ক্ষতটা হয়েছিল ২০০৯ সালে। তার ঘা থাকল দীর্ঘ আটটা বছর। লাহোরে খেলোয়াড়দের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর নির্বাসিত পাকিস্তানে ক্রিকেট ফিরল আবার সেই রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কান দিয়েই। যদিও সন্ত্রাসের ক্ষতে দেওয়া মলমের ম্যাচটা হল পুরো বন্দুকের ডগায় চড়ে।
দেশে ক্রিকেট ফেরাতে কম চেষ্টা করেনি পাকিস্তান। কয়েক দফা জোর চেষ্টা চালিয়েছে বাংলাদেশকে নিয়েও। কিন্তু দেশটা পাকিস্তান বলেই হয়তো সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাসেও ভরসা পায়নি কোন দল।
বারবার ব্যর্থ পাকিস্তান হতাশা চেপে চেষ্টা করে গেছে নিরন্তর। ইমরান, ওয়াসিম, ওয়াকার, ইনজামাম, ইউনিস ও আফ্রিদি-শোয়েবের দেশে ক্রিকেট হবে না এটাও তো মেনে নেওয়া কঠিন। তাই দায় বা দায়িত্ব এড়াতে পারেনি বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিও। শেষ পর্যন্ত আইসিসি-পিসিবি যুগল চেষ্টায় প্রাণ পায় পাকিস্তান ক্রিকেট।
শুরুটা হয় বর্তমানে ধুঁকতে থাকা জিম্বাবুয়েকে দিয়ে। যারা এক সময় বিশ্বে তাবৎ বড় বড় দলকে কাঁপিয়েছে। কিন্তু মহা ঝামেলায় জর্জরিত জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট প্রায় ‘মৃত্যুর’ কাছাকাছি।
অ্যান্ডি-গ্র্যান্ড ফ্লাওয়ার, হিথ স্টিক ও ক্যাম্পেল-জনসনের দেশের এই দূর্বলতার সুযোগটাই নেয় পিসিবি-আইসিসি। প্রচুর আর্থিক সুবিধাও দেওয়া হয় তাদের ক্রিকেটারদের। কড়া নিরাপত্তায় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ৮০০ মিটারের মধ্যই বোমার বিস্ফোরণ হয়েছিল। তবে জিম্বাবুইয়ানদের সিরিজ শেষ হয় কোনও দুর্ঘটনা ছাড়াই।
কিন্তু এত বড় ঘা জিম্বাবুয়ের মত ‘দূর্বল’ মলমে কি আর সাড়ে। আর সেটা বুঝতে পেরেই ভিন্ন হাঁটা দুই সংস্থার। আয়োজন হয় বিশ্ব একাদশ বনাম পাকিস্তান টি-টুয়েন্টি সিরিজ। যাতে আমলা-ডু প্লেসিসদের সঙ্গে খেলে এসেছেন বাংলাদেশের ওপেনার তামিম ইকবালও।
ওই সিরিজটি আয়োজনে অবশ্য কম অর্থ ব্যয় হয়নি আইসিসি-পিসিবি। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর তথ্যানুযায়ী পরিমাণটা আড়াই থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ২০০ থেকে ২৪৬ কোটি টাকা।
বিশ্ব একাদশের তারকা ক্রিকেটারদের প্রত্যেককে দেয়া হয় অন্তত ১ লাখ ডলার করে। জিম্বাবুয়েকেও প্রায় একই টোপ দিয়ে আনা হয়েছিল। এই দুই সিরিজের মাঝে অবশ্য পাকিস্তান সুপার লিগের ফাইনালও অনুষ্ঠিত হয় লাহোরে। সেই ফাইনালে খেলেছেন বাংলাদেশের এনামুল হক বিজয়।
আগের সিরিজ ও ম্যাচগুলোতে তো অবশ্যই। শ্রীলঙ্কার জন্য এদিন ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা। পুলিশ, রেঞ্জার্স, আধা-সেনা ও সেনাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন’র তথ্যানুয়ী সেখানে ১১ হাজার শুধু পুলিশ সদস্যই ছিলেন।
তবে চরম নিরাপত্তা ক্রিকেট আবেগের এতটুকুও নষ্ট করতে পারেনি। নারী-পুরুষসহ সব বয়সের ক্রিকেটপ্রেমীরাই লাহোরে এসেছিলেন। স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
ম্যাচের আগে পাকিস্তান জুড়ে সাজসাজ রব পড়ে যায়। শহর, গ্রামের রাস্তায় নেমে আসে ঈদের আনন্দ। ম্যাচের পর বোর্ডের চেয়ারম্যান নাজাম শেঠি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের কাছে এই ম্যাচটি ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে।’
শ্রীলঙ্কা দলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যাচ সেরা শোয়েব মালিক বলেছেন, নিজের দেশের দর্শকদের সামনে খেলার অনুভূতিই আলাদা। যেটা থেকে এতদিন আমরা বঞ্চিত ছিলাম। এতে তরুণরাও উৎসাহিত হবে।
মালিকের মত একই রকম কথা বলেছেন অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। তিনি আবার দ্রুততম সময়ে দেশের মাটির টেস্ট ক্রিকেট খেলার আশা প্রকাশ করেছেন।
ওয়ানডের পর টি-টুয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হলেও পরাজয় ভুলে শ্রীলঙ্কা মজেছে পাকিস্তান বন্দনায়। স্বাগতিকদের দেওয়া আতিথিয়েতা ও সম্মানে মুগ্ধ অধিনায়ক থিরাসা পেরেরা বলেছেন, ‘এটা খুবই কঠিন ট্যুর ছিল। তবে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য পাকিস্তানি সমর্থকদের ধন্যবাদ।’
জিম্বাবুয়ে-পিএসএল এবং সবশেষ বিশ্ব একাদশের সিরিজে আর্থিক বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এসব ম্যাচে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়দের অনেকে ‘লোভী’ও বলেছেন। শ্রীলঙ্কা সিরিজে আর্থিক ব্যাপার যদি থেকেও থাকে, তাও ছিল পুরোপুরি গোপনীয়।
তবে আর্থিক বিষয় না থাকলেও এটাকে ক্রিকেটের রাজনৈতিক সফর বলার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। ম্যাচের একদিন আগে ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে ‘শ্রীলঙ্কার লাহোর প্রত্যাবর্তনের গোপন সুবিধা কি?’- শিরোনামে একটি লেখা লিখেছেন অ্যান্ডু ফিদেল ফার্নান্ডো।
তামিলদের সঙ্গে চলা গৃহযুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কায় গিয়ে ক্রিকেট খেলেছে পাকিস্তান। এই সফর তার প্রতিদান কিনা, সেই প্রসঙ্গ তুলে ফার্নান্ডো বলেছেন, আর যাই হোক, অন্তত এটা ঠিক যে একমাত্র রাজনীতিই শ্রীলঙ্কাকে লাহোরের রাস্তা দেখিয়েছে।
মলম-অর্থ-রাজনীতি। সব ছাপিয়ে বড় বিষয়, ক্রিকেট ফিরেছে পাকিস্তানে। সফর শেষে শ্রীলঙ্কাও ফিরেছে নিরাপদে। তাই খেলাধুলা যারা ভালবাসেন তাদের সবার একটাই চাওয়া অর্থ বা রাজনীতি নয়, শুধু ক্রিকেটের জন্যই হোক খেলা, আর জয়ী হোক ক্রিকেট।