আমদানি শুল্ক মওকুফ, ঋণের সুদ কমানো, জরুরি ভিত্তিতে বিমানে আমদানি করাসহ বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিলেও পেঁয়াজের দামের নাগাল টানতে পারেনি সরকার। এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধানে ৩০ টাকা কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়ে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝে ৩ থেকে ৪ দিনের জন্য ৪০ থেকে ৫০ টাকা কমে এখন আবারো বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়।
রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুলসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি পেঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। আমদানি করা মিয়ানমারের পেঁয়াজ ২শ’, চায়না পেঁয়াজ ১৪০ থেকে ১৫০, মিশরীয় ও তুরস্কের পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। তবে মিয়ানমারের ভাল মানের পেঁয়াজ বাজারে দেশি পেঁয়াজ বলে বিক্রি করা হচ্ছে এমন অভিযোগও করছেন ক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের জীবন ফার্মেসীর হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: গতকাল শনিবার শুধু স্বাদ টেস্ট করার জন্য ৬শ গ্রাম চায়না পেঁয়াজ কিনেছি ৬০ টাকা দিয়ে। অর্থাৎ কেজি পড়েছে ১শ’ টাকা। কিন্তু আজ (রোববার) সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়।
তিনি বলেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের ভাল মানের পেঁয়াজগুলো দেশি বলে চালিয়ে দেয়।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের আড়ৎদার কামাল হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: যে হারে দাম বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ পেঁয়াজ একটা কাঁচামাল। বাজারে পরিমাণে যখন বেশি থাকে তখন দাম কম থাকে। পরিমাণে কম থাকলে দামও বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজ তো চাল নয়, যে প্রতিদিন না খেলে বাঁচবে না। দাম কমানোর একমাত্র উপায় হলো খাওয়া কমিয়ে দেয়া। এবং এটা করা দরকার।’
শ্যামবাজার পেঁয়াজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ মাজেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এই মুহূর্তে শ্যামবাজারে কোনো আড়তে পেঁয়াজ নেই। কেন নেই? এর জবাবে তিনি বলেন: বিমানে আনা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু জাহাজে আসতে ২ থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। এ কারণে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে না।
শ্যামবাজারের আরো কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বললে তারা পেঁয়াজের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান।
বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও। শনিবার রাজধানীতে এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন: আমাদের ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এই ২৫ শতাংশের ৯০ ভাগ আসে ভারত থেকে। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরে প্রতিমাসে আমাদের ১ লাখ টন করে আমদানি হত। সেখানে সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৫ হাজার টন, ৭৫ হাজার টন ঘাটতি থাকল। অক্টোবরে ২৪ হাজার টন এসেছে, সেখানেও ৭৬ হাজার টন ঘাটতি।
বাণিজ্য মন্ত্রীর এই বক্তব্যের আলোকে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন: আগেই সরবরাহ নিশ্চিত করা উচিত ছিল।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সরবরাহে ঘাটতি থাকায় দাম বাড়তি। এই সরবরাহ আগেই নিশ্চিত করা দরকার ছিল। তবে এই সংকটের সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করেছে। ভোক্তাদের পকেট কেটেছে।
গোলাম রহমান বলেন, মনে হয় বাজারে নতুন পেঁয়াজ না আসা পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু যারা অবৈধ উপায়ে মজুদ রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত।
সরবরাহ ঘাটতির কারণে দাম বাড়লেও এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করেছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এখন কী পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে তা জনগণকে জানাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের উচিত ব্যবসায়ীরা কখন, কত টাকা মূল্যে কত টন পেঁয়াজের এলসি খুলেছে, কী পরিমাণ আসছে, তার বিস্তারিত জন সম্মুখে তুলে ধরা। এতে আমদানি মূল্যের সাথে বিক্রয় মূল্যের যে বড় পার্থক্য এবং ব্যবসায়ীরা যে অতি মুনাফা করছে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
“যতদূর জানি সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার টন পেঁয়াজ আনা হয়েছে। যা পরিমাণে খুব কম। কারণ দৈনিক চাহিদা ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টন। তবে সরকারের মাধ্যমে কমপক্ষে এক লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করলে বাজারে এত বড় ঘাটতি দেখা দিতো না।”
গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এখন আমদানি আরো বাড়িয়ে টিসিবির মাধ্যমে সারাদেশে আরো বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ বিক্রি করা দরকার।
দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ প্রতিদিন বাজারে অভিযান করছে। তবে রোববার কারওয়ান বাজারে অভিযান করতে আসলে কোনো ব্যবসাযী দোকান বন্ধ করে রাখতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, অভিযান করলে অনেক টাকা জরিমানা করা হয়। ওই টাকা তুলতে গিয়ে দাম বাড়াতে হয়। তাই দোকান বন্ধ রাখা হয়।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় বড় ধরনের সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বিকল্প দেশ হিসাবে মিয়ানমার, মিশর, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু জলপথে জাহাজে এসব পেঁয়াজ আসতে প্রায় এক মাস লেগে যায়। এতে বাজারে পেঁয়াজের চরম ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়ে ২৫০ টাকা দরে কেজি বিক্রি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত সংকট মেটাতে উড়োজাহাজে পেঁয়াজ আানার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর কয়েকটি গ্রুপ অব কোম্পানি বিমানে পেঁয়াজ আনা শুরু করে। এসব পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করে গত বৃহস্পতিবার থেকে।
এরপর দাম স্থিতিশীল রাখতে আকাশপথে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য চার্জ মওকুফ করার ঘোষণা দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। আকাশপথে যেকোনো পচনশীল দ্রব্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে ১৮ টাকা চার্জ প্রদান করতে হয়। এছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানিতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাধারণত পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যাংকভেদে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ কাটা হয়। এত উদ্যোগের পরও কমেনি দাম।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বোর্ডের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। যা দেশের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৭ থেকে ১১ লাখ টন আমদানি করা হয়। তবে এর ৯৫ শতাংশই আমদানি করা হয় ভারত থেকে। বাকি ৫ শতাংশ আসে মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিশর থেকে।