প্রবাসীদের আয় (রেমিটেন্স) বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক বড় অবদানকারী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে, এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রবাসী আয়ও। ১৯৭৪-১৯৭৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১১.৮ মিলিয়র মার্কিন ডলার। সেই অবস্থা থেকে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হঠাৎ প্রবাসী আয় ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় পিলার বলা হয় এই প্রবাসী আয়কে। বাংলদেশের প্রবাসী আয়ের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকাতেও বাংলাদেশের শ্রমিক পাঠানো হয়। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপত নির্ধারিত হয়। প্রবাসীদের এই অর্থ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রশংসনীয়ভাবে ভূমিকা রাখছে। আমরা যদি অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় এককভাবে প্রবাসী আয় অর্থনীতির গতিপত নির্ধারণ করে।
আর প্রবাসী আয়ের উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে সন্দ্বীপের প্রবাসীদের। সন্দ্বীপের বর্তমান চিত্রটা এমন যে এখানে প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন করে এমনকি একই পরিবারের পাঁচজন উপার্জনকারী ব্যক্তির সবাই প্রবাসী। সন্দ্বীপ প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ মোট প্রবাসী আয়ের এক-দশমাংশ। কারো কারো হিসাব মতে এই আয়ের পরিমান আরো বেশি। নানান দিক থেকে সন্দ্বীপ একটি অবহেলিত উপজেলা হিসেবে স্বীকৃত। যদিও সন্দ্বীপ জাতীয় সংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। প্রতিবার এখানে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকে।
সম্প্রতি সন্দ্বীপের কিছুটা উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। কিন্তু মানের, গুণের এবং টেকসইয়ের দিক দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সন্দ্বীপের মানুষের কষ্টে অর্জিত অর্থ শুধুমাত্র যে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রেখে চলছে তাই না। বরং এই প্রবাসী আয় সন্দ্বীপের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে অবদান রেখে চলছে।
সন্দ্বীপে প্রবাসীদের এই উপার্জিত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে দারিদ্রতা দূরীকরণে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, জীবনমান উন্নয়নে। গত দুই দশকে দেশের দারিদ্রতা দূর হয়েছে প্রায় ২০%। এই দারিদ্রতা দূরীকরণে সন্দ্বীপের প্রবাসী আয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সন্দ্বীপে এখন আর কোন মানুষকে রাস্তায় মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায় না। সবাই উন্নতমানের টয়লেট নির্মাণের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্বির ফলে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, আজ থেকে এক দশক আগেও দেখা যেত খুব কম পরিবার ছিল যাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য একটা নুন্যতম বাজেট রাখতে পারতো, কিন্তু বর্তমান চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত।
বর্তমানে এমন কোন প্রবাসী পরিবার নেই যারা তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বাসায় একজন করে শিক্ষক রাখেন নাই। এটি সম্ভব হয়েছে প্রবাসী আয় বৃদ্বির সাথে সাথে শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বৃ্দ্ধির ফলে। এবং শিক্ষায় বিনিয়োগের ফলে এর ফল আসতে শুরু করেছে। এখন প্রতিটি ঘরে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।তারা সচেতন হচ্ছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নেতৃত্ব দেবে।
প্রবাসী আয় সন্দ্বীপের স্বাস্থ্যমান উন্নয়নে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখে চলছে। এক দশক আগে যেখানে দেখা যেত টাকার অভাবে সন্দ্বীপের মানুষ আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল, বর্তমান চিত্রটা ভিন্ন। কারণ এখন আর কেউ টাকার অভাবে চিকিৎসা বঞ্চিত হয় না।
