লিশ বছরের বিধবা নারী হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ) -র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অপর দিকে হযরত আয়েশা (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর পরলোক গমনে বাইশ বছর বয়সে বিধবা হন। ধর্মীয় কর্তব্য পালনে এবং অন্যান্য দিক থেকে উভয়েই সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তারুণ্যে পদার্পণের শুরুতেই বিধবা হন। অপরদিকে কবি সুফিয়া কামাল যিনি ‘জননী সাহসিকা’ অল্প বয়সে বিধবা হয়ে জীবন সঙ্গী বেছে নেন। দুজনেই নারীমুক্তির আন্দোলনে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আবার মাদার তেরেসা সমগ্র জীবন কাটিয়েছেন সঙ্গীবিহীন। ইঁনাদের বৈবাহিক জীবন, দাম্পত্য জীবন কিংবা নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে (ব্যক্তিজীবন নিয়ে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না) কোনো বাঁধা-বিপত্তি নেই। এই মহীয়সী নারীদের মহৎ কর্মের ফলেই আজকের নারী মুক্ত আলোয় উদ্ভাসিত হতে শিখেছে।

শুধু কী নারীরাই স্বজাতির মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন! না, মধ্যযুগে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পুরুষের হাত হয়ে উঠেছিল প্রসারিত। ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর উপর অর্পিত কঠোর প্রথাকে পদ-দলিত করেছেন সমাজ সংস্কারক রাজা রাম মোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ অনেকেই। সহ-মরণ বা সতীদাহ প্রথা; স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকেও চিতার আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে মরতে হয়েছে। কতই না ভয়ঙ্কর আর হৃদয় বিদারক ঘটনা।

সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর শুরু হয় বারো-চৌদ্দ বছরের বালিকা বা কিশোরীর বৈধব্য জীবন। সমাজ সংস্কারকদের আন্দোলনের মুখে বিধবা বিবাহ প্রথা আইন পাশ হলেও সামাজিক ব্যাধিগ্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে নিষ্প্রভ করা বড়ই কঠিন কাজ।

তৎকালীন সমাজে সাত/আট বছর বয়সের কন্যা শিশুকে বিবাহ নামক শৃঙ্খলে বাঁধা হতো। সমাজ সংস্কারকেরা বাল্য বিবাহ রোধেও সোচ্চার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ নামক ছোট গল্পে জানা যায়- নববধূ হৈমন্তীকে পড়শিরা দেখতে এসে বলে ‘নাতবৌ দেখি আমাদেরও বয়সে হার মানাবে।’ হৈমন্তীর শাশুড়ি মিথ্যে আশ্রয় নিয়ে বলেন – পুত্রবধূর বয়স বার বছর। তখন, প্রকৃতির বিরাভরণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা স্বশিক্ষিত হৈমন্তী দৃঢ়তার সাথে বলে – আমার বয়স সতের বছর।

তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় ‘হৈমন্তী’ গল্পে সতেরো বছর বয়সের মেয়েকে আইবুড়ো ভাবা হয়েছে এবং যৌতুকের লালসায় হৈমন্তীর সাথে শিক্ষিত যুবক অপূর্ব-র বিয়ে দেওয়া হয়।

গল্প কিংবা উপন্যাস থেকে, অতীত থেকে, ইতিহাস থেকে যা জানা যায় তার চাইতে অধিক জানা যায় চারপাশের সৃষ্ট ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে। একটি বাস্তব ঘটনা – মেয়েটির বয়স বাইশ (১৯৭০) বছর, তিন সন্তানের জননী। ১৯৯২ সাল। মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক মেয়েটির স্বামী নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর (কে বা কারা হত্যা করে বিল ডাকা নিয়ে) ২২ নভেম্বর ১৯৯২ তারিখে পানিতে কচুরি পানার নিচে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। তিন দিনের কুলখানির পর মেয়েটিকেসহ মিছিল হয়। মিছিলের এক ফাকে ফুড়ুৎ করে স্টুডিওতে ঢুকে একটা ছবি তুলে তরুণী মেয়েটি, নিতান্ত শখের বসে। কারণ, বাড়ির বাইরে আসতে পারার সুযোগটা সে কাজে লাগিয়েছে (পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব স্বামীর সংসারে মেয়েটা ছিল বন্দী)।

চল্লিশ দিন পর সাদা শাড়ি পরে বাপের বাড়ি আসে। কয়েক দিনের মধ্যে একটা টকটকে লাল শাড়ি কিনে পরতে থাকে। অতঃপর মামলার বাদী হয়ে বাইরে যাওয়া-আসা করতো। তখন এক তরুণ উকিলের সাথে বিয়ে হয় তরুণীর। পাড়া পড়শির নিন্দা আর সমালোচনার প্রতিবাদ জানিয়ে সে বলে – ‘খেলার বয়সে বিয়া হইসে আর বিয়ার বয়সে বিধবা হইছি…’। নিজ চোখে দেখলাম দুর্বিসহ সংগ্রাম করেছে মেয়েটি। এইসব জীবনের করুণ কাহিনী শরৎচন্দ্রের উপন্যাসকেও হার মানায়।

সমালোচক প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী (বীরবল ছদ্মনামে) তাঁর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না’। তিনি প্রকৃত যৌবনকে তথা মানসিক যৌবনকে সামাজে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেছেন। জাতিকে সমৃদ্ধশালী করতে মানসিক যৌবনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। মানসিক যৌবনের শক্তিতেই একজন রাষ্ট্রপতি বা বিচারপতি উচ্চপর্যায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

তেমনিভাবেই আমরা দেখতে পাচ্ছি গুলতেকিন খান বৃদ্ধাশ্রমের স্বপ্ন না দেখে, সমাজের ঠাট্টা-বিদ্রূপের তোয়াক্কা না করে, জীবন-যাপনের প্রয়োজনের সঙ্গী বেছে নিয়েছেন। তবে কেউ কেউ কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন গুলতেকিনের সঙ্গীর প্রতি। যেন সর্বস্ব ত্যাগ করে তিনি গুলতেকিনকে উদ্ধার করেছেন। মূলত তাঁহার প্রয়োজন ছিল একজন সঙ্গী।

বিয়ে বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষরিত একটি সনদ মাত্র। সমাজের প্রতিটা মানুষেরই রয়েছে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, রুচিবোধ, আছে পছন্দ-অপছন্দের মুক্ত চিন্তা। আর এখানের হচ্ছে (‘মুক্তির স্বাদ’ শঙ্কর -এর লেখা একটি বই) মুক্তির স্বাদ। জীবনের এই মুক্তির স্বাদকে অবমাননা করে এক ধরনের বর্বরেরা বিয়ের নামে অরুচিশীলতায় লিপ্ত হয়ে অন্ধকারের কালো পর্দায় আবর্তিত। সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বহুদূর থেকে আলোক বর্তিকা নিয়ে সভ্যতা হাত ছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে গ্রহণ করো!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)