এমনকি চিকিৎসার জন্য সন্দ্বীপের মানুষজনকে ভারত এবং সিঙ্গাপুরে যেতে দেখা যায়। এটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সন্দ্বীপের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে।সন্দ্বীপের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা যে কত বেশি তা উপলব্ধি করতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। সন্দ্বীপে যে কয়টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক আছে তাদের আমানতের বেশির ভাগ হচ্ছে সন্দ্বীপ প্রবাসীদের উপার্জিত টাকা। এমনকি ব্যাংকে গ্রাহকদের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছে প্রবাসীদের আত্বীয়স্বজন, স্ত্রী, কন্যা, মা, ভাই-বোন। প্রবাসীরা যে শুধুমাত্র টাকা উপার্জর করে তা নয়, এমনকি সামাজিক কোন সমস্যা যেমন টাকার অভাবে কোন গরীব পিতা তার মেয়ে বিয়ে দিতে পারছে না, এমন সময় কোন না কোন প্রবাসী ভাই এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে টাকার ব্যবস্থা করে দেন। আবার কেউ যদি কোন দূরারোগ্য ব্যাধিতে একান্ত হয়ে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা নিতে না পারে তখনই প্রবাসীরা এসে পাশে দাঁড়ায় মায়া-মমতায়, ভালবাসায় এবং দায়িত্ববোধ থেকে।
কিন্তু এত কিছুর পরও আমরা কি পেরেছি প্রবাসীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে? মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই সোনার বাংলা উপহার দিয়েছেন, আমরা তাদের কাছে আজীবন ঋণী। কিন্তু যে প্রবাসীরা তাদের জীবনের বিনিময়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদেরকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়েছেন, আমরা তাদের কাছে কতটুকু ঋণী? এমনকি সন্দ্বীপের যুবকেরা প্রবাস জীবন বেছে নেয়া আগে অর্থভাবে তারা বিয়ে করতে চাইতেন না, পরিণামে সন্দ্বীপের মেয়েদের বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত কষ্টকর হয়ে যেত।
এই সে প্রবাসী যারা তাদের শ্রম, মেধা দিয়ে সোনার সন্দ্বীপ বিনির্মাণ করে যাচ্ছেন, তাদের নেই কোন সামাজিক স্বীকৃত, নেই কোন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা। যেমন একজন সাধারণ মানুষ ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা অফিস থেকে যেভাবে সেবা নিচ্ছেন, একজন প্রবাসীও কোন সুযোগ সবিধা ছাড়া একই রকম সেবা নিচ্ছেন। আবার যে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে সন্দ্বীপে এতগুলো ব্যাংকের শাখা লাভজনক ব্যবসা করে যাচ্ছে, সেখানেও তাদের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিদা নেই। বরং ক্ষেত্র বিশেষে তারা হয়রানির শিকার হন।
প্রবাসীদের জন্য নেই কোন সামাজিক সংবর্ধনার ব্যবস্থা। তাই আমাদের এখনই সময় এসেছে তাদের মূল্যায়ন করার, তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার। ঈদ উপলক্ষে অনেক প্রবাসী দেশে আসেন। আমাদের উচিত তাদের সংবর্ধিত করা।বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধায় তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দেয়া। প্রবাসীদেরকে ব্যাংকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন মাসিক জমা স্কিমে এবং বিভিন্ন মেয়াদী আমানতে মুনাফার হার বাড়িয়ে দেওয়া। এসব দাবি জোরালো করতে হবে। যেহেতু টাকা বিনিয়োগের অন্য কোন খাত সন্দ্বীপে নেই। সন্দ্বীপের তরুণ প্রজন্ম যারা প্রবাসে পারি দিচ্ছেন তাদের অনেকের কারিগরী শিক্ষার অভাব আছে। এর কারণ হলো সন্দ্বীপে এখন পর্যন্ত মানসম্মত, যুগোপযোগী কোন কারিগরী শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট নেই। সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এর মান ও উদ্দেশ্য দুটোই বাস্তবায়ন হতে পারে।
পরিশেষে এইটুকু বলবো, প্রবাসীদের জন্য আমরা করি বা না করি তারা কিন্তু তাদের দায়িত্বটুকু পালন করে যাবে। তাই প্রাবাসীদেরকে সালাম জানাই, শ্রদ্ধাভরে বলি, ‘তোমরাই এদেশের রেমিটেন্স যোদ্ধা’।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